স্তন ক্যান্সার একটি নীরব ঘাতক
স্তন ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ। রকেট গতিতে এ রোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। স্তন ক্যান্সার বাংলাদেশে দ্বিতীয় ব্যাপকতম ক্যান্সার। তবে মহিলাদের জন্য এক নম্বর ক্যান্সার। ফুসফুসের ক্যান্সারে সর্বাধিক সংখ্যক (২৭.৫%) পুরুষ এবং স্তন ক্যান্সারে (৬%) মহিলারা আক্রান্ত হন। প্রতি বছর ১৪,৮৩৬ জন মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ৭১৪২ জন মৃত্যু বরন করেন। পুরুষরাও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তবে এর হার খুব কম।
শরীরে বেশ কয়েকটি অসংগতির ফলে স্তন ক্যান্সার হতে পারে। এর মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে শরীরে এষ্টেরোজেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। শরীরে এষ্টেরোজেনের উপস্থিতির সাথে স্তন ক্যান্সারের গভীর সম্পর্ক দেখা যায়। এষ্টেরোজেনের ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে ইনসুলিন প্রতিরোধ সমস্যা সমাধান করতে হবে।
ইনসুলিন একটি হরমোন যা খাদ্য গ্রহণের পরে প্যানক্রিয়াসে উৎপাদিত হয়। ইনসুলিন শরীরের সকল কোষে রক্ত থেকে চিনি শুষে নেয়ার জন্য বার্তা পাঠায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে আধুনিক তেল ও চিনি সমৃদ্ধ খাদ্য সামগ্রি এই স্বাভাবিক কার্যক্রমে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে চিনি সব চেয়ে বড় অপরাধী। প্রয়োজনের চেয়ে বেশী পরিমাণে বিশুদ্ধ শর্করা/চিনি যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন মাত্রাতিরিক্ত ইনসুলিন তৈয়ার হয় যা শরীর সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনা। ফলে শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধী শক্তি উৎপাদিত হয়। শরীরে যখন ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে এষ্টেরোজেনের মাত্রা ও বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চিনি সেবনের সাথে সাথে স্তন ক্যান্সারের প্রবনতাও বেড়ে যায়।
ইনসুলিন মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার ফলে যে ভয়াবহতার সুত্রপাত হয় তা এখানেই শেষ নয়। ইনসুলিন প্রতিরোধের ফলে শরীরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়। শরীরে চর্বি বৃদ্ধির সাথে সাথে এরোমাটেজ নামের আর একটি এনজাইমের পরিমাণ ও বেড়ে যায়। শরীরে এষ্টেরোজেনের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। ফলে স্তন ক্যান্সারের আশংকাও বহুগুণে বেড়ে যায়। এ সমস্যাটি মহিলাদের রজোনিবৃত্তি (মেনোপজ) পরবর্তী সময় জটিল আকার ধারণ করে। শরীরে অতিরিক্ত চর্বির পরিমাণ এক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারের এক নম্বর ঝুঁকি হিসাবে কাজ করে।
শরীরে মাত্রারিক্ত ইনসুলিন আরো অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। টিউমার বৃদ্ধি পায়। শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ক্যান্সারের প্রবনতা বেড়ে যায়।
কেবল মাত্র ইনসুলিনের ভারসাম্যই নয়, পরিবেশগত আরো কিছু সমস্যা যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, হরমোন প্রয়োগকৃত গরুর দুধ ইত্যাদির মাধ্যমে ও শরীরে এষ্টেরোজেনের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। বালাইনাশক ব্যবহার করা খাদ্য এবং প্লাষ্টিকে সংরক্ষিত খাদ্য ও পানীয়ের প্রভাবেও এষ্টেরোজেনের জটিল সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে।
মানুষের পরিপাকতন্ত্রের সাথে স্তন ক্যান্সারের একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সব ব্যাকটেরিয়া শুধুমাত্র খাদ্য হজম করতেই সহায়তা করে না বরং এষ্টেরোজেনের বিষক্রিয়াও বিনষ্ট করে দেয়। যদি অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্যর্পূণ অবস্থায় না থাকে তাহলে বাড়তি এষ্টেরোজেন শরীর থেকে নির্গত না হয়ে বরং শরীরেই শুষিয়া নেয়। ফলে শরীরে এষ্টেরোজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। নানা রকম জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়। পরীক্ষায় আরো প্রমাণিত হয়েছে যে শরীরে যত বেশী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় ততবেশী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর কারণ হতে পারে যত বেশী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় তত বেশী অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া মারা যায়।
যে সকল ব্যবস্থার মাধ্যমে এষ্টেরোজেনের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, ইনসুলিন প্রতিরোধী অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা স্বাভাবিক থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় গুলি হচ্ছে:
১. সপ্তাহে কম পক্ষে ৩-৫ ঘন্টা শারীরিক পরিশ্রম করা;
২. আশঁ সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। আশঁ সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শাক-সবজি, ফলমূল, ডাল, শিম, ঢেকিছাটা চাল, তিষির বীজ ইত্যাদি;
৩. প্রতিবেলা খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ আমিষ সেবন করা;
৪. ভারসাম্যর্পূণ শারীরিক ওজন ধারণ করা;
৫. রাতে ভাল ঘুম নিশ্চিত করা;
৬. হরমোন, রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক মুক্ত খাবার খাওয়া;
৭. বিষ মুক্ত পরিবেশে জীবন যাপন করা
৮. নেশামুক্ত জীবন-যাপন করা।