গবাদি পশু পালনের প্রতিকুলতা: আরশিনগরের ঘাস চাষ
নয়াকৃষি খুব সহজ নয়। বিশেষত যখন কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে সমাজে ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয়ে পড়ে।
কৃষিতে প্রযুক্তির প্রয়োজন আছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু যখন আধুনিকরণের নামে হালবলদ বাদ দিয়ে ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদ করা হয় তখন তার ভালমন্দ অবশ্যই বিচার করতে হবে। নির্বিচারে আধুনিক কৃষির প্রতি সরকারী পক্ষপাত এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি অতি আগ্রহের কারনে আমরা ভালটাই শুধু শুনি। মন্দটা কিন্তু জানি, অথচ বলি না। বিরোধিতাও করি না।
যেমন, ট্রাক্টর লাদে না। অর্থাৎ গোবর দেয় না। ফলে জমির সারের জন্য কৃষককে দৌড়াতে হয় সার কম্পানির কাছে। কৃষকের আয়ের বড় অংশ চলে যায় কম্পানির কাছে। রাসায়নিক সারের অল্পই ফসল ব্যবহার করে, বাকিটা বিষাক্ত রাসায়নক বর্জ্য হয়ে মাটিতে মেশে, কিম্বা পানিতে ধূয়ে গিয়ে পুকুর, নদিনালা, সমুদ্র দূষিত করে।
দুই, ট্রাক্টরের জন্য বৈদেশিক মূদ্রা খরচ করে তেল আমরা আমদানি করি, তার যোগান দিতে হয় অভিবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টের নিষ্পেষিত শ্রমিকদের। নয়াকৃষি মানে কৃষক ও জাতীয় পর্যায় উভয় ক্ষেত্রেই লাভক্ষতির হিসাব রাখা।
এর প্রতিকারের জন্য আমরা যখন কৃষকের ঘরে গবাদি পশু পালনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাই, তখন বেশ বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়।
এক. কৃষিতে বিষ ব্যবহারের ফলে জমির আইল কিম্বা মাঠে ঘাস বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ঘাস গবাদিপশুর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দুই. উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত ব্যবহার করারা কারনে বামন ধান প্রবর্তন করা হয়েছে। আগে বিভিন্ন দেশী ধান আবিষ্কার করারা পেছনে কৃষকের উদ্দেশ্য ছিল এমন সব জাত দরকার যা একই সঙ্গে মানুষের এবং গবাদি পশু সহ অন্যান্য জীবের আহার হবে। তাই অধিকাংশ ধানের জাত ছিল লম্বা। এমন ধানও ছিল যেগুলো বন্যার সময় পানি বাড়ার সাথে সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বড়, থোকা থোকা ও লম্বা হয়ে যেত। এই জাতগুলো মানুষের জন্য খাদ্যের জোগান যেমন দিতো, তেমনি গবাদি পশুর জন্য পুষ্টিকর খড়ও সরবরাহ করতো।
আরশি নগর বিদ্যাঘরে গবাদি পশুর দায়িত্বে আছেন আলম। তিনি গেমা ধান চাষের সফলতায় খুশি। এই ঘাস একটু উঁচু জাতগায় লাগানো হয়েছে। ধানের খড় ও নয়াকৃষি জমির ঘাস ছাড়াও বর্ষায় তিনি তাঁর গোধনদের বাড়তি কিছু কাঁচা খাস খাওয়াতে পারবেন। এবার আরশী নগরে ঘাসের গবেষণার সাফল্যের ভিত্তিতে নয়াকৃষির কৃষকদের খামারে গরু পালন ও ঘাস চাষের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নয়াকৃষি এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নত মানের দেশী জাতের গবাদি পশুর পালনের ওপর জোর দেয়। বাংলাদেশ এখনও কৃষি প্রধান দেশ। দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির জন্য খুবই গুরত্বপূর্ন হচ্ছে গবাদিপশু পালন করা। গ্রামের পরিবার গুলোর পুষ্টির মূল মাধ্যম হলো স্থানীয় জাতের নিরাপদ গরুর দুধ। পাশাপাশি গ্রামের কৃষকরা গবাদি পশুপাখির জাতও রক্ষা করছেন যুগ যুগ ধরে। গবাদিপশুর খাদ্যের মধ্যে কাঁচা ঘাস খুবই গুরত্বপূর্ণ। গবাদিপশুর বৃদ্ধি এবং দুধ উৎপাদনে কাচাঁ ঘাসের কোনো বিকল্প নেই। নতুন প্রতিকুল বাস্তবতায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি নিয়েও ভাবনা চিন্তা জরুরী।
আমাদের দেশের মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই গবাদি পশু লালন-পালন করে আসছে। মাংস, দুধ এবং হাল চাষের জন্য গবাদি পশু নিত্য ব্যবহার্য। আগে গবাদি পশুর খাদ্য হিসাবে কাঁচা ঘাসের ঘাটতি ছিল না। তখন ঘরে ঘরে স্থানীয় জাতের গরু পালন ও এর নিরাপদ দুধ পান করাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের ফলে চারণভূমি ও কাঁচা ঘাসের অভাব দেখা দেয়ায় গবাদি পশু পালন এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বহুজাতিক কোম্পানির বীজ এবং সার-বিষ এবং কীটনাশক জমিতে ব্যবহারের ফলে জমিতে আর ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না। যারফলে গো খাদ্য কমে যাচ্ছে। এরফলে দেশে গবাদিপশু পালনেও কৃষকদের অনীহা বাড়ছে। যারফলে স্থানীয় জাত গুলোও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গবাদিপশু পালনের জন্য ঘাস খুবই গুরত্বপূর্ণ। ঘাস বৃদ্ধি বা স্থানীয় গবাদি পশুর জাত টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে নয়াকৃষি কৃষকদের পদ্ধতি। সহজ অর্থে কোম্পানির বীজ এবং সার-বিষ এবং কীটনাশক পরিত্যাগ করে নয়াকৃষির পদ্ধতিতে স্থানীয় জাতের বীজ দিয়ে শস্য ব্যবস্থাপনা করলেই নয়াকৃষি কৃষকদের মতো ফসল উৎপাদনেও বেশি হবে এবং গো খাদ্যরও অভাব পড়বে না। যদি কেউ বেশি করে গবাদিপশু পালন করতে চাই তাহলে বাড়তি খাদ্যর যোগান হতে পাড়ে গেমা ঘাস বা নেপিয়ার ঘাস।
গেমা ও নেপিয়ার আমরা এর আগেও নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষ করে ভাল ফল পেয়েছি। আরশিনগর বিদ্যাঘরে এবার এই ঘাস চাষ করা হচ্ছে । কারন এ বছর থেকে আমরা আবার এক দেড়শ গবাদি পশু পালনের প্রস্তুতি নিয়েছি। নয়াকৃষির কৃষকরাও করছেন । বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকায় এ ঘাস জন্মানো সম্ভব। সুপরিকল্পিত ভাবে চাষ করলে এ থেকে প্রায় সারা বছরই গবাদি পশুর জন্য কাঁচা ঘাসের চাহিদা পূরন করা যায়।
গেমা ও নেপিয়ার। একপ্রকার স্থায়ী ঘাস। দেখতে ভূট্রার মতো লম্বা ৫-৯ ফিট বা তার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। এই ঘাসের জাতগুলো দ্রুত বর্ধনশীল,সহজে জন্মে। পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য। সবচেয়ে বড় গুন হলো খরা এলাকায় বেশ ভাল হয়।
নেপিয়ার একবার রোপন করলে ৩/৪ বছর পর্যন্ত এর ফল পাওয়া যায়। আর গেমা ১/২ বছ্র পর্যন্ত কাটা যায়। পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।শীতকালের ২-৩ মাস ছাড়া প্রায় সারা বছরই এর উৎপাদন হতে থাকে। এই ঘাস আবাদের জন্য উঁচু ও ঢালু জমি যেমন বাড়ির পার্শ্বে উঁচু অনাবাদি জমি, পতিত জমি, উঁচু ঢিবি, আম কাঠালের বাগান, পাড়, রাস্তার ধার,ভেড়িবাঁধ এবং জমির চারপাশের আইল সবচেয়ে উত্তম। এই ঘাসগুলো সব মাটিতেই হয় তবে বেলে-দোআঁশ মাটিতে সবচেয়ে বেশি ভাল হয়। এই ঘাসের জাতগুলো ছাঁয়াযুক্ত স্থানে উৎপাদন করলে একটু কম হয়। যেখানে বৃষ্টি বা বর্ষার পানি জমে থাকে না সেরকম জমি নির্বাচন করাই ভাল। গেমা নেপিয়ার ঘাস সারা বৎসরই রোপন করা যায়। সাধারনতঃ বর্ষা মৌসুমে রোপন করলে ভাল হয়।বর্ষার শুরুতে ঘাসের কাটিং,ঘাসের মোথা বা চারা রোপন করা যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর পরই কাটিং বা চারা রোপন করলে প্রথম বছরেই ৪/৫ বার পর্যন্ত ঘাস কাটা যায়। চারা, মোথা বা কাটিং লাগানোর পর মাটিতে রস বা জো না থাকলে চারার গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে। এই ঘাস আখের কাটিং এর মত কাটিং অর্থাৎ কান্ডের দুই মাথায় কমপক্ষে ২-৩ টি গিট রেখে কাটতে হবে। জমিতে বা গর্তে মুরগির বৃষ্ঠা বা কম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। চারা লাগিয়ে চার পাশ ভাল করে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে যাতে চারার শিকড় মাটির সাথে লেগে থাকে।
বর্ষার সময় ৫/৭ মাস পানি সেচের প্রয়োজন হয় না। শুধু খড়ার সময় পানির সেচের প্রয়োজন পড়ে। আর জমিতে পচা গোবর,পচানো ঘাস,খৈল এবং কম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। প্রথম কাটিং ৬০-৮০ দিনের মধ্যে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে যখন গো খাদ্যর অভাব থাকে তখন এই ঘাসগুলোর উৎপাদন ভাল হয়। ১ শতক জমি থেকে ৩০-৪০ কেজি গেমা বা নেপিয়ার ঘাস কাটা যায়। আর ১ শতক জমিতে ৫ কেজি কম্পোস্ট বা জৈব সার ব্যবহার করতে হয়।
জমি থেকে ঘাস কাটার পর ঘাস যাতে শুকিয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। আস্ত ঘাস গবাদি পশুকে দিলে অপচয় বেশি হয়। ঘাস দা বা কাঁচি দিয়ে ২-৩ ইন্চি লম্বা করে কেটে খাওয়াতে হবে।খড়ের সাথে মিশিয়েও খাওয়ানো যায়।
গেমা বা নেপিয়ার দুই সারি করে রোপন করে মাঝখানে মাসকলাই ও খেসারি সাথীঘাস হিসেবে চাষ করলেও বাড়তি গো খাদ্য উৎপাদন করা যায় পাশিপাশি জমির উর্বরতা শক্তিও বৃদ্ধি হয়।