আরশিনগরে নয়াকৃষির নিরাপদ মুড়ি


ঈশ্বরদী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের অজপাড়া মুলাডুলি ও দাশুড়িয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের সহযোগিতায় সাধারণত সারা বছরই তৈরি হয় এই ভেজালমুক্ত মুড়ি। ভেজালের যুগে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ছাড়া শুধু জৈব সারে উৎপাদিত ধান দিয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালে ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ভাজা মুড়ি তৈরির সুখ্যাতি ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী ছাড়িয়ে বাংলাদেশের রাজধানিসহ প্রতিটি অঞ্চলে পৌছে গেছে। সারা বছর  ভেজালমুক্ত মুড়ি তৈরি করলেও পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নয়াকৃষি কৃষকদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে ভেজালমুক্ত মুড়ি তৈরির উৎসব। পবিত্র রমজানে ইফতারির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ এই মুড়ি। আর সেই মুড়ি ভেজালমুক্ত ভাবে উৎপাদন করে উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন এবং নয়াকৃষি কৃষকদের প্রচেষ্টায় প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে শস্য প্রবর্তনা বিক্রয় কেন্দ্রে । আপনিও এসে দেখে-শুনে নিয়ে যেতে পারেন নয়াকৃষির নিরাপদ মুড়ি। উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন, নয়াকৃষি কৃষক এবং শস্য প্রবর্তনার এই সুন্দর চেষ্টাকে আমরা অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।  

মুড়ি একটি উপাদেয় ও সুস্বাদু খাদ্য । শহর বা গ্রামে সব স্থানেই মুড়ির কদর রয়েছে। প্রতিদিন সকালে চায়ের সাথে এক মুঠ মুড়ি কে না খায়?  মৌসুম ভিত্তিক এর চাহিদা আরও বেশি । গ্রীষ্মকালে আম - কাঠালের সাথে মুড়ি না হলে কি চলে? শীতকালে খেজুরের গুড়ের তৈরি পায়েসের সাথে মুড়ির স্বাদই আলাদা। বর্ষায় ঝাল-পেয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখা ছাড়া গল্প চলে না। বাচ্চাদের কাঁন্না থামাতে মুড়ির মোয়া বিশেষ ভূমিকা রাখে। খাদ্য হিসাবে অঞ্চল ভেদে মুড়ির ব্যবহার ভিন্ন রকম। তাই নিরাপদ মুড়ি উৎপাদনে উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন, নয়াকৃষি কৃষক এবং শস্য প্রবর্তনা বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

বাজারের সাদা ধবধবে মুড়িতে বিভ্রান্ত হবেন না। এই ধরনের মুড়িতেই বেশী ব্যবহার হয় রাসায়নিক সার ইউরিয়া। বাজারের মুড়ি তৈরীতে ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক সার ইউরিয়া ও ফিটকিরি। ইউরিয়া ব্যবহারে মুড়ি বেশি সাদা হয় কিন্তু এর ক্ষতির দিক কেউ চিন্তা করে না। মানুষ নানা রকম অসুখের শিকার হচ্ছে এ ধরনের খাদ্যের কারণেই।

নিরাপদ মুড়ি তৈরি করতে হলে যথেষ্ঠ দক্ষতার প্রয়োজন। নিরাপদ মুড়ি তৈরি করতে হলে কিছু নিয়ম-প্রক্রিয়া আছে যা নিরাপদ মুড়ি উৎপাদনে খুব জরুরি।

নিরাপদ মুড়ির চাল তৈরির প্রক্রিয়াঃ

প্রতমে মুড়ির ধান ভাল করে শুকাতে হয়। ভিজা ধানে মুড়ি ভাল হয় না চাল-চাল থাকে। মুড়ির ধান সবসময় দুই সিদ্ধ করতে হয়।বড় পাত্রে পানি ফুটলে শুকনা ধান সিদ্ধের জন্য দিতে হয়। প্রায় এক ঘন্টা চুলায় জ্বাল দেয়ার পর ধানের মুখ অল্প ফাটলে নামাতে হয়। এই সিদ্ধ ধান ঠান্ডা পানিতে মাটির চাড়ি অথবা সিমেন্টের  চাড়িতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে আবার সিদ্ধ করতে হয়। সিদ্ধ ধান দুই (রোঁদে আজ এবং পরের দিন)ভাল করে শুকাতে হয়। ধান শুকানোর পর ঢেঁকিতে ভেনে চাল তৈরি করে মুড়ি ভাজার উপযোগি করা হয়।

নিরাপদ মুড়ি ভাজার বিশেষ পদ্ধতিঃ

নিরাপদ মুড়ি ভাজার জন্য প্রথমেই দরকার মাটির পাতিল। পাতিলটি বিশেষ ধরণের হয়। পাতিলের নিচে খরখরে ভাব থাকে। এই পাতিল বেশি টেকসই। মুড়ি  ভাজার জন্য কাঠের লাকড়ি,সাদা চিকন বালি,বালি চালার নেট, লবন, পানি, পাটকাঠি,পাতির ধরার কাপর, ঝাঁঝড় ও চালনা ব্যবহার করা হয়। মোটা বালি দিয়ে মুড়ি ভাজা ভার হয় না ,পুড়ে যায়। তাই চিকন বারি লাগে। পদ্মা নদী থেকে বালি সংগ্রহ করতে হয়। মুড়ি ভাজার চুলাও হয় ভিন্ন ধরনের। একই চুলার দুটি মুখ। এক মুখে বালি গরম হয় অপর মুখে লবনপানি দেওয়া চাল ভাজতে হয়।

প্রথমে চাল শুধুমাত্র লবন পানি দিয়ে ৫ থেকে ৭ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হয়। তবে চাল ভিজিয়ে না রাখলেও চলে। চাল ভিজিয়ে রাখলে মুড়ি ফোলে ভাল। ১০০ কেজি চাল আড়াই কেজি লবন এবং ৬ কেজি পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এক কেজি চালের মুড়ি ভাজার জন্য বালি লাগে প্রায় ৪ কেজি। মাটির পাতিলে প্রায় চার কেজি বালি দিয়ে চুলাতে গরম করতে হয়। পাশাপাশি লবনপানি দিয়ে ভেজানো চাল এক কেজি ভাজতে হয়। চাল লাল হলে এবং একটু মুখ ফাটলে গরম বালির পাতিলে চাল ডেলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে ঝাঝড়ে ঢালতে হয়। বালি বেশি গরম হলে মুড়ি পুড়ে যাবে। আবার বালি কম গরম হলে মুড়ি চাল থেকে যাবে মোটকথা মুড়ি ভাজার জন্য দক্ষতার দরকার। বালি ঠিকমত গরম হল কিনা তা বোঝার জন্য পাটখরি দিয়ে বালি নেড়ে পরিক্ষা করতে হয়। যদি বালি বেশি গরম হয় তাহলে পাটখরিতে ধোঁয়া উঠবে। বেশি গরম বালিতে মুড়ি পুড়ে যাবে। তাই বালির গরম নিয়ন্ত্রন করার জন্য ধানের তুষ ব্যবহার করা হয়। ধানের তুষে বালির পাতিল বসিয়ে নেড়ে নেড়ে বালির গরম নিয়ন্ত্রন করে। অনেক সময় পাতিলে বালি এতগরম থাকে যে তুষে সামান্য আগুন জ্বলতেও দেখা যায়।

আরশিনগর বিদ্যাঘর কেন্দ্রে প্রতিদিন মুড়ি ভাজতে চারটি চুলাতে ৮ জন নারী কাজ করে। চুলা প্রতি দুই জন দক্ষ নারী। সকাল সাতটা থেকে বিকেল ৫ টা (দুপুরে ১ ঘন্টা বিশ্রাম) ১০০ কেজি চালের নিরাপদ মুড়ি তারা তৈরি করেন। 

মুড়ি সংরক্ষনঃ

মুড়ি ভাজার পর টিনের পাত্র মুড়ি সংরক্ষন করা হয়। এখন প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র বের হয়েছে। কিন্তু নিরাপদ ভাবে মুড়ি সংরক্ষণ করতে হলে টিন বা কাচেঁর পাত্রের বিকল্প নেই।

 


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter