যান্ত্রিক কৃষি পরিবেশের বোঝা
আদিকাল থেকে বাংলাদেশের কৃষি ছিল কাঠের লাঙল, জোয়াল, মই, হালুয়া পেন্টি, বলদ, নিরাণী, দোন ইত্যাদি নির্ভর। তবে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইরি ধান প্রবর্তনের পর থেকে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বহুগুণে সমৃদ্ধ হাজার হাজার স্থানীয় জাতের ফসলের পরিবর্তে চালু হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল জাত ও হাইব্রিড। এসব বীজের জন্য কৃষক এখন দেশী বিদেশী কোম্পানীর উপর নির্ভরশীল।
এদেশের কৃষি ছিল মূলত: বৃষ্টি নির্ভর। এখন দিনে দিনে তা হচ্ছে সেচ নির্ভর। প্রচলিত কৃষি মৌসুমের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে যা ছিল রবি, খরিদ-১, ও খরিদ-২ এখন তা হয়েছে যথাক্রমে বোরো, আউশ এবং আমন। অর্থাৎ বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসল চক্র পরিবর্তন হয়ে এককাট্টা ধান ভিত্তিক ফসল চক্রে রূপান্তরিত হয়েছে। আগে ১৬০টি ফসলের আবাদ হত। কিন্তু এখন একটি মাত্র ফসল ধানের অধীনে আবাদ হয় দেশের ৮০% জমি। আগে ধান উৎপাদন ছিল বৃষ্টি নির্ভর। এখন তা হচ্ছে প্রধানত: সেচ নির্ভর। এখন শুকনা মৌসুমে ধরীত্রির বুক ছিদ্র করে পানি তুলে বোরো ধান ক্ষেতে সেচ দেওয়া হয়। এভাবে এক কেজি ধান উৎপাদন করতে ৫০০০ লিটার পানি লাগছে। অতিরিক্ত পানি তোলার ফলে দিনে দিনে ভূ-গর্ভের পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় এ পানিতে আর্সেনিক দূষণ ঘটছে। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে এখন ৬২ জেলার পানি আর্সেনিকে দূষিত। এ পানি সেচের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। সেচের পানির মাধ্যমে ফসলেও আর্সেনিকের সংক্রমণ ঘটছে।
পাওয়ার টিলার ও ট্রাকটর দিয়ে জমি চাষের ফলে একদিকে মাটি চাপে বসে যাচ্ছে অন্য দিকে পেট্রল, ডিজেল থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশ দূষণ করছে। চাপে বসে যাওয়া মাটিতে গাছের শিকড় ঠিকভাবে বাড়ছে না। রাসায়নিক সার পানিতে গলে মাটির তলায় চলে যাচ্ছে অথচ গাছের শিকড় সেখানে পৌঁছাতে পারছে না। সারের অপচয় হচ্ছে।
ধানের উচ্চ ফলনশীল জাত ও হাইব্রিড আবাদ করতে ব্যাপক হারে ইউরিয়া ও অন্যান্য রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে। রোগ বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। নানা রকম রোগ বালাই এর আক্রমন ঘটছে। ব্যাপক হারে বালাইনাশক ব্যবহার হচ্ছে।
প্রকৃতির লাঙল বলে পরিচিত কেঁচো এবং পোকামাকড়, শেওলা, জীব অনুজীব যারা প্রতিনিয়ত মাটির উর্বরতা বাড়াতে সহায়তা করতো তারা সব ধ্বংস হয়েছে। পর-পরাগায়ন নির্ভর ফসল যেমন, সরিষা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ, বাঙ্গি, পটল, লাউ, করল্লা, শসা, ক্ষিরাই, ঝিঙা, ধুনদুল, কাকরোল, চিচিঙ্গা, লিচু, আম ইত্যাদি গাছে ফুল হয় কিন্তু পরাগায়নের অভাবে ফল হচ্ছে না। কারণ মৌমাছি, প্রজাপতি এবং অন্যান্য পরাগায়নে সহায়তাকারী পোকা কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মারা গেছে। গাছে ফুল হয় অনেক কিন্তু ফল হয় না।
এখন জমি চাষে গরুর পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে পাওয়ার টিলার, ট্রাকটর ইত্যাদি। গরু নাই তো গোবর নাই। মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি হচ্ছে। মাটিতে কম পক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখন বাংলাদেশের মাটিতে গড়ে জৈব পদার্থের পরিমান ১% এর নীচে নেমে গেছে। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমান ০.৮% এর নীচে নেমে গেলে সে মাটি আর কোন কৃষি উৎপাদনের উপযোগী থাকে না। তবে কৃষিতে যান্ত্রিকায়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বাংলাদেশের মাটি আর চাষাবাদের উপযোগী থাকবে না। তাছাড়া অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক প্রয়োগের ফলে মাটি, পানি, বায়ু তথা সার্বিক পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে।
বোঝার উপর শাকের আঁটির মত ইদানীং কিছু উন্নয়ন সংগঠন, প্রচার মাধ্যমও টিভি চ্যানেল বাৎসরিক বাজেট প্রণয়নের আগে কৃষকের জন্য মায়া কাঁন্নার আয়োজন করেন। কৃষির বাজেট। কৃষকের বাজেট। সব চটকদার শিরোনামে আলোচনার আয়োজন করেন। তাদের বক্তব্য কৃষি শ্রমিকের মজুরী বেড়ে গেছে। অথচ ফসলের বাজার মূল্য কম তাই কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। তাদের সুপারিশ কৃষি যান্ত্রিকায়ন হলেই ফসলের উৎপাদন খরচ কমবে। কৃষক লাভবান হবেন। এদের কেউ কেউ মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের সামনেও কুম্ভিরাশ্রু বর্ষন করেন কৃষকের জন্য। তাদের দাবী কৃষি যান্ত্রিকায়নের জন্য ভর্তুকী বাড়াতে হবে। তারা ভাল করেই জানেন কষি যান্ত্রিকায়নের ভর্তুকীর উপকারভোগী কারা? সারের ডিলার বালাইনাশকের ডিলার পাওয়ার টিলার, ট্রাকটর, পাম্পমেশিন ইত্যাদির ব্যবসায়ীরাই ভর্তুকীর সিংহভাগ উপভোগ করেন। তাদের ভাষায় ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কারণ কৃষি শ্রমিকের মজুরী বেড়ে গেছে। কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাদের আবদার কৃষি যান্ত্রিকায়নের জন্য প্রনোদনা দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষি যান্ত্রিকায়নের ফলে পেটে লাথি পড়ছে কার? কৃষি যান্ত্রিকায়নের সুবিধাভোগিই বা কে? এ সব মহান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রশ্ন কৃষি শ্রমিক বেকার হলে তাদের জীবন জীবিকার দায়িত্ব কে নেবে?
এ দেশের কৃষি, কৃষি পরিবেশ ও কৃষককে বাচাতে হলে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর প্রাকৃতিক কৃষির কোন বিকল্প নাই। কৃষি পরিবেশকে বিষের বোঝা মুক্ত করে পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার জন্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে আত্মনির্ভরশীল করতে হবে। কৃষকের বীজ কৃষকের হাতে রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের আবাদ বাড়াতে হবে। গ্রামীণ পরিবেশে কৃষি শ্রমিকের আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমানোর দোহাই দিয়ে রাসায়নিক ও যান্ত্রিক কৃষির সম্প্রসারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।