নগর কৃষি বাংলাদেশের আগামী সম্ভাবনা


কৃষি মানব জাতির বেহেস্তি উপহার। আদিম মানুষ যখন থেকে বীজ বপন করতে শিখলো তখন থেকেই কৃষির শুভ সূচনা। আদিতে নদী তীরে উর্বর জমি ঘিরেই মানুষের বসবাস শুরু। ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠে মেসোপটমিয়া (বর্তমান ইরাক), সিন্ধুতীরে গড়ে ওঠে মহেনজোদারো-হরপ্পা, হোয়াংহো অববাহিকায় গড়ে ওঠে চীন সভ্যতা এবং আদি বঙ্গীয় সভ্যতা গড়ে ওঠে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায়।

কালের প্রবাহে মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তন এসেছে। নদী কেন্দ্রিক সভ্যতার স্থান দখল করছে এখন সড়ক ভিত্তিক নগর। কক্সবাজার থেকে ঢাকা হয়ে পঞ্চগড় আবার সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা হয়ে সিলেট, তেমনই কুয়াকাটা থেকে ঢাকা হয়ে হালুয়াঘাট রাস্তার দু’ধারে গড়ে উঠছে বাড়ী-ঘর দালান কোঠা। এভাবে সারা দেশে রাস্তার দু’ধারে গড়ে উঠছে বাড়ী-ঘর, শিল্প কারখানা ইত্যাদি। কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে ইট-ভাটা, পেট্রোল পাম্প, শিল্প-কারখানা, বাড়ী-ঘর ও শহর। মোটা দাগে প্রতিবছর শতকরা একভাগ জমি কৃষি থেকে অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এখনই দৈনিক একজন মানুষের কবরের পরিমাণ জমিও খাদ্য উৎপাদনের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না।

গত চার দশকে ধানের উৎপাদন প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতা লাভের সময় ১৯৭১ সালে ধানের উৎপাদন ছিলো ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন যা বেড়ে ২০১৫ সালে হয়েছে ৩৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তবে এর জন্য যে মূল্য দিতে হয়েছে তা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, আগাছা নাশক ব্যবহার করা হয়েছে, মাটির তলার পানি তুলে সেচের ফলে মাটি ও পানিতে আর্সেনিকের দূষণ ঘটেছে। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬২ জেলার পানি এখন আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। দূষিত পানি দ্বারা সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলে আর্সেনিকের অণু প্রবেশ ঘটছে। রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও আগাছানাশক দ্বারা উৎপাদিত খাদ্য শস্যে মারাত্মক বিষের অণু প্রবেশ ঘটছে।

গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগী পালনের ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্য হরমোন ও এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত পণ্যে মারাত্মক দূষণ ঘটে নানা রকম জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।

স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উচ্চ মাত্রার গ্লাইসেমিক সূচক সম্পন্ন ধানের জাত যেমন ব্রি ধান-২৮ এবং ব্রি-ধান-২৯ ব্যাপক হারে উৎপাদনের ফলে মানুষের ডায়াবেটিক প্রবনতা বাড়ছে।

সীমিত সংখ্যক রাসায়নিক সার যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম প্রয়োগের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত আবাদের ফলে মাটিতে অণু খাদ্য যেমন- জিঙ্ক, সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, বোরন, কপার ইত্যাদির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ঘাটতিযুক্ত মাটিতে উৎপাদিত ফসল সেবনের ফলে মানব দেহে এ সব অণু খাদ্যের ঘাটতি জনিত স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাছাড়া মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ ৩-৫% থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে বর্তমানে গড়ে বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% এর নীচে নেমে গেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ০.৮% এর নীচে চলে গেলে সে মাটি আর কোনো ফসল উৎপাদনের উপযোগী থাকে না।

খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। খাদ্য অবশ্যই নিরাপদ হতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের সু-স্বাস্থ্যের পূর্ব শর্ত হিসাবে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরী। খাদ্য দূষণের মাধ্যমে স্বাস্থহানী প্রতিরোধের সঠিক পদক্ষেপ নিরুপনের জন্যে যথোপযোক্ত স্বাস্থ্য গবেষণা এখন সময়ের দাবী।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন।

আজ বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদন, খাদ্য, পুষ্টি, জন স্বাস্থ্য, প্রাণবৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন তথা সার্বিক পরিবেশের যে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় একই অবস্থায়, পড়েছিলো মধ্য আমেরিকার দেশ কিউবা ১৯৮৯ সালে যখন রাশিয়ান ফেডারেশন ভেঙ্গে যায়। আধুনিক কৃষি চর্চার সব রকম যান্ত্রিক ও রাসায়নিক সহায়তার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন কিউবার বিজ্ঞানীরা বসে ঠিক করলেন যে তারা প্রাকৃতিক/জৈব কৃষির মাধ্যমে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করবেন। স্মরণ যোগ্য কিউবার ৭০% মানুষ শহরে বাস করেন। তারা শহর ভিত্তিক জৈব কৃষির চর্চা শুরু করলেন। নগর পরিকল্পনায় ভূমি, ছাদসহ সকল খোলা জায়গায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গাছের প্রতিটি পাতায় সূর্যের আলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেন। নগরের বর্জ্যব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কম্পোষ্ট সার তৈরি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেন। পানি সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতি ফোটা পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করলেন। এ পরিকল্পনায় সরকারী, বেসরকারী এবং প্রতিটি নাগরিকের অংশ গ্রহণ নিশিচত করা হয়েছে। জনগণ, ফসল, প্রাণীসম্পদ এবং পরিবেশের বন্ধু সূলভ আন্ত সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। টেকসই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

কিউবার কৃষি বিপ্লোবের মূল-নীতি হচ্ছে অধিকাংশ খাদ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে নগর কৃষি দক্ষতার সাথে স্থানীয় জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করছে। বিজ্ঞান সাধারণ শক্তি হিসাবে জন সাধারণের অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে জন কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার ১১% বিজ্ঞানী কিউবার অধিবাসী। দেশের সঙ্কটের সময় একত্রে পরিবেশ বান্ধব জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নগর কৃষির পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনের পরিকল্পনা করেছেন। খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের মাধ্যমে আরো অনেক সুফল অর্জিত হয়েছে; যেমন- নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত হয়েছে এবং সামাজিক সম্প্রিতী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (Cuban Urban Agriculture as a Strategy for Food Sovereignty)।

কিউবার নগর কৃষির অভিজ্ঞতা সারা দুনিয়ার জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। একই ভাবে বাংলাদেশের জন্য ও অনুসরনীয় হতে পারে। কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে অসংক্রামক রোগ যেমন, ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, হাইপাটেরশন, ক্যান্সার, অস্টিওপোরোসিস, এজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ইত্যাদি দিনে দিনে বাড়ছে। এর প্রধান কারণ খাদ্যে রাসায়নিক দূষণ।

পরিকল্পিত নগর নির্মাণে নগর কৃষি পরিকল্পনায় প্রতি ইঞ্চি ভূমি, মুক্ত আকাশ, সৌরশক্তি, মৌসুমী বৃষ্টি, মুক্ত হাওয়া, দেশজ প্রাণসম্পদ ও জৈব বর্জ্য সম্পদ সঠিক ভাবে ব্যবহার করে মানুষের সৃজনী শক্তি ও বাহুবল কাজে লাগিয়ে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করে অসংক্রামক রোগের ক্রমবর্ধমান গতিরোধ করা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter