চা বাগান শ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম
চা বাগান শ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম সকলের হয়তো জানা নেই। তারা চা শ্রমিক, সারাদিন পরিশ্রম করে ২৩ কেজি চা-পাতা তোলার পর তাদের মজুরী হয় ৬৯ টাকা। এই ২৩ কেজি চা-পাতা তুলতে সকাল নয়টা থেকে দুপুর দু'টা বেজে যায়। সকাল নয়টা থেকে দুপুর দু'টা পর্যন্ত চা বাগান মালিকদের নিয়ম অনুযায়ি চলছে। আবার দুপর দু'টার পর থেকে অনেকে পাঁচটা বা ছয়টা পর্যন্ত প্রতি কেজি চা-পাতা তুললে (তিন) টাকা করে পায়। এই টাকায় কী করে তারা জীবন চালায়?
চা বাগানে চা-পাতা তুলতে নারী শ্রমিকরাই বেশী শ্রম দেয়। পুরুষ শ্রমিকদের চা-পাতা তুলতে খুব কমই দেখা যায়। পুরুষ শ্রমিকরা বেশীর ভাগ সময় চা বাগান পরিস্কার, বিষ ব্যবহার, চকিদারী ও চা ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। চা বাগান শ্রমিকদের দুপুরের প্রধান খাদ্য হল চা-পাতার ভর্তা আর রুটি। শ্রমিকরা সকালে তাদের এই খাবারটি তৈরী করে নিয়ে বাগানের পাশে রেখেই চা পাতা তোলে।
চা শ্রমিকদের সারাদিন রোদ, বৃষ্টি, তুফান তাদের মাথার উপর দিয়ে যায়। তারা বিশ্রাম নেয় শুধুমাত্র দুপুরের খাবার মধ্যে থেকে। বাগান থেকে বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেলে তাদের সময় নষ্ট হয়। আর এই সময় নষ্ট হলে তাদের সেই দিনের মজুরী কম হবে বলে তাই তারা বাসায় যায়না। এই কারনে চা শ্রমিকরা চা বাগানেই তাদের দুপুরের খাবার খায়।
ব্রিটিশরা একশ থেকে দেড়শ বছর আগে এই দেশে চা বাগান এলাকাগুলোতে ভারত বর্ষের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ধর্মের গরিব মানুষদের নিয়ে আসে চা বাগানের কাজের জন্য। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইনের মধ্যে থেকে তারা এখন চা বাগানে কাজ করে আসছে।
চলতি বছর ২০১৬ প্রথম দিকে, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় চা বাগান শ্রমিকরা এক আন্দোলন শুরু করেন সরকারী কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এর কারণ, চুনারুঘাটের চাঁদপুর বেগমখান চা বাগানের শ্রমিকরা শতাধিক বছর ধরে বাগান সংলগ্ন যে ৫১২ একর জমি চাষ করে নিজেদের কিছু অতিরিক্ত আয়ের সংস্থান করে এসেছেন, সে জমিতে স্পেশাল ইকোনমিক জোন বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার কর্তৃক দখল নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।এই জমি সরকার থেকে ইজারা নিয়েছিল চা বাগান কোম্পানি ডানকান, যা আসলে ছিল তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কাজেই সেখানে কিছু না করে ডানকান কোম্পানি তা ফেলে রেখেছিল। এই ফেলে রাখা জমিতে চাঁদপুর বেগমখান চা বাগানের শ্রমিকরা একশ’ বছর ধরে নিজেরা চাষাবাদ করে আসছেন। চা বাগান কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি।
আমরা দেখেছি খবরের কাগজে ও টেলিভিশনে চা বাগান শ্রমিকদের সেই জমি রক্ষার সংগ্রাম ও আত্মচিৎকার। তাদের কাজ থেকে কেন এই জমি নিতে হবে? চা শ্রমিকরা এই জমি দিলে তারা নিঃস্ব হয়ে যাবে। এমনি তরা মরা তাদের কেন আরো মারতে চাও?।
চা বাগান শ্রমিকদের ধান্য জমি রক্ষার আন্দোলনে চাঁদপুর বেগমখানের মানুষ একত্রিত হয়ে এই সংগ্রাম চালিয়ে ছিল। তাদের একটাই দাবী রক্ত দিব জীবন দিব (ধান্য জমি) দিব না। এলাকার মানুষ জমির উপর অবস্থান নেয়। তারা তীর-ধনুক, লাঠি, সড়কি ইত্যাদি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। শ্রমিকদের জমি থেকে হঠানোর জন্য সরকারদলীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকজন সশস্ত্রভাবে শ্রমিকদের আক্রমণ করতে এলে সে সময় শ্রমিকরাও তাদের উপর ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
সরকারদলীয় হুমকি ধামকি খেয়েও চা বাগান শ্রমিকরা তাদের সেই ধান্য জমি থেকে একটুও উঠেন নি। তারা জানে এই জমি তাদের হাত ছাড়া হলে তাদের জীবনে দুঃখ নেমে আসবে। তাই প্রতিদিনই এলাকার শ্রমিকরা মিছিল, সমাবেশ, সভা, মানববন্ধন করেছিলেন, যাতে অংশগ্রহণ করেছিল হাজার হাজার শ্রমিক।
বতর্মান হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বৈকন্ঠপুর চা বাগানে ৯ সপ্তাহ যাবত রেশন মজুরী বন্ধ করেছে চা বাগান মালিক পক্ষ্। বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। ৬ মাস ধরে বন্ধ আছে চিকিৎসা সেবাও। অনেক শ্রমিক বলেছে তারা বর্তমানে প্রায় সময় না খেয়ে থাকতে হয়। এই অবস্থার জন্য চা বাগান মালিকই দায়ি। বৈকুণ্ঠপুর চা বাগানের মালিক চা শ্রমিকদের সাথে আর যোগাযোগ করছেন না। এই বাগানে প্রায় ১১শত থেকে ১২শত চা শ্রমিকের বসবাস। শ্রমিকরা বলছে আমারা কি তাহলে না খেয়ে মারা যাব? এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি মহলের কাছেও কাগজপত্র পেশ করেছে শ্রমিকরা।এখন শ্রমিকরা জানতে চায় তাদের সিদ্ধান্ত কি? তা না হলে শ্রমিকরা আন্দোলনের যাবে। তারা কতদিন আর না খেয়ে থাকবে?
চা বাগান শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য অধিকার দিতে হবে।