বন্যা কৃষকের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়
বাংলাদেশে খরিপ মৌসুমই ফসলের প্রধান মৌসুম। খরিপ মৌসুম গ্রাম বাংলার আউশ আমন ধানের মৌসুম। জুলাই-আগস্ট মাসে আউশ ধান কাটা হয় এবং আমন ধান রোপন করা হয়। এর সঙ্গে আরও থাকে অনেক রকমের শাক-সবজির আবাদ। এ সময় অর্থকরি ফসল পাটও মাঠে থাকে। এসব ফসলকে ঘিরেই থাকে কৃষক পরিবারের স্বপ্ন। এসব ফসলের মধ্যেই থাকে কৃষক পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থিক অগ্রগতি। এ ফসল থেকে একদিকে কৃষকের খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং অপরদিকে অর্থ আয়ের নিশ্চয়তা। এ অর্থ দিয়ে চলে কৃষকের ঈদ-পার্বন, নতুন জামা-কাপড়, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি। কিন্তু বন্যায় যখন এসব ফসলের জমি, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় তখন মাঠের ফসল যেমন ধ্বংস হয় ঠিক তেমনি কৃষক স্বপ্ন বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়-পরিবারের সবার আশা ভঙ্গ হয় এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়।
উল্লেখ থাকে যে, খরা মৌসুমে যখন আমাদের পানি দরকার তখন উজানের দেশগুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়, আমরা তখন খরায় পুড়ি। আর বর্ষায় যখন তাদের পানি অতিরিক্ত হয় তখন উজানের দেশগুলি বাড়তি পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের সবকিছু ভাসিয়ে দেয়।
তারই নজির- চীন, ভারত ও নেপাল থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জুলাই-আগস্ট-২০১৬ মাসে বাংলাদেশর ৩৩ শতাংশ এলাকা পানিতে ভেসে যায়। এসব এলাকার ঘরবাড়ি ফসলী জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার কারণে উত্তর ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের ১৭টি জেলায় বন্যা ভয়াল রূপ ধারণ করে (জেলাগুলো হচ্ছে-কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, কুষ্টিয়া, মন্সীগঞ্জ)। পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরে বন্য পরিস্থিতির অবনতি হয়। এ ছাড়া ঢাকার চারপাশের নদীর পানি বৃদ্ধি পায়।
এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে রোগাক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২২ জন, মারা গেছেন ৪৫ জন।
ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) তথ্য মতে দেশের ১৯টি জেলার ৫৯টি উপজেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত ও ১৫ হাজার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ১ হাজার ৩৪৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৯৩টি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮০ কিমি পাকা রাস্তা এবং ২ হাজার ৫৩৮ কিমি কাঁচা রাস্তা ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় ১৭টি জেলার কি পরিমাণ ফসলি জমির আবাদের ক্ষতি হয়েছে তা এখনো পুরোপুরি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণের পর্যায়ে আছে। তবে ১৭টি জেলার আনুমানিক ৯৪ হাজার ৫৩৬ হেক্টর আবাদি জমি পানির নিচে ডুবে গেছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (মনিটরিং) ড. মোহাম্মদ আবদু হু জানিয়েছেন। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ৭ হাজার ১২৩ হেক্টর জমি, জামালপুরে ৯ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি, টাঙ্গাইলে ১৮ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমি, মানিকগঞ্জে ৭ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে ডুবে গেছে বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে। (যুগান্তর, নয়াদিগন্ত/-১-৪/৮/১৬)।
টাঙ্গাইল বন্যা এলাকা সরেজমিন পরিদশর্নে দেখা যায় টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলা ও বাসাইল উপজেলা ১১ টি ইউনিয়নের আনুমানিক ২১৫-২২৫ টি গ্রাম বন্যার পনিতে প্লাবিত হয়ে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে কোথায় বীজ তলা, কোথাও বোনা আমন ধানের ফসলের মাঠ, কোথাও শাক-সবজির মাঠ, এবং কোন কোন এলাকায় কৃষকের পুকুর ভরা মাছ বন্যার পানির কারণে তলিয়ে যাওয়ায় পুকুর থেকে মাছ ভেসে গেছে। এলাকার লোকজন বন্যার কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারছেনা। যদিও বের হন তখন দেখা গেছে পরনের লুঙ্গি মাথায় বেধে গামছা পড়ে পানিতে ভিজে চলাচল করেন। বন্যায় প্লাবিত এলাকাতে পরিবারের জন্য রান্না-খাওয়া খুবই কষ্ট, কেউ কেউ ঘরের খাটের উপরে আলাদা চুলা/ টিনের চুলা বসিয়ে খুব কষ্টে রান্না করে পরিবারের সদস্যদের তিনবেলা মধ্যে ২ বেলা খাবার যোগাতে পারছেন।
টাঙ্গাইল বন্যা এলাকায় ফসলের ক্ষতির মধ্যে রয়েছে বোনা আমন ধানের মধ্যে চামারা, পাট জাগ, দিঘা, লালঢেপা, সাদা ঢেপা , কার্তিক ঝুল ,ছন্না ভাওইলা এবং অমন ধানের বীজতলা। আউশের মধ্যে ভাতুরীূ, কালামানিক ,শনি, শংকপটি , খাড়াজামরীসহ পাট, তিল , কাওন। চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক বাড়ির আশে-পাশে আলানে-পালানে শাক-সব্জির সব জাংলা পানিতে তলিয়ে গেছে। ডাটা, বেগুন, ঢেড়স ,সিম, আদা, হলুদ, পটল, কাচকলা, লালশাক, ধুন্দল, মরিচ সহ বিভিন্ন ধরনের সব্জী সম্পূর্ন নষ্ট হয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির কারণে কৃষক পাট কাটতে পারছেন না। যেসব জমির পাট কেটে কৃষক জাক দেয়ার জন্য জমিতে রেখেছিলো সেসব বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। গরু , ছাগল , হাঁস-মুরগী নিয়ে কৃষকরা চরম দূর্ভোগে পড়েছে। ইতি মধ্যে এলাকায় গো-খাদ্যের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে। নৌকা ও ভেলায় করে এলাকা থেকে গরু- ছাগল, হাঁস-মুরগী কৃষকেরা অন্য এলাকায় সরিয়ে নিচ্ছে। পানিরস্রোতে নদীর পার ভেঙ্গে অনেক গবাদী হাঁস ও মুরগী পানিতে ভেসে গেছে। বাড়ির আলানে পালানে বিভিন্ন সব্জী এবং পেঁপে সহ বিভিন্ন ফলের গাছ মারা যাচ্ছে। বন্যার পানি যদি আরো ১২-১৫ দিন স্থায়ী হয় তাহলে মাঠের সব রকম ফসল একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলায় ২৭ শে জুলাই ২০১৬ বন্যার পানি প্রবেশ করে। তারপর হু হু করে পানি বাড়তে থাকে। এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এলাকার মানুষ তখন নিজের অস্তিত্ব রাক্ষার তাগিদে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। চিলমারী এলাকায় এমন কোনো গ্রাম ছিলো না সে গ্রাম বন্যার ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। এ এলাকার বিভিন্ন ক্ষতির সাথে সাথে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যেমন- জমিতে পাট কেটে রাখা হয়েছে জাক দেয়ার জন্য, কিন্তু হঠাৎ করে এ বন্যায় সব বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনেক কৃষকের জমিতে পাট রয়েছে যা বন্যার কারণে কাটা সম্ভব হয় নাই। সবেচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে-আউশ ধানের ক্ষেত এবং আমন ধানের বীজ পাতা হয়েছিল, বন্যার পানির নিচে বেশ কিছুদিন হচ্ছে পানির তলায় ডুবে থাকায় জমিতে আর কিছুই নেই। ধান এবং পাট দুটোই শেষ। বসত ভিটা এবং বসত ভিটার আশপাশে যে ক্ষেতে বিভিন্ন সবজি ছিলো সেসব একেবারে নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে। এ এলাকায় কৃষকরা এখন ভীষণ রকম বীজের সমস্যায় রয়েছে কেননা, তাদের হাতে এখন আর কোনো বীজ নেই।
২০১৬ তে বাংলাদেশে বেশ বড় ধরণের বন্যা হয়েছে। এবারের বন্যা বাংলাদেশের ১৯টি জেলাকে আক্রান্ত করেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ১৭টি জেলায়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জাতিয় দৈনিক পত্রিকা গুলোতে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্ম প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, ত্রাণের খবরসহ অন্যান্য সকল খবরই প্রকাশ করেছে। কিন্তু কৃষকের ক্ষেতের ফসলের ক্ষতি সম্পর্কে তেমন কোনো খবরই প্রকাশ করে নাই। যদিও দু’একটি পত্রিকা যৎ সামান্য প্রকাশ করেছে সেটা প্রকাশ না করারই সামিল। এর কারণ কি জানিনা!
বাংলাদেশের মানুষের এখনো জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে কৃষি। এ কথা বন্যা কবলিত এলাকার জন্য আরও ধ্রুব সত্য। বন্যা পরবর্তি বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ যারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন এবং বড়িতে আছেন উভয়- জলবদ্ধতা, ধসে যাওয়া বাড়ি-ঘর মেরামতের সঙ্গে সঙ্গে শস্য বীজের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে দেখা দিয়েছে।
জানা মতে কৃষকের বোনো আমন ধান, আমন ধানের বীজতলা, রোপা আমন ধান, পাট, আউশ ধান, মরিচ, পেঁপে, কলা, লেবুসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকদের অন্যান্য সমস্যা সঙ্গে নতুন করে আবার ক্ষেত করার জন্য শস্য বীজের প্রকট সমস্যার সম্মুখিন হয়েছেন। তাদের হাতে এখন আর শস্য বীজ নেই। যা ছিলো সে সব তারা ক্ষেত করেছিলো এবং সেসব বন্যা ক্ষতি হয়ে গেছে। কৃষকদের আবার উঠে দাঁড়ার জন্য আশু শস্য বীজ সহায়তা করা প্রয়োজন।