এক বর্গ সেন্টিমিটার মাটি তৈরি হতে ২০-১০০০ বছর লাগে
মাটি প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতির তিনটি প্রধান সম্পদ যেমন- বাতাস, পানি ও মাটি। এর মধ্যে মাটি না থাকলে হয়তো পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বই থাকতো না। মাটিতে প্রায় ৪৫% খনিজ পদার্থ, ৫% জৈব পদার্থ, ২০-৩০% বাতাস এবং ২০-৩০% পানি থাকে। মাটি নানা রকম কনিকার মিশ্রণ। এর মধ্যে আছে কঙ্কর, বালু, পলি এবং কাঁদা। গাছ-পালা মাটি থেকে প্রয়োজনীয় ১৭টি পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ১৪টি পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে।
মাটিতে বাস করে নানা রকম জীব-অনুজীব। সারা পৃথিবীতে যে সংখ্যক মানুষ বাস করে তার চেয়ে বেশী অনুজীব আছে এক কাপ মাটিতে। এ সব অনুজীব মাটিতে জীবন ও বেগবান খাদ্য প্রবাহ সৃষ্টি করে। উল্লেখ যোগ্য অনুজীবের মধ্যে আছে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, নিমাটোড, শেওলা ইত্যাদি। যাদের বেশীর ভাগই খালি চোখে দেখা যায় না। অবশ্য কেঁচো, পিপড়া, গুবরে পোকা ইত্যাদি স্বদর্পে জানান দেয় তাদের অবস্থান। ধুলা-বালুর মধ্যে প্রতিনিয়ত এ সব জীব-অনুজীব তাদের জীবন প্রবাহে মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থ ডিকপোজ করে মাটি তৈরি করে। এভাবে এক বর্গ সেন্টিমিটার মাটি তৈরি হতে ২০-১০০০ বছর লাগে।
অনুজীবের এ সমৃদ্ধ প্রাণ বৈচিত্র্য মাটির আর্দ্রতা, পরিতৃপ্তি, গঠন, ঘনত্ব, তথা সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। যখন মাটির বিদ্যমান জীব-অনুজীব ধ্বংস হয় তখন মাটির স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ হয়। মাটিতে বিদ্যমান জীব-অনুজীবের অবস্থানই তার প্রাণবৈচিত্র্য যা মাটির স্বাস্থ্য ও উৎপাদিকা শক্তির উৎস।
তবে মানুষের বেপরোয়া আচরণও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণে মাটির স্বাস্থ্য হানি ঘটছে। রাসায়নিক সার বালাইনাশক, আগাছনাশক ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি এমন রাসায়নিক আগাছানাশক ও বালাইনাশক উদ্ভাবন করা হয়েছে যা শুধু জেনেটিকালি ইনজিনিয়ার্ড ফসল ছাড়া আর সব জৈব সত্বাকে ধ্বংস করে। ধান, ভূট্টা, সয়বিন এবং আরো কিছু ফসলের জাত বাঁচিয়ে রাখা হবে যা নির্বাচিত বালাইনাশক ও আগাছানাশক সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে এ সব ফসল সবল সুস্থ মনে হলেও বাস্তবে তা বেড়ে উঠছে অভাবগ্রস্থ ও ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে। কারণ এর আগেই মাটির প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করা হয়েছে। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে ০.১% বালাইনাশক ক্ষতিকর নিশানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ ধ্বংসের কাজে লাগে বাকি সব মাটি ও পরিবেশ দূষণে চলে যায়।
নাইট্রোজেন মাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। নাইট্রোজেন গাছের গ্রহণ উপযোগী করার জন্য এমোনিয়া অথবা নাইট্রেটে রূপান্তর করতে হয়। এ রূপান্তরের কাজে মাটিতে বিদ্যমান অনুজীব প্রধান ভূমিকা পালন করে। নাইট্রোজেন সারের এ চক্র পূরণের জন্য অনুজীব অপরিহার্য। কিন্তু মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপে মাটির অনুজীব ধ্বংস হয়। মাটির ঘাটতি পূরণের জন্য নাইট্রোজেন সার দেয়া হয়। কিন্তু সে সার ফসলের ব্যবহার উপযোগী করার জন্য প্রয়োজীয় অনুজীব মাটিতে না থাকায় প্রয়োগকৃত সার হয় বাতাসে উড়ে যায় অথবা পানিতে ভেসে যায়। কিন্তু ফসল তা গ্রহণ করতে পারে না। ফলে গাছের ঘাটতি পূরণ হয় না। ঘাটতি থেকেই যায়। ঘাটতি জনিত লক্ষণ প্রকাশ পায়। আরো বেশী পরিমাণ নাইট্রোজেন প্রয়োগ করা হয়। মাটিতে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন বিষের মতো কাজ করে। মাটি দূষণের ফলে সকল অনুজীব মারা যায়। পরিবেশের বোঝা আরো বেড়ে যায়। ফসলে নাইট্রোজেনের চাহিদা অপূর্ণ থেকে যায়।
পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে মাটিতে প্রাণবৈচিত্র্য বিশেষ করে অনুজীবের অনুপস্থিতির কারণে এজমা/হাঁপানি ও এলার্জি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে (www.truth-out.org/news/item/26164-four-ways-industrial-ag-is-destroying-the-roil-and-your-health)। রাসায়নিক কৃষির এই মারাত্মক চক্র থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর প্রাকৃতিক কৃষি বা নয়াকৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। হাতে সময় খুব কম। ইতোমধ্যে আমরা পরিবেশের বিপর্যয়ের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেছি। মাটিতে ৩-৫% জৈব পদার্থ থাকা বাঞ্চনীয়। তবে বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ গড়ে ১% এর কাছাকাছি। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ০.৮% এর নীচে চলে গেলে সে মাটি আর কোন কৃষি কাজের উপযোগী থাকে না।