মানব স্বাস্থ্যের জন্য মাটির সুরক্ষা প্রয়োজন
মাটির মানুষ। মাটিতে বিলিন। তবে স্বাস্থ্য রক্ষা, স্বাভাবিক বৃদ্ধি, জাগতিক যাবতীয় ক্রিয়া কর্ম, সব কিছুতেই মাটির প্রয়োজন। মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজনের উৎস হিসেবে মাটিতে কম পক্ষে ২২টি মৌলিক উপাদান প্রয়োজন। গাছ পালার মাধ্যমে মানুষ এ সব উপাদানের সরবরাহ পায়।
উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে: নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, বোরণ, মলিবডেনাম, ক্লোরিন, ক্রমিয়াম, সেলেনিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, টিন, আয়োডিন, সিলিকন, নিকেল ও লিথিয়াম।
১৯৫০ সালের আগে বাংলাদেশের মাটিতে কোন মৌলিক উপাদনের ঘাটতি ছিল না। তবে উচ্চফলনশীল জাত এবং হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের ফলে মাটিতে মৌলিক উপাদনের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ১৯৮৩ সালের আগ পর্যন্ত কেবল মাত্র নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হতো। কিন্তু এখন সার হিসাবে আরো পাঁচটি উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যেমন: সালফার, জিঙ্ক, বোরণ, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যঙ্গানিজ, কপার এবং ক্যালশিয়াম।
জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ এবং গাছপালার খাদ্য ভান্ডার। মাটিতে কম পক্ষে ২-৩% জৈব পদার্থ থাকা অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশের ৯০% মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ ০.৫-১.০%। সাধারণভাবে জানা যায় যে যদি মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ ০.৮% এর নীচে চলে গেলে সে মাটি আর কোন কৃষি কাজের উপযোগী থাকে না।
নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম প্রাথমিক পুষ্টি। আরো সাতটি মৌলিক উপাদান যেমন: জিঙ্ক, আয়রণ, ম্যঙ্গানিজ, কপার, বোরন, মলিবডেনাম এবং ক্লোরিন গাছপালার বৃদ্ধির জন্য মাটিতে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজন। তবে ঘাটতি হলে অন্য উপাদান যথেষ্ট পরিমাণ থাকলেও গাছ পালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
# আয়রণ: আয়রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুখাদ্য। হেমোগ্লোবিনের অংশ। মানব দেহে অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের মাটিতে আয়রণের ঘাটতি নেই। তবে মানব দেহে আয়রণের ঘাটতি সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে আয়রণের ঘাটতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গ্রাম বাংলায় অনেক গর্ভবতী মাকে পোড়া মাটির হাড়ি অথবা মাটির চুলার পোড়া মাটি চিবিয়ে খেতে দেখা যায়। শরীরে প্রবল আয়রণের ঘাটতি পূরণের ইচ্ছা থেকেই এমন প্রবনতা সৃষ্টি হয়। ঘাটতির মূল কারণ খাদ্য থেকে সামান্য পরিমাণ আয়রণ শরীরে অঙ্গীভুত হয়। গরুর গোশত আয়রনের উত্তম উৎস। দানা শস্য, ডাল, ও শাকসবজি থেকে ও আয়রণ পাওয়া যায়। অবশ্য ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবারের সাথে মিশিয়ে খেলে আয়রণের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। তবে খাবারের সাথে সাথে চা এবং কফি সেবন করলে আয়রণের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।
# জিঙ্ক: জিঙ্ক দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুখাদ্য। শরীর বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, কাটা বা পোড়া ঘা নিরাময়, হাড়ের গঠন, বংশবৃদ্ধি, স্বাদ, গন্ধ, দৃষ্টিশক্তি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করে। মানুষের দৈনিক চাহিদা ৩-১৪ মিলিগ্রাম। গরুর গোশত, মাছ, সামুদ্রিক শেওলা ও মাছ, মিষ্টিকুমড়ার বীজ, সিমের বীজ, ইত্যাদি জিঙ্কের উল্লেখযোগ্য উৎস।
জিঙ্ক ঘাটতি হলে লিউকোমিয়া, হেপাটাইটিস, সিকেলসেল এনিমিয়া রোগ হতে পারে। ঘাটতি হলে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বয়স্কদের চামড়ায় ঘা হয় এবং চুল পড়ে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
# আয়োডিন: আয়োডিনের ঘাটতি হলে ঘ্যাগ বা গলগন্ড রোগ হয়। শুধু মানুষ নয় গরু ছাগলেরও ঘ্যাগ রোগ হয়। সামুদ্রিক শেওলা ও সামুদ্রিক মাছ আয়োডিনের উত্তম উৎস। খাদ্য দৃঢ়করণ আয়োডিনের ঘাটতি পূরণের সহজ উপায়। সাধারণত লবণের সাথে আয়োডিন মিশিয়ে আয়োডিন ঘাটতি পূরণ করা হয়। তবে আয়োডিন মিশ্রিত লবণ ঢাকনাযুক্ত পাত্রে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ আয়োডিন একটি উদায়ী পদার্থ। খোলা পাত্রে রাখলে আয়োডিন বাতাসে উড়ে যায়। আয়োডিন সমৃদ্ধ লবণের পাত্র ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। কারণ তাপে আয়োডিনের গুনাগুণ নষ্ট হয়। একই কারণে রান্না শেষে ঠান্ডা করে খাবারে লবণ দিতে হবে।
# বোরণ: বোরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুখাদ্য। শরীর গঠন ও স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর্থরাইটিস রোগ প্রতিরোধ করে। আপেল, কমলালেবু, খেজুর, শাকসবজি, সয়াবিন, চিনাবাদাম ইত্যাদিতে বোরণ আছে।
# সেলেনিয়াম: সেলেনিয়াম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ঘাটতি হলে কার্ডিয়াক মায়ওপ্যাথি, হেমোলাইটক এনিমিয়া এবং গ্যাসট্রোইনটেসটাইনাল ক্যান্সার হয়। সামুদ্রিক টুনা মাছ, গমের আটার রুটি, সূর্যমুখীর বীজ, ভেড়া ও গরুর গোশত, মুরগীর গোশত, মাসরুম, রাই সরিষা, ডিম, সালমন মাছ, ওটস্, চিংড়ী মাছ, ইত্যাদি সেলেনিয়ামের ভাল উৎস।
জীবন ধারনের জন্য মানুষ যা খায় তার বেশীর ভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে গাছপালার মাধ্যমে মাটি থেকেই আসে। ভূ-উপরি ভাগের মাত্র ২৫% মাটি। তার মাত্র ১০% খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এই সামান্য সম্পদের উপর মানুষ এবং অন্য সকল প্রাণীর জীবন নির্ভরশীল। মাটির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে গাছপালা, জীবজগৎ তথা মানুষের আয়ু বৃদ্ধি ও জীবন ধারণের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব।