চৈত্র সংক্রান্তি ও গর্ভবতি মায়ের সাধভক্ষণ উদযাপন
বাঙ্গালীর হাজার বছরে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে চৈত্রসংক্রান্তি ও অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে বাঙ্গালির জীবনে। একটা বছরের শেষ অর্থাৎ ক্রান্তিলগ্ন আরেকটি বছরের শুরু। যেখানে নেই কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠান। এক কথায় আমরা বাঙ্গালী, বাংলা নববর্ষ। পুরাতন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে নতুনকে বরণ করা নতুন কিছু আশা নিয়ে নতুন বছরে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার আনন্দে নতুন বছরে নতুন কিছু পাওয়ার আশা সবার মনে মনে । আর এই চৈত্র সংক্রান্তির সাথে মানুষের শরীল খাদ্যাভাসের একটা সম্পর্ক আছে। কালের বিবর্তে সেই সংক্রান্তি আজও কিছু কিছু পালন হলেও বাংলা নববর্ষ যেভাবে ঢাক ঢোল বাজিয়ে পালন করে চৈত্র সংক্রান্তি সেভাবে হয়না। তবে এলাকার বয়ষ্ক মায়েরা, দাইমায়েরা যারা কিনা এক সময় চৈত্র সংকান্তি পালন করেছে তারা এখন ও বলেন, আমাদের শরীলকে যদি সুস্থ রাখতে চাই, তাহলে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করা উচিত। কারন এই সংস্কৃতির মধ্যে মানুষের খাদ্যভাসের মাধ্যমে দেহ শাসনের একটা বিষয় জড়িত। তাইতো এবছর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের নন্দলালপুর,হাবাসপুর, চরচাপড়া, সোন্দাহ, বহল্লা এবং শিলাইদহ ইউনিয়নের দ্বাড়িকগ্রাম, নাউথী গ্রামের দাইমা এবং নয়াকৃষির কৃষক মিলে নিজেদের উৎপাদিত চাউল, মুসুর খেসারী, মটর, ছোলা-সহ লাউ পেপে, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, গোল আলু, বেগুন, বিভিন্ন রকম অনাবাদি এবং আবাদি শাক যেমন, কচুশাক, নিমপাতা, সজনে শাক, মিষ্টি আলু শাক, নুন খুড়ে শাক, হেলেঞ্চা, লাউ পাতা শাক, তেলাকুচা শাক, কলমি শাক, লাল শাক, খারকোন শাক, ঢেঁকিশাক, থানকুনি শাক, পিপুলশাক, কলারমোচা, কলার থোড়, ডুমুর ইত্যাদি যে যতটুকু পারে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এবং তারা নিজেরাই প্রত্যেকটা শাক এবং সবজী আলাদা আলাদা ভাবে রান্না করেন। শুধুমাত্র ছোলার ডাউল ভিন্নভাবে রান্না করেন। বাঁকি ডাউল গুলো এক সাথে মিশিয়ে রান্না করেন। তাছাড়াও সব রকম সবজী একত্র করে একটা নিরামিশ সবজী রান্না করেন এবং ডুমুর কলার মোচা, কলার থোড় আলাদা করে ভাজি করেন। একই সাথে প্রত্যেকটা শাক সবজীর গুনের কথা অংশগ্রহণকারীদের মাঝে তুলে ধরেন।
যেমন নিমপাতা খাদ্য হিসাবে ভেজে খাওয়া যায় এটা অনেকেই জানত না এবং এই সময়ে প্রচণ্ড খরার সময় ক্ষুদা মান্দতা, গ্যাষ্টিক, মুখ দিয়ে পানি উঠা ইত্যাদি দুর করে এবং মুখে রুচি ফিরে আসে এবং এ সময় এটা খেলে তাদের সারা বছর রোগ কম হবে বলে তারা মনে করেন। শুধু তাই নয় নিমপাতা ভাজি খেলে পেটে কৃর্মি থাকে না। কচুর শাক খেলে রক্ত পরিষ্কার হবে, চোখ ভাল থাকবে। সজনে শাক খেলে মুখে রুচি আসে, গর্ভবতি মা খেলে তার এবং তার বাচ্চার শরীল পুষ্ঠ হবে এবং বাচ্চার রং ভাল হবে। তাছাড়া কারো শ্বাসকষ্ট হলে সজনে এবং সজনের পাতা ভাজি খেলে অনেক উপকার পায়। মিষ্টি আলুর শাক খেলে মুখে রুচি আসে, নুনখুড়ে শাক খেলে প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ বাড়ে পাশাপাশি মুখে রুচি বাড়ে। হেলেঞ্চা, লাউশাক, লালশাক ইত্যাদিতে ভিটামিন আছে, তেলাকুচা শাক খেলে কারো ডাইবেটিকস রোগ হলে অনেক উপকার দেয়,কলমি শাক খেলে প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ বাড়ে,খারকোন শাক খেলে শরীলের ব্যথা বিষ কমে ও রুচি বাড়ে,কলার মোচা,কলার থোড়,ডুমুরে আয়রন আছে। বিশেষ করে গর্ভবতি মায়ের জন্য এই খাবার গুলো অবশ্যই দরকার। এভাবে প্রত্যেকটা খাবার রান্নার পর টেবিলে সাজিয়ে রেখে দাইমায়েরা বর্ণনা করেন। এবং তারা বলেন আজকের দিনে এই খাবার গুলো খেলে সারা বছরই আমরা খেতে পারব এবং ভাল থাকব। একই সাথে তারা স্থানীয় জাতের ফল যেমন, বেল নোনাফল এসময় খাওয়ার পরামর্শ দেন কারন এগুলো খেলে পেট ও মাথা ঠাণ্ডা থাকে। তাছাড়া মৌসুমী সব ধরনের স্থানীয় ফল, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, জলপাই, আতাফল জাম, লিচু, আম, কাঠাল, তাল, কলা, পেপে, বড়ই খাওয়ার পরামর্শ দেন।
সাধভক্ষণ অনুষ্ঠান পালন
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে দাইমায়েরা গর্ভবতি মায়ের সাধভক্ষণ (সাতোশা) অনুষ্ঠান পালন করেন। কারন তারা মনে করেন এটা একজন গর্ভবতি মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। তারা বলেন, তিন মাস পর্যন্ত মায়ের গর্ভে বাচ্চা রক্তের দলা মত থাকে। পাঁচ মাসে পঞ্চ আত্না হয়। সাত মাসে বাচ্চার শরীলের পূর্নাঙ্গ গঠন শেষ হয় অর্থাৎ একজন পূর্ন মানুষ তৈরী হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এটা এখনও প্রচলিত আছে কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এলাকা বিশেষ বিলুপ্তির পথে। মুরুব্বিদের কাছে রুপকথার গল্পের মত তারা শোনেন। তাই এলাকার মা এবং দাইমায়েরা চাই আজকের এই সাতোশা অনুষ্ঠানের মাধমে প্রত্যেক গর্ভবতি মায়ের সাত মাসে সাতোশা অনষ্ঠান পালন করুক। এটা একজন গর্ভবতি মায়ের সাধ।
গর্ভবতি মায়ের প্রস্তুতি এবং অনাগত সন্তানের আগমন উপলক্ষে এই সাতোশা করা হয়। এ সময় গর্ভবতি মায়ের বাবার বাড়ী থেকে নানা রকম তার পছন্দের খাবার এনে খাওয়াই। পাড়া প্রতিবেশী আত্বীয় সজন ও খাওয়াই। মিষ্টি খেতে হয় এতে মা ও বাচ্চা উভয়েই শরীল ভাল হয় তাছাড়া আট এবং নয় মাসে শরীল বাড়ে খুবই দ্রুত তাই এ সময় যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার দিতে হয় পাশাপাশি এ সময় মায়ের হাসি খুশি থাকতে হয় সব ধরনের খাবার খেতে হয় তাই সাতোশা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মায়ের আনন্দ পাশাপাশি আত্বীয় সজনের আর্শ্বিবাদ নেন মা। এ অনুষ্ঠানে দাইমায়েরা তাদের বাড়ী থেকে কেউ দুধ, কেউ আতব চাউল, কেউ মিষ্টি নিয়ে আসেন। তারা পায়েস রান্না করে একটা বড় থালায় রাখে এবং তারা লক্ষ্য করে যদি পায়েস রাখার পর ফেটে যায় তাহলে মেয়ে হবে আর যদি না ফেটে যায় তাহলে ছেলে হবে বলে মজা করেন।একই সাথে মায়েরা ৪ জন ৭ মাসের গর্ভবতি মাকে নতুন কাপড় পড়িয়ে বসান। এরপর পায়েসের থালা সামনে দিয়ে তাদের কি বাচ্চার আশা তা জিজ্ঞাসা করেন কেউ বলেন,ছেলে কেউ বলে মেয়ে। একটা প্রদীপ রাখেন। প্রদীহলো মেয়ে এবং শিলপুতা হচ্ছে ছেলে । এই হিসাবে যে ছেলের আশা করেন তার কোলে শিল দেন এবং যে মেয়ের আশা করেন তার কোলে প্রদীপ দেন। এর পর সব ধরনের শাক সবজী ডাউল দিয়ে থালা পূর্ন করে তাদের সামনে দেওয়া হয়। (যেহেতু চৈত্র সংক্রান্তি তাই সব নিরামিষ দেওয়া হয় আর বাড়িতে সাধের অনুষ্ঠান করলে মাছ মাংশ, ডিম সবই দিত) তিন জন মা যাদের কোন সন্তান মারা যায়নিই (আহর মা) তারা তাদের মুখে পায়েস তুলে দেন। এবং তাদের কে বলা হয় মন ভরে খেতে। কিছুদুরে তাদের অজানা শিল এবং প্রদীপ আলাদা আলাদা পাত্র দিয়ে ঢেকে রাখা হয় । খাওয়ার পর তারা যে ঢাকনা তুলবে তার কোলে সেই বাচ্চাই আসবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। যদি কেউ প্রদীপ দিয়ে ঢাকা পাত্রটি উঠায় তাহলে তার গর্ভে মেয়ে বাচ্চা আসবে।এভাবে তারা অনেক মজা করেন এবং আনন্দ ্উপভোগ করেন। এ সম্পর্কে গর্ভবতি মা রোজিনা বেগম বলেন,আমার খুবই ভাল লাগছে আজ দাইমাদের,দাইঘরের মাধ্যমে এই সাতোশা সত্যিই বড় আনন্দের।এই সাধ ভক্ষণের মাধ্যমে এলাকার মায়েরা আবার প্রত্যেক গর্ভবতি মায়ের মধ্যে সাত মাসে সাতোশা পালনের ইচ্ছা পালনের ইচ্ছ প্রকাশ করেন।
স্থান: গ্রাম: নন্দলালপুর (দাইঘর) ইঊনিয়ন: নন্দলালপুর। উপজেলা: কুমারখালী জেলা: কুষ্টিয়া। তারিখ: ১৩ই এপ্রিল ২০১৭ বাংলা ৩০ শে চৈত্র ২০২৪। মোট অংশগ্রহণকারী: ১২০ জন।