তাজরীনের আগুনে শ্রমিক মিরাজুল ইসলাম এখন পঙ্গুত্বের শিকার
২৪ নভেম্বর, ২০১২ (শনিবার) তাজরীনে আগুন লাগে ঐ দিন ছিল মহররম মাসের ১০ তারিখ। নয় তলা ভবনের এই তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় নীচতলায় সুতার গোডাউন, দোতলা, তিনতলা এবং চতুর্থ তলায় সুইং সেকশন। ৫ম তলায় ডিজাইন সেকশন। ৬ষ্ঠ তলায় গোডাউন। ৭ম তলায় শ্রমিকদের ক্যান্টিন এবং ৮ম তলায় গোডাউন। কারখানায় প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য তিনটি সিঁড়ি রয়েছে। দক্ষিণ দিকের সিঁড়ি দিয়ে নারী শ্রমিকরা যাতায়াত করে এবং উত্তর দিকের সিঁড়ি দিয়ে পুরুষ শ্রমিকরা ওঠানামা করতো। তৃতীয় সিঁড়িটি জরুরীভাবে বের হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু প্রায় ২০ হাজার বর্গফুটের প্রতিটি ফ্লোর থেকে কর্মরত শ্রমিকদের পক্ষে একটি মাত্র জরুরী সিঁড়ি দিয়ে বের হওয়া সম্ভব নয়। ভবনের পূর্ব এবং পশ্চিম দিক দিয়ে কোন জরুরী সিঁড়ি ছিল না। তাজরীন গার্মেন্ট ছাড়াও তোবা গ্রুপের আরও ১৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই তোবা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন।
তাজরিন কারখাসার আগুনে পুড়ে আহত হয়ে পঙ্গুত্বের শিকার শ্রমিকদের মধ্যে মিরাজুল ইসলাম একজন। মিরাজুল ইসলাম, তাজরীন গার্মেন্ট কারখানার ৫ম তলায় সুইং সেকশনে মেশিন অপারেটর হিসেবে ডিউটি করতো। শ্রমিক মিরাজুল আগুন লাগার দূর্ঘটনার কথা বলছিলেন এভাবে-ঐদিন আমার শরীরটা ভাল ছিল না। ডিউটিতে যাইতে চাইছিলাম না। জোর করে ডিউটি করায়। কাজ করা অবস্থায় এক সময় দেখি বিদ্যূৎ চলে যায়। ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছি শ্রমিকরা। এক সময় দেখি আমাদের ফ্লোরে এক কোনে বড় একটা জানালার ওপরে একজন উঠে জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে। ঐ জানালার ওপরে উঠি এবং ৫তলা থেকে নিচে লাফ দেই এতটুকু মনে আছে আর কিছুই মনে নাই। পরে যা শুনেছি আমাকে প্রথমে সাভার নারী ও শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। ওখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়, ঢাকা মেডিকেল থেকে পঙ্গু হাসপাতানে সবশেষে ট্রমা সেন্টাওে নয়া হয়। ট্রমা সেন্টারে ১ মাস ছিলাম। ট্রমায় ১ মাস চিকিৎসা নেয়ার পর আমাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং আমাকে এমন একটা বিছানা দেয়া হয় ঐ বিছানায় একাধারে ৩ মাস শুয়ে থাকতে হয়েছে। আল্লাহুর রহমতে বর্তমানে মেরুদন্ডের হাড় জোড়া লেগেছে, কিন্তু ডান হাতের অবস্থা এখনও ভাল না। জানি না কোনদিন ভাল হবে কি না। ডান হাতের কব্জির উপরের মাঝখানে ২ ইঞ্চির মত হাড় নাই, ঐ জায়গা ফাঁকা হয়ে গেছে। এতে করে এত ঔষধ এবং এতবার অপারেশন করার পরও ভাল হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ৪ বার অপারেশন করা হয়েছে। প্রথম অপারেশনে ৭টি রড ঢুকানো হয়, ৬ মাস পর আবার অপারেশন করা হয়। এখনো ৪টি রড হাতে ঢুকানো আছে। ডাক্তার বলেছে, যতদিন খালি ঐ জায়গায় হাড় না হয় ততদিন রড ঢুকানো থাকবে এবং পাশাপাশি ঔষধ খাইতে হবে।
বর্তমানে আমার সংসারই চলছে না। সংসারে ১ বছরের একটি সন্তান আছে। আমার শারীরিক এই অবস্থার পর স্ত্রী গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে। এখন সমস্যা হচ্ছে, বাচ্চাকে দেখবে কে এবং আমার পেছনেও একজন লোক লাগে। আমি তো নিজের জন্য কিছুই করতে পারি না। তাছাড়া বর্তমানে টাকার অভাবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিতভাবে ঔষধ কিনে খেতে পারছি না। কেননা স্ত্রীর রোজগারে সংসারই চলছে না। বাচ্চার দুধ কিনতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্য পাই নাই। তাজরীন গার্মেন্টস থেকে ২ মাসের বেতন ছাড়া আর কিছুই পাই নাই। তবে সাহায্য পাওয়ার মধ্যে ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসা খরচ বাবদ বিজিএমইএ ১ লাখ টাকা দিয়েছিল। অথচ আমি সুস্থ থাকা অবস্থায় প্রতি মাসে ১২০০ হাজার টাকা রোজগার করতাম। এখন আমি কিছুই করতে পারি না। আমার পরিচয় এখন পঙ্গু মিরাজুল”।
গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা শ্রমবিকাশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অনেক তথ্য নিয়েছি। আমরা লক্ষ্য করছি কয়েক দিন পর পরই গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লাগছে। এই আগুন লাগানো কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। আগুনে যত না মানুষ মরছে তার চেয়ে বেশি মানুষ মরছে কারখানার গেটে তালা লাগানোর কারণে। কারখানায় আগুনকে দূর্ঘটনা হিসাবে বলা হয় কিন্তু এটা কি শুধুই দূর্ঘটনা?