বৃষ্টির পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ


জলবায়ু পরিবর্তন। বন্যা, ঝড়, তুফান, সাইক্লোন, খরায় পানির অভাবে দিনে দিনে বংলাদেশের মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশ একটি ঘন বসতির দেশ। সাতান্ন হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটি মানুষের বাস। নদী, নালা, খাল, বিল ও জলাশয় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তবে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, শিল্প বর্জ এবং অন্যান্য ভাবে মুক্ত জলাশয়ের পানি মারাত্বক ভাবে বিষাক্ত। অবস্থা দৃষ্ট লালন সাঁইজির গানের কথা মনে পড়ে “ফকির লালন মরলো জল পিপাসায় রে, কাছে থাকতে নদী মেঘনা”।

অন্য দিকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে বংলাদেশের উপকূল প্রান্ত ৫৮০ কিলোমিটার (৩৬০ মাইল) বিস্তৃত জল রাশি। তবে সে জল লবণাক্ত। তাইতো মনে পড়ে The Rime of Ancient Mariners: Water, water everywhere, Nor any drop to drink. (Samul Taylor Coleridge, 1798). পানি, পানিই সর্বত্র তবে এক ফোঁটাও পানি পানযোগ্য নয়।

বেশ কিছু দিন যাবৎ মানুষের পানীয় জলের নির্ভরযোগ্য ভরসা ছিল মাটির তলার পানি। এক সমীক্ষায় (১৯৯৩) দেখা যায় যে মাটির তলার পানি যা পানীয় জলের প্রধান উৎস তার ৯৭% আর্সেনিক বিষে দূষিত। আরো দেখা যায় যে সাতকোটি মানুষ যে পানি পান করেন তার আর্সেনিকের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রহণযোগ্য মাত্রার (১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক/লিটার) চেয়ে বেশী। তিন কোটি মানুষ বাংলাদেশী ষ্টান্ডার্ড (৫০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার) এর চেয়ে বেশী মাত্রায় আর্সেনিক দূষিত পানি পান করেন। এ অবস্থায় বৃষ্টির পানিই হতে পারে পিপাসা মেটানোর প্রধান অবলম্বন। বৃষ্টির পানির চাইতে বিশুদ্ধ কোন পানি নাই। কারণ অন্য যে কোন উৎসের পানি ব্যবহারের আগে বিশুদ্ধ করার জন্য নানা রকম প্রক্রিয়া এবং রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। পক্ষান্তরে সঠিক ভাবে আহরিত এবং সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি অনেক বেশী নিরাপদ।

বাংলাদেশ প্রকৃতির অপরূপ লীলাভুমি। এখানে বারো মাসে ছয় ঋতু। কেবল মাত্র শীতকাল (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) বাদে বাকি পাঁচ ঋতুতেই বৃষ্টি হয়। ১৯০১ সাল থেকে ২০১৫ সালের গড় হিসাবে দেখা যায় সর্বাধিক বৃষ্টি পাত হয় জুলাই মাসে। জুন এবং আগস্ট মাসে সম পরিমাণ। এর পরে মে এবং সেপ্টেম্বর মাসে সমান সমান। এপ্রিল এবং অক্টোবর মাসেও সমান সমান। এ পরে যথাক্রমে মার্চ, নভেম্বর, ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারি। একমাত্র ডিসেম্বরে কোন বৃষ্টি পাত হয় না ।

বৃষ্টির পানি ধরে সংরক্ষণ করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া রান্না, গোসল, কাপড় ধোয়া, টয়লেট এবং বাগানে পানি দেয়া, ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যায়।

মাথা পিছু দৈনিক পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরীকদের অবস্থান বিশ্বে ১৮ তম। গড়ে দৈনিক একজন মানুষ ৫০ লিটার পানি ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশী পানি ব্যবহার করেন। গড়ে একজন মানুষ দৈনিক ৫৮০ লিটার পানি ব্যবহার করেন। এর পরই আছেন অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। দৈনিক ৫০০ লিটার পানি ব্যবহার করেন।

ভারি বৃষ্টিপাত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। উত্তর পশ্চিমের রাজশাহী, অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম। বাৎসরিক গড়ে ১৬০০ মিলিমিটার। অন্যান্য অঞ্চলে বাৎসরিক কমপক্ষে ২০০০ মিলিমিটার। তবে উত্তরপূর্ব অঞ্চলে ৩০০০ মিলিমিটার।

বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য খড়ের ঘর, টিনের ঘর, দালান এমন ভাবে নির্মাণ করা প্রয়োজন যেন চালের/ছাদের পানি নির্দিষ্ট পথে নীচে নেমে আসে এবং সহজে পাত্রে ধারণ করা যায়। ছাদ, চালা, পানি সংগ্রহের পাইপ ইত্যাদি গাছের পাতা, ধুলা- বালু, মশা, মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখা প্রয়োজন। বৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে যে পানি আসে তা সতর্কতার সাথে বাহিরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। পানি সংগ্রহের পাইপ লাইনে মশা, মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় যাতে বংশ বৃদ্ধি করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সস্পূর্ণ সিস্টেম যেমন চালা, ছাদ, পাইপ লাইন, পানি সংরক্ষণের পাত্র (ড্রাম, বোতল) পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের জন্য ৫ বর্গমিটার এরিয়া ছাদ বা চালা প্রয়োজন। এ ছাদের পানি পাত্রে/ ট্রাঙ্কে ধারণ করে পরিবারীটি বাৎসরিক পানির চাহিদা পূরণ হতে পারে। চ্যানেল, পাইপ, কাপ, সকেট, ট্যাপ, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি বাবদ অনুমানিক খরচ হবে আট থেকে দশহাজার টাকা। অবশ্য আমরা সৃষ্টি সুখের আনন্দে হাতের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং ব্যবহার করার নতুন কোন চমকপ্রদ কৌশল আবিষ্কার করতেই পারি।

 


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter