খাদ্য ও পুষ্টির চ্যালেঞ্জ
দানা শস্য বিশেষ করে চাউল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। সাধারণ মানুষের দৈনিক খাদ্য তালিকার প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ চাউল, কিছু শাক সবজি, সামান্য পরিমাণ ডাল এবং সামান্য পরিমাণ মাছ যদি কখনও পাওয়া যায়। দুধ এবং মাংস সামান্য পরিমাণ মাঝে মধ্যে যদি ভাগ্যে জোটে। মৌসুমী ফল আম, কাঁঠাল। কলা ও পেঁপে অবশ্য বার মাসই পাওয়া যায়। ভোজ্য তেল সামান্য পরিমান-শাক সবজি ও মাছ রান্না করতে যেটুকু প্রয়োজন।
মেশিনে ছাটা চালের ভাত। সঙ্গে সামান্য পরিমান শাক সবজি পুষ্টি চাহিদার বিবেচনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তদুপরি রান্নার আগে চাল ধোয়ার ফলে পানিতে দ্রবনীয় খনিজ লবণ, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ( ৪০% থায়ামিন এবং নিয়াসিন) চলে যায়। রান্নার সময় প্রচুর পরিমাণ পানি দিয়ে রান্নার পরে মাড় ফেলে দেয়ার ফলে আরো খাদ্য উপাদানের ঘাটতি হয়। একই ভাবে শাক সবজি কেটে ধোয়ার ফলে এবং উচ্চ তাপে দীর্ঘ সময় রান্নার ফলে ভিটামিন সি এবং বি কমপ্লেক্স নষ্ট হয়।
সাধারণ ভাবে দেখা যায় যে খাদ্য তালিকার প্রায় তিনভাগের দুই ভাগই দানা শস্য। এর পরে রয়েছে সবজি। দানা শস্য ও সবজি মিলে খাদ্যের প্রায় পাঁচ ভাগের চার ভাগ। আমিষ এবং অনুখাদ্য সমৃদ্ধ খাবার যেমন-মাছ, দুধ, ডিম, মাংস, তেল, চর্বি মোট খাদ্যের ১০% এর ও কম।
বাংলাদেশের মা ও শিশুরা মারাত্বক অপুষ্টিতে ভুগছেন। ভিটামিন এ, আয়োডিন, আয়রণ ও জিঙ্কের ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অন্য দিকে আর এক শ্রেণী অধিক ওজনে (অবিসিটি) ভারাক্রান্ত। বার্ডেম (২০১৩)হাসপাতাল এর সুপারিশের মতে একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির খাদ্য তালিকায় দৈনিক ১২৮০ গ্রাম খাদ্য থাকা প্রয়োজন। যার মধ্যে ৪০০ গ্রাম দানা শস্য, ১০০ গ্রাম গোল আলু, ডাল ৫০ গ্রাম ,শাক সবজি ৩০০ গ্রাম, ফল ১০০ গ্রাম, ভেজ্য তেল ৩০ গ্রাম, চিনি/গুড় ২০ গ্রাম এবং মসলা ২০ গ্রাম।
ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলাদেশের মানুষ খাদ্য ও পুষ্টির জন্য চাউলের উপর নিভরশীল। ইরির (১৯৯৩) এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে মাথা পিছু বাৎসরিক চাউলের প্রাপ্যতা ১৪২ কেজি। চাউলের মাধ্যমে শক্তির (কেলোরি) ৭৩% এবং আমিষের ৬৩% পুরণ হয়। চাউলের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার পরিণাম এদেশের মানুষ ঐতিহাসিক ভাবে ভোগ করে আসছে। স্মরণকালে ১৭৭০ সালে (বাংলা ১১৭৬ সাল) ছিয়াত্তরের মনন্তরের প্রধান কারণ ছিল খরা। বাংলার অর্ধেক কৃষক না খেয়ে মারা গিয়েছিলেন। পঞ্চাশের মনন্তরের (বাংলা ১৩৫০, ১৯৪২-৪৩ খৃষ্টাব্দ) অন্যতম কারণ ব্লাষ্ট রোগে ধান ফসলহানী ঘটেছিল এবং তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধবিদ্ধস্থ স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বন্যায় ধান ফসল নষ্ট হওয়ার ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। বন্যা, খরা, রোগ বালাই ইত্যাদির কারণে ধান ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং আধুনিক জাতের ধান ্ও হাইব্রড ধান প্রবর্তনের ফলে ফসল হানীর আশংকা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন চলতি বছর ( ২০১৭ খৃঃ) আগাম বন্যায় সিলেট বিভাগে এবং ব্লাষ্ট রোগে দেশের উত্তর অঞ্চলের ধান ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে চাউলের দাম বেড়ে গিয়েছে।
সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে ঐতিহ্যগত প্রকৃতি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। উফশী ও হাইব্রিড প্রবর্তন করা হয়েছে। রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও সেচ নির্ভর ধান চাষ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্র এখন প্রযুক্তি ও উপকরণ নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটেছে। যাবতীয় উপকরণ যোগান দিতে কৃষক লগ্নি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ বালাই, ইত্যাদির কারণে ফসলহানীর কারণে কৃষক সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছেন। এক দিকে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন অন্য দিকে দেশ খাদ্য ঘাটতির মধ্যে পড়ছে। যেমন ২০১৭ সালে বোরো মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে আগাম বন্যায় এবং উত্তর অঞ্চলে ব্লাষ্ট রোগে বোরো ধানের ফসল হানীর ঘটনা ঘটেছে। ফলে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তেমনি দেশ খাদ্য ঘাটতির ঝুঁকিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর তালিকা মতে এদেশে এখনও ৮৬ টি ফসলের চাষ হয়। এর মধ্যে আছে দানা শস্য, ডাল, শাক সবজি, ফলমূল, মসলা, কন্দাল, শিম, তেল বীজ ইত্যাদি। দানা শস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ধান, গম, ভুট্টা, কাউন, চীনা, যব ইত্যাদি। চাউলের গুরুত্ব বিবেচনায় আবাদী জমির ৮০% ধান চাষে ব্যবহার করা হয়। নদী বিধৌত সমতল ভূমির বোরো, আমন এবং আউশ ধান বন্যার ঝুঁকিতে থাকে। সনাতন কাল থেকেই বর্ষা এবং প্রাক বর্ষায় বাংলাদেশ বন্যার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চলছে। ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য এলাকা ভিত্তিক ধানের জাত নির্বাচন করা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও অবিভক্ত বাংলায় পনের হাজার জাতের ধান ছিল। ষাটের দশকে খাটো কান্ডের ইরি ধান, তার পরে ব্রিধান এবং নব্বইয়ের দশক থেকে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে হাইব্রিড ধান প্রবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট থেকেও হাইব্রিড ধান ছাড় করা হয়েছে।
সংকীর্ণ কৌলিক ভিত্তির উপর নির্মিত এসব উফসী ও হাইব্রিড ধান রোগ বালাই ও পরিবেশ প্রতিকূলতার ক্ষেত্রে খুবই দূর্বল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ধানের দূর্বলতার মাত্রা আরো বাড়ছে। এ নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবেশ প্রতিকুলতা সহনশীল ও রোগ বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ধানের জাত উদ্ভাবনের গুরুত্ব দিতে হবে। অন্য দিকে ফসল বৈচিত্র বাড়াতে হবে। সেচ নির্ভর ধান উৎপাদন করতে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ৪০০০-৫০০০ লিটার পানি প্রয়োজন হয়। অন্য দিকে গম ও ভুট্টার উৎপাদনে অনেক কম পানি প্রয়োজন হয়। ধানের উৎপাদন কমিয়ে গম ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়াতে হবে। ডাল জাতীয় ফসলের চাষ বাড়ালে একদিকে যেমন আমিষের চাহিদা পুরণ হবে অন্য দিকে মাটির উর্বরতা ও বাড়ে। একই সাথে হাঁস, মুরগী, গবাদি পশু ও মাছ চাষ বৃদ্ধি করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে অভিযোজন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
যেমন:
১. প্রতিকূল পরিবেশ ধানসহ সকল ফসলের জাত উদ্ভাবন।
২. টেকসই উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন।
৩. বন্যা ও খরা মোকাবেলার প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
৪. বিভিন্ন ফসলের ঠান্ডা ও তাপ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন।
৫. লবণাক্ত সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন।
৬. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ফসলের জাত উদ্ভাবন।
৭. দূর্যোগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ফসলের উৎপাদন বহুমুখী করণ।
৮. ফসল উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সমন্বয় করে খাদ্যাভাস পরিবর্তন করা।
পুষ্টি বিবেচনায় খাদ্যাভাস পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
দানা শস্য নির্ভর খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যের যে সাতটি উপাদান যেমন, শ্বেতসার, আমিষ, তেল/ চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ, আঁশ ও পানির নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সুষম খাদ্য তালিকা বিবেচনায় রেখে উৎপাদন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। পারিবারিক ভাবে, সামাজিক ভাবে তথা জাতিগত ভাবে খাদ্য সর্বভৌমত্ব অর্জনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।