সবুজের অন্তরে সবল জীবন
সবুজের হাত ধরেই হয়েছে প্রাণী জগতের অগ্রগতি ও বিকাশ। সবুজ কণিকা ক্লোরোফিল উদ্ভবের পর থেকেই বেড়েছে প্রাণ চাঞ্চল্য। প্রচুর্য সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনা। সবুজ কণিকা বা ক্লোরোফিল সৌর শক্তি ব্যবহার করে পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে চিনি উৎপাদন করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং প্রাপ্ত সৌর শক্তির আশি ভাগই গাছপালার মধ্যে ধারণ করছে। মূলত এ শক্তিই জীব জগতের সকল শক্তির উৎস।
ক্লোরোফিল প্রধানত: দু-প্রকারের যেমন: ক্লোরোফিল-এ এবং ক্লোরোফিল-বি। ক্লোরোফিলের আনবিক গঠনে রয়েছে পাঁটটি মৌলিক উপাদান:
ক্লোরোফিল-এ: C55 H72 O5 N4 Mg
ক্লোরোফিল-বি C55 H70 O6 N4 Mg
প্রাণী কোষে বিদ্যমান হেমোগ্লোবিনের সাথে গাছপালার সবুজ কণিকা বা ক্লোরোফিল অণুর সাদৃশ্য রয়েছে। হেমোগ্লোবিন অণুর কেন্দ্রে রয়েছে আয়রণ আর ক্লোরোফিল অণুর কেন্দ্রে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম।
ক্লোরোফিলের যাবতীয় কার্যকলাপ প্রাণী জগতে সকল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার শক্তি যোগায়। তদুপরি বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষা করে। ক্লোরোফিলের উপস্থিতির কারণেই গাছপালা সবুজ। তবে কোনো কোনো প্রজাতি এ কণা থেকে বঞ্চিত। তাই তারা পরগাছা। অন্য সবুজ গাছের ওপরে নির্ভরশীল। যেমন তামাক গাছের শিকড়ে বেড়ে ওঠা অরোব্যাঙ্কি (Orobanche) যা কুষ্টিয়ার স্থানীয় ভাষায় মূলা নামে পরিচিত।
ক্লোরোফিলের মধ্যেই সালোক সংশ্লেষণ বা ফটোসিনথেসিস ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ক্লোরোফিলের মধ্যে অনেক জারক রস উৎপাদন হয় যা প্রোটিন সিনথেসিস, বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ক্লোরোফিলের মূল উপাদান ম্যাগনেশিয়াম। ম্যাগনেশিয়াম গাছপালার জন্য প্রয়োজনীয় ২৫টি মৌলিক উপাদানের অন্যতম যা গাছপালা শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে। মাটিতে পর্যাপ্ত ম্যাগনেশিয়াম না থাকলে জৈব সারের মাধ্যমে মাটিতে প্রয়োগ করতে হয়। ম্যাগনেশিয়াম ঘাটতি হলে গাছপালা সৌরশক্তি ব্যবহার করে স্বাভাবিক ভাবে সালোক সংশ্লেষণ করতে পারে না। অন্য উপাদান যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম (এন পি কে) যতোই দেয়া হোক গাছ পালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ফলন কমে যায়।
যে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কম সে মাটিতে ম্যাগনেশিয়াম ঘাটতি দেখা যায়। ভারী বর্ষনে মাটি ধুয়ে ম্যাগনেশিয়াম চলে যায়। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের জেলাগুলোতে ম্যাগনেশিয়াম ঘাটতি রয়েছে। মাটিতে কমপক্ষে তিন পি পি এম ম্যাগনেশিয়াম থাকা প্রয়োজন। তবে এ অঞ্চলে মাটিতে ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ দুই পি পি এম এর নীচে। ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কারণে ফসলের উৎপাদন কমে যায় বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টা, গোল আলু ও আখের উৎপাদন লক্ষণীয় ভাবে কমে যায়।
মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৩-৫% থাকা বাঞ্ছনীয়। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে বাংলাদেশের মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ দিনে দিনে কমছে। বর্তমানে গড়ে ১% এর কাছাকাছি। আশংকার বিষয় হচ্ছে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ০.৮% এর নীচে চলে গেলে সে মাটি আর কোনো কৃষি উৎপাদনের উপযোগী থাকে না। এ অবস্থায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৩-৫%এর মধ্যে উন্নয়নের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
ম্যাগনেশিয়াম ঘাটতিতে আক্রান্ত গাছপালার বয়স্ক পাতার শিরা উপশিরার মধ্যবর্তী স্থান ও পাতার মার্জিন হলুদ রং ধারণ করে এবং আস্তে আস্তে রক্ত বেগুনী, লাল অথবা বাদামী রং ধারণ করে। অকালে পাতা ঝড়ে যায়।
ম্যাগনেশিয়াম গাছপালার জন্য যেমন প্রয়োজন প্রাণী জগতের জন্যও তেমনি অপরিহার্য। প্রাণী দেহে তিন শতকের অধিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সাথে ম্যাগনেশিয়াম যুক্ত রয়েছে। ম্যাগনেশিয়াম ডায়াবেটিস, হার্ট এ্যাটাক, রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনীস্টোন, অনিদ্রা, এ্যাজমা, মৃগী, পার্কিনসন, বাত, ডেমনশিয়া (চিত্ত ভ্রম), মাইগ্রোন ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রাথমিক ভাবে শরীরে ম্যাগনেশিয়াম ঘাটতির কিছু সাধারণ লক্ষণ দেয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১। অস্বাভাবিক হৃদকম্পন
২। ক্লান্তি
৩। দূর্বলতা
৪। হতবুদ্ধি
৫। ডায়রিয়া
৬। পেশীর দূর্বলতা
৭। নিম্ন রক্তচাপ
৮। শরীরে অস্বাভাবিক কম্পন
৯। মাথা ঝিম ঝিম করা
১০। ক্ষুধা কমে যাওয়া
১১। অস্থিরতা
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সুবাদে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমছে। ফলে উৎপাদিত ফসলে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। খাদ্য থেকে আমরা শরীরের প্রয়োজনীয় ম্যাগনেশিয়াম পাই না। তাছাড়া কিছু আধুনিক ওষুধ যেমন- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগ, ওরাল কন্ট্রাসেপটিপ (জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি), এন্টিবাইওটিক, এন্টাসিড, ইত্যাদি ব্যবহারের ফলেও শরীরে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন বয়সের মানুষের দৈনিক ম্যাগনশিয়াম চাহিদার একটি তালিকা নিম্নে দেয়া হলো:
ক্রম নং | বয়স (বৎসর) | পুরুষ | নারী |
১ | ১-৩ | ৮০ এম জি | ৮০ এম জি |
২ | ৪-৮ | ১৩০ এম জি | ১৩০ এম জি |
৩ | ৯-১৩ | ২৪০ এম জি | ২৪০ এম জি |
৪ | ১৪-১৮ | ৪১০ এম জি | ৩৬০ এম জি |
৫ | ১৯-৩০ | ৪০০ এম জি | ৩১০ এম জি |
৬ | ৩১-৫০ | ৪২০ এম জি | ৩২০ এম জি |
৭ | ৫১+ | ৪২০ এম জি | ৩২০ এম জি |
সাধারণ খাবারে ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ (এম জি/গ্রাম):
চীনা বাদামে-১.৭৫, গমের রুটি- ১.৩২, গুড়-২.৪২, ব্রুকলি-০.২১, গোল আলু- ০.২০, লেটুস-০.১২, দুধ- (২%) ০.১১, আপেল-০.০৫, গরুর গোশত- ০.২৮, মিষ্টি কুমড়ার বীজ-২.৬১, পালংশাক- ০.৮৭, ডিম-০.৩৯, মাছ- ০.৯৭, কলা-০.২৭, মটরশুটি- ০.৮৬, চাউল-০.৪৪ ইত্যাদি।
ম্যাগনেশিয়াম ঘাটতির আশংকায় আছেন যারা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগা ব্যক্তিরা:
১। যাদের বয়স ৫৫ বছরের উর্দ্ধে।
২। যারা মদ ও কোমল পানীয় সেবনে অভ্যস্ত।
৩। যারা মূত্র বর্ধক ওষুধ সেবন করেন।
৪। লিভারের পীড়ায় আক্রান্ত এবং
৫। পেটের পীড়ায় আক্রান্ত।
পতার রং সবুজ। পৃথিবী সবুজ। সবুজের মূল উৎস ক্লোরোফিল বা সবুজ কণা। গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে সবুজ কণা; গাছপালার সবুজ রং নিশ্চিত করতে মাটিতে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ থাকা বাঞ্ছনীয়। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটিতে উৎপাদিত খাদ্য শস্যের মধ্যেই আছে মানুষের সুস্থ সবল জীবনের চাবিকাঠি।