খাদ্য শৃঙ্খলা সুস্বাস্থ্যের পূর্ব শর্ত
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য একটি বেহেস্তি উপহার। খাদ্য খেতে আনন্দ হয়। শক্তি সঞ্চয় হয়। ক্ষয় পূরণ হয়। এ সবের মূলে রয়েছে খাদ্য হজমের অদৃশ্য অবদান। হজমের ব্যবস্থা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। আমরা যে খাবার খাই তা মুখ থেকে পরিপাক তন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০ ফুট পথ অতিক্রম করে। খাদ্যের এ পথ পরিক্রমায় সময় লাগে প্রায় ২৪ ঘন্টা। বিভিন্ন উপকরণ এ দীর্ঘ পথ চলায় যথাযথ ভূমিকা পালন করে। খাদ্য থেকে পুষ্টি শরীরে যুক্ত হয়। এ প্রক্রিয়ায় জারক রস এবং প্রবায়োটিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জারক রস মূলত: আমিষ যা দেহ অভ্যুন্তরে উৎপাদিত হয় এবং খাদ্য দ্রব্য থেকে পুষ্টি উপাদান শুষে নিতে সহায়তা করে। জারক রস প্রধানত: তিন প্রকার যেমন: প্রটিয়েস, এমাইলেস এবং লিপেস। প্রটিয়েস আমিষ ভেঙ্গে পেপটাইড ও এমাইনো এসিড উৎপাদন করে। এমাইলেস শর্করা ভেঙ্গে চিনিতে রূপান্তর করে শরীরে শুষে নিতে সহায়তা করে। লিপেস চর্বি ভেঙ্গে শরীরে শুষে নিতে সাহায্য করে।
খাদ্য ভালভাবে চিবিয়ে খেলে সহজে হজম হয়। খাদ্য চিবিয়ে খাবার সময় মুখে যে লালা উৎপাদন হয় তার সাথে জারক রস উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয়, লিভার এবং ক্ষুদ্রান্তে জারক রস উপাদিত হয়। জারক রস খাদ্য হজমে সহায়তা করে। শরীরে প্রয়োজনীয় জারক রস উৎপাদন না হলে খাদ্য হজমে বাধা সৃষ্টি হয়।
দেহের অভ্যন্তরে বসবাসকারী উপকারী অনুজীবসমূহ বা প্রবায়োটিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, রক্তে চিনির ভারসাম্য রক্ষা করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, ওজন নিয়ন্ত্রণ করা এবং মন-মেজাজ ভাল রাখতে সহায়তা করে। তা ছাড়া খাদ্য হজমের ক্ষেত্রেও প্রবায়োটিকের ভূমিকা অপরিসীম। প্রবায়োটিক জারক রস উৎপাদন করে। ফলে খাদ্য সহজে হজম হয়, ভিটামিন এবং খনিজ লবণ শুষে নিতে সহায়তা করে।
হজম শক্তি কম মনে হলে খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়। ফল, শাক-সবজি, এবং বাদাম জারক রসের উত্তম উৎস। রান্নার ফলে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান জারক রস নষ্ট হয়ে যায়। তাই যাদের হজম শক্তি কম তারা ফল মূল, শাক সবজি কাঁচা খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।
দুধের চেয়ে দই সহজে হজম হয়। দই অন্য খাবার হজমে সহায়তা করে এবং খাদ্যমানও দুধের চেয়ে বেশি। তেমনি পান্তা ভাত গরম ভাতের চেয়ে সহজে হজম হয় এবং খাদ্যমানও বেশি।
সঠিকভাবে মিশিয়ে খেলে খাদ্য সহজে হজম হয়। শর্করা বা শ্বেতসার এবং আমিষ যেমন, ভাত এবং রুটির সাথে মাছ গোশত না খাওয়াই ভাল। ভাত বা রুটির সাথে শাক সবজি খাওয়া উত্তম। মাছ, গোশত, ডাল জাতীয় খাবারের সাথে খেলে বেশি পুষ্টি পাওয়া যায়। সবজিখিচুড়ি; বেগুন ভাজি + রুটি, ও রুই, কাতলা মাছের মুড়োঘন্ট মিশ্র খাদ্য হিসাবে আদর্শ খাদ্য। আমিষের সাথে শর্করা খাদ্যের অম্লত্ব ক্ষারত্বের চাহিদার ভিন্নতা থাকার ফলে আমিষ ও শর্করা এক সাথে খেলে হজমের সমস্যা হয়।
শাক-সবজি ও ফল এক সাথে খাওয়া উচিৎ নয়। ফল ক্ষুদ্রান্তে না পৌঁছা পর্যন্ত হজম হয় না। ক্ষুদ্রান্তে পৌঁছানোর পথে বাধাগ্রস্থ হলে হজমের ব্যাঘাত ঘটে।
তরমুজ, বাঙ্গি এবং এ জাতীয় অন্যান্য ফল একক খাবার হিসাবে খাওয়া উচিত। আধিক আঁশ সমৃদ্ধ ফল অন্য খাবারের সাথে খেলে ভালভাবে হজম হয় না।
রাতে ঘুমাতে যাবার ২ - ৩ ঘন্টা আগে রাতের খাবার থেতে হবে। মানুষের যেমন বিশ্রামের প্রয়োজন তেমনি পরিপাকতন্ত্রেরও বিশ্রামের প্রয়োজন। দিনে পাঁচবার যেমন সকালে নাস্তা, স্ন্যাক্স, দুপুরের খাবার, বিকালের নাস্তা এবং রাতের খাবারের মধ্যবর্তি সময় শুধু পানি ছাড়া অন্য কোন খাবার খাওয়া উচিৎ নয়। তবে কোমল পানীয় বা প্যাকেটজাত ফলের রস কোন অবস্থায়ই সেবন করা উচিত নয়।
বিশ্বব্যাপি আজ অবিসিটি বা মোটিয়ে যাওয়া একটি মস্ত বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। নানাবিধ অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, অষ্টিওপোরোসিস, হৃদরোগ, এজমা, ক্যানসার, মানষিক বিকৃতি ইত্যাদি মারাত্মক আকার ধারণ করছে। অপুষ্টি, সুসম খাদ্যের অভাব এবং অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও চর্বি সেবনের ফলে পরিস্থিতি ক্রমশ: জটিল হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতনতার কোন বিকল্প নাই। নিয়মিত, পরিমিত এবং সুসম খাদ্য গ্রহণের প্রতি সকলকে উদ্যোগি হতে হবে।