বেশী দিন বাঁচার ইচ্ছা
স্বাস্থ্য রক্ষা এবং তারুন্য বজায় রেখে বেশীদিন বেঁচে থাকা মানুষের অন্যতম প্রাচীন ইচ্ছা। বেশীদিন বেঁচে থাকার লক্ষ্য উন্নত জীবন, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা। স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করা। বংশগতি/ জেনেটিক্স দীর্ঘায়ুতে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। তবে জীবন আচরণ তার চেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘায়ু অর্জনে বংশগতি মাত্র ২৫% অবদান রাখে। বাকি ৭৫% জীবনাচার নির্ভর।
কিছু দেশের মানুষ দীর্ঘ আয়ু এবং সুসাস্থ্য নিয়ে গর্ব করে। আবার অন্যরা হতাশায় ভোগে। রোগ এবং দূর্বল স্বাস্থ্যের কারণে আয়ু কমে যায়। অনেক দেশ নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা অনুসরণ করে গড় আয়ু বৃদ্ধিতে সাফল্য অর্জন করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাদ্য তালিকায় এমন কিছু উপাদান আছে যা দীর্ঘায়ু, ভাল হৃদয় ও সুস্বাস্থ্যের সাথে জড়িত। ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য তালিকা তেমনি একটি আদর্শ উদাহরণ। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে শাক-সবজি ও ফলের ব্যবহার বেশী। রসুন এবং পিঁয়াজ প্রচুর পরিমাণে খাওয়া হয়। বেশীরভাগ ফল তাজা খাওয়া হয়। লেবু জাতীয় ফল ভিটামিন ও খনিজ লবনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। খেজুর ও ডুমুর খাদ্য আঁশের উৎস। ডালিমের মধ্যে খনিজ লবন ও ভিটামিন রয়েছে। বাদাম ও শিম বীজে প্রোটিন, চর্বি, আঁশ, ভিটামিন ও খনিজ লবন রয়েছে। জলপাইয়ে রয়েছে প্রোটিন, চর্বি, আঁশ, ভিটামিন ও খনিজ লবন। টমেটো, গোলআলু ও বেগুন পারকিনসন্স রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। ইতালির দ্বীপ সার্ডিনিয়া এবং গ্রীক দ্বীপ ইকারিয়া পৃথিবীর পাঁচটি চিহ্নিত নীল অঞ্চলের মধ্যে দুটি। একটি নীল অঞ্চল এমন একটি স্থান যেখানে এর বাসিন্দারা অনেক বেশী দিন বেঁচে থাকে। এটি জনগনের বংশগতির জন্য যেমন দায়ী তেমনই ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য এবং জীবন ধারা।
বেশ কয়েকটি গবেষণা রয়েছে যা ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যকে দীর্ঘ জীবনের সাথে যুক্ত করেছে। মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ভূমধ্যসাগরীয় শৈলীর খাদ্যের প্রতি আনুগত্য হৃদরোগ এবং ক্যান্সারসহ সমস্ত কারণ থেকে মৃত্যুর ঝঁকি কমিয়েছে। সুইডিস জনগণের মধ্যে মৃত্যুর সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যের সম্পর্ক দেখা গেছে যে, এ খাদ্য আয়ু বৃদ্ধি করে। হার্ভাড মেডিক্যালের একটি গবেষণায়ও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এই খাবার ধরণ আয়ু বাড়ায়। আশাবাদী মানুষ বেশীদিন বাঁচেন। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর জীবন ধারা, উদ্ভিদসমৃদ্ধ খাদ্য এবং মানসিক চাপ মুক্ত সময় দীর্ঘ জীবনের পূর্ব শর্ত।
একটি জাপানী গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা যত বেশী উদ্ভিদ প্রোটিন (মটরশুটি, বীজ, গোটা শস্য) ব্যবহার করেন তারা তত বেশী সময় বেঁচে থাকেন। মাছ এবং সামুদ্রিক খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।
যুক্তরাজ্যে ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা প্রতি রাতে ছয় (৬) ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের ৬৫ বছর বয়সের আগে মারা যাওয়ার আশংকা ১২% বেশী। এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, যারা নয় ঘন্টা বিশ্রাম নিয়েছিল তাদের তাড়াতাড়ি মারা যাবার আশংকা ৩০% বেশী ছিল।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে একাকিত্ব মানুষকে হত্যা করতে পারে। সুস্থ্য সামাজিক জীবন মানসিক চাপ কমায়। কেবল শারীরিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও সুস্থ রাখে।
ভাল বন্ধু থাকা দীর্ঘ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক। সার্ডিনিয়া (ইতালী) এবং ওকিনাওয়া (জাপান) দ্বীপের মানুষ এমন ভাবে তাদের জীবন গড়ে তুলছে, যেন প্রয়োজনীয় ব্যায়ম স্বাভাবিক ভাবেই আসে। তারা সাইকেল চালায় যেখানে তাদের যেতে হয়। তারা বাগান করে। পারিবারিক অন্যদের যতœ নেয়। প্রতিদিন কিছু করার অভ্যাস, সামাজিকতা, মন, ও শরীর ব্যবহার করা ভাল, বয়স যাই হোক না কেন। হোটেলের খাবার বন্ধ করে বাড়ীতে রান্ন করতে হবে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা দেখা গেছে যে, যারা বাড়িতে রান্না করা খাবার খায় তাদের অতিরিক্ত দশ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৪৭% বেশী।
প্রযুক্তির অগ্রগতি, স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বিশ্বব্যাপি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আয়ু ৬ বছর বেশী বেড়েছে। ২০০০ সালে ৬৬.৮ থেকে ২০১৯ সালে ৭৩.৪ বছর।
বাংলাদেশসহ কিছু দেশের পরিসংখ্যান নিচের ছকে দেয়া হলো:
দেশের নাম | গড় আয়ু (বছর) |
জাপান | ৮৪.৩ |
বাংলাদেশ | ৭৪.৩ |
ভারত | ৭০.৮ |
পাকিস্তান | ৬৫.৬ |
মায়ানমার | ৬৯.১ |
সৌদিআরব | ৭৪.৩ |
উৎস: বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ২০১৯
সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের পথে আমাদের যা অনুসরণ করতে হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১। তাজা ফল ও সবজি ব্যবহার করতে হবে।
২। ব্যাথানাশক ওষুধ ব্যবহার না করাই ভাল। অপরিহার্য হলে সর্বনি¤œ সময়ের জন্য সর্বনি¤œ ডোজ ব্যবহার করা যাবে।
৩। নিয়মিত ঘুমের সময় সূচী মেনে চলতে হবে। রাতে ৬ ঘন্টা ঘুমান।
৪। পাকা ফলে স্বাস্থ্য সুবিধা এবং দীর্ঘায়িত জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে।
৫। চিনিযুক্ত খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
৬। ভিটামিন-ডি, সূর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়, অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। তবে খুব বেশী ভিটামিন-ডি মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়।
৭।চা/কফি’তে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহহায়তা করে।
৮। কাজ থেকে নির্দিষ্ট সময় অবকাশ না নেওয়া ক্ষতিকর হতে পারে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৯। মসলা খনিজ লবনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তবে উচ্চ তাপে রান্নার ফলে অনেক উপাদান নষ্ট হয়ে যায়।
১০। চর্বিমুক্ত দুধ ও দই সেবন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
১১। পরিমিত পানি পান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
১২। শাক-সবজি নির্ভর খাদ্য তালিকা মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়।
১৩। ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য যেমনÑ ফল, সবজি, জলপাই তৈল, মাছ স্বাস্থ্যকর এবং আয়ু দ্ধৃদ্ধি করে।
১৪। কম পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ রক্ত চাপ, কোলেস্টেরল এবং ইসস্যুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে।
১৫। পোষা প্রাণীর মালিকানা উদ্বেগ হ্রাস করে, রক্তচাপ কমায় এমন কি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।
১৬। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচবার এক মুঠো বাদাম খাওয়া হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
১৭। হাসি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। ব্যায়েমের মতো রক্তনালীতে হাসির প্রভাব রয়েছে।
১৮। একাকীত্ব মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। রক্তচাপ বাড়ে, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সুসম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু ঝুঁকি ৫৩% কম।
১৯। বই পড়ার অভ্যাস মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেয়।
২০। অস্বাভাবিক উপষর্গ যেমন-ওজন হ্রাস, জ্বর, চরমক্লান্তি, অন্ত্র বা মূত্রাশয় অভ্যাস পরিবর্তন বা রক্তপাত রোগের সংকেত দিতে পারে। অপেক্ষা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরী।
২১। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালযৈর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, লিফ্েেটর পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করলে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ১৫% কমে যায়।
২২। সুস্থ্য জীবনের উত্তম অভ্যাস নিয়মিত ব্যায়াম। ব্যায়াম মানুষের মস্তিস্ক, হৃদয়, ত্বক, মেজাজ ও বিপাককে উপকৃত করে।
২৩। অলসতা মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়। ২০১৬ সালের একটি ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে যে, দিনে সাত ঘন্টা বা তার বেশী সময় বসে থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০% বেড়ে যায়।
২৪। আমরা যা খাই তার অর্ধেক বা তার বেশী মৃত খাবার। মৃত খাবারে তেমন পুষ্টি থাকে না। পরিশোধন প্রক্রিয়ায় এসব খাদ্যের প্রায় সব ভিটামিন, খনিজ লবন এবং আঁশ নষ্ট হয়ে যায়। তাই এগুলো মৃত। মৃত খাদ্য গ্রহণের ফলে আমাদের অসুস্থ এবং মোটা করে তুলছে।
২৫। আদর্শ খাদ্য তালিকায় ৫০% শাক-সবজি ও ফল, ২৫% শস্য এবং ২৫% মাছ, মুরগি বা মাংস হলে ভাল হয়।
২৬। আতব চালের পরিবর্তে সেদ্ধ চাল খান। কলে ছাঁটার চেয়ে ঢেকি ছাঁটা চাল ভাল। সাদা চালের চেয়ে লাল চাল ভাল। ভাত রান্নার সময়বেশী পানি দিয়ে রান্না করে মাড় ফেলে দেয়ার চেয়ে বসা ভাত রান্না করুন। ফাস্ট ফুডের চেয়ে কাঁচা মরিচ, রসুন ও পিয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খান। চিকন চালের চেয়ে মোটা চাল ভাল।
২৭। ডিম ভাজা ও ডিম পোজ এর চেয়ে সেদ্ধ ডিম ভাল।
২৮। তামাকÑ ধোঁয়াযুক্ত অথবা ধোঁয়া বিহীন, উভয়ই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
২৯। ফ্রিজের ঠান্ডা পানির চেয়ে স্বাভাবিক তাপ মাত্রার পানি স্বাস্থ্যকর।
৩০। তথাকথিত কোমল পানীয়র চেয়ে ডাবের পানি ভাল।
৩১। খাদ্য ও পানীয় সংরক্ষণ ও সেবনের জন্য প্লাস্টিক, এনামেল ও পলিথিনের চেয়ে কাঁচ, সিরামিক এমন কি মৃৎ পাত্রও ভাল।
৩২। আইসক্রিমের চেয়ে টক দই ভাল।
৩৩। প্রতিদিন কমপক্ষে আধাঘন্টা (৩০মিনিট) শারীরিক প্ররিশ্রম করা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।