আউশ ধানের চাষ বাড়াতে হবে


বাংলাদেশের তিনটি কৃষি মৌসুম। যেমন: রবি (নভেম্বর-এপ্রিল), খরিফ-১ (এপ্রিল-জুলাই) এবং খরিফ-২ (জুলাই-নভেম্বর)। এই তিন মৌসুমে তিন প্রকার ধানের আবাদ হয়। রবি মৌসুমে বোরো ধান। খরিফ-১ মৌসুমে আউশ ধান । খরিফ-২ মৌসুমে আমন ধান। সনাতন কাল থেকে এদেশের পরিবেশের সাথে মিল রেখে আমন ধান ছিল প্রধান ফসল। এর পরে ছিল বৃষ্টি নির্ভর আউশ ধান। দেশের উত্তর পূর্বে হাওর অঞ্চল, মধ্য ও দক্ষিণের কিছু নিচু জায়গায় সীমিত পরিসরে বোরো ধানের আবাদ ছিল। সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে এদেশে ইরি ধানের চাষ শুরু হয়। ইরি-৮ জাতটি ছিল রবি মৌসুমের ধান। শুকনো মাটিতে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচ, সার ও বালাইনাশক দিয়ে ধানের চাষ শুরু হয়। সেচযুক্ত বোরো ধানের উচ্চ ফলনে কৃষকরা উৎসাহিত হয়। আউশ ধানের আবাদ ক্রমে ক্রমে কমতে থাকে। এর পিছনের অন্যতম প্রধান কারণ যখন আউশ ধানের বীজ বপন/রোপন সময় হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে তখন মাঠ জুড়ে বোরো ধান থাকে। কৃষকরা আউশ ধান চাষের জন্য ঠিক সময় বপন/রোপনের জন্য মুক্ত জমি পাচ্ছেন না।

আউশ ধানের উৎপাদন বোরোর তুলনায় কিছুটা কম। তথাপি আউশ ধানকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ আউশ ধান চাষের জন্য সেচ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্থানীয় জাতের আউশ ধানের জাত যেমন- ভইরা, কালা মানিক, শঙ্কপটি, সাইটা, শনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর উদ্ভাবিত জাতের চেয়ে বৃষ্টি নির্ভর আবাদে বেশি ফলন দেয়। এছাড়া আরও দেখা যায় যে স্থানীয় আউশ ধানের জাতগুলি ভালভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে পারে। ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ (সিসিডিবি) রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় খরা অবস্থায় আউশ ধানের একটি পরীক্ষা পরিচালনা করে। এ অনুসন্ধানে ভইরা, কালা মানিক, এবং শঙ্কপটী হেক্টর প্রতি ৪.১ টন ধান ফলন দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ছাড় করা ব্রিধান-২৬ হেক্টর প্রতি ৩টন ফলন দিয়েছে। ব্রিধান-৪৮ এবং ব্রিধান-৫৫ সেচ ছাড়া হেক্টর প্রতি ২ টন ফলন দিয়েছে (ঢাকা ট্রিবিউন ৯ অক্টোবর ২০১৬)।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃপক্ষের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০০৮ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৬৪ ফুট গভীরে। পাঁচ বছর পরে তা ৯৭ ফুট গভীরে নেমে এসেছে। স্থানীয় বোরো ধান চাষীদের তথ্য থেকে জানা যায় ১৫ বছর আগে পানির স্তর ছিল ৪০ ফুট গভীরে যা এখন ১৬০ ফুট গভীরে নেমে গেছে।

উবিনীগের একটি গবেষণায় বৃষ্টি নির্ভর পরিবেশে চারটি জেলা: চাপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, নাটোর এবং কক্সবাজার জেলায় নয়টি আউশ ধানের কৃষক পর্যায়ে তিনবছর (২০১১-২০১৩) ফলন পরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। এ পরীক্ষায় আউশ ধানের স্থানীয় জাত শঙ্কপটী ধান হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ গড় ধান ফলন দেয় (৪.৩৬) টন। এর পরে

ফলন দেয় কালা মানিক (৩.৪২৩ টন),

মুলকে আউশ (৩.৪১৬ টন),

ভইরা (৩.৪১৩ টন),

কালা বকরি (৩.৩৮৮ টন),

সাইটা (৩.৩৮৪ টন),

শনি (৩.২৯৪ টন),

খড়াজামরি (৩.২০৫ টন) এবং

ভাতুরি (৩.১০২ টন)।

পাবনা, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, ও কক্সবাজার জেলার নয়াকৃষির কৃষকরা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় অন্যান্য কৃষকরা বৃষ্টি নির্ভর পরিবেশে শংঙ্কপটীর আবাদ চালিয়ে আসছেন।

ফসল উৎপাদনের জন্য পানি সেচ বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল বিষয়। মোট বৃষ্টি পাতের প্রায় ৯৬% এপ্রিল অক্টোবর মাসে পাওয়া যায়। বাকি সময় প্রায় বৃষ্টিহীন। নভেম্বরÑএপ্রিল ছয় মাস বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গায় খরা বিরাজ করে। এ খরার সময়ই বোরো ধান চাষ হয়। অতএব বোরো ধান সম্পূর্ণ সেচ নির্ভর।

ভূগর্ভস্থ পানিই সেচের প্রধান উৎস। মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। অব্যাহত ভাবে এ অবস্থা চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুতরাং সেচ নির্ভর বোরো ধানের আবাদ কমিয়ে বৃষ্টি নির্ভর আউশ ধানের চাষ বাড়াতে হবে।

 

 

 


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter