মাটি সংরক্ষণ কেন ?
খোলা জায়গায় আমাদের পায়ের তলায় যে নরম স্তর রয়েছে, যার উপরে আমরা তথা মানব সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে তাই মাটি। মাটিতে বীজ গজায়। গাছপালা জন্মায়। ফসল ফলে।
খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়ু এবং পানি দ্বারা মাটি গঠিত। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় শিলা পাথর ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে মাটি সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির সূচনা থেকে জীব-অণুজীবের হাজার হাজার বছরের অবদানে মাটি মানব জাতির জন্য বেহেস্তি উপহার হিসেবে এসেছে। মাটি গাছপালা ধারণ করে। পুষ্টির যোগান দেয়। গাছপালার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ২০টি মৌলিক উপাদানের মধ্যে ১৭টিই মাটি সরবরাহ করে।
মাটি থেকে পাওয়া যায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনিশিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, কপার, বোরন, জিঙ্ক, ক্লোরিন, সোডিয়াম, কোবাল্ট, ভ্যানাডিয়াম, এবং সিলিকন।
পানি থেকে পাওয়া যায় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। বায়ু থেকে পাওয়া যায় কার্বন।
এ সবের মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং সালফার প্রোটিন তথা প্রোটোপ্লাজম গঠনে অপরিহার্য।
মাটির কণা:
মাটি একটি মিশ্র পদার্থ। খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়ু ও পানি দ্বারা মাটি গঠিত। মাটির কণা প্রধানত: ৪ প্রকার: বালি, সিল্ট (পলি), কাদা (এঁটেলমাটি) এবং দোআঁশ।
বালি: মাটির কণার ব্যাস ০.০২ থেকে ২ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। বালি মাটি, ৭০% এর বেশী বালি ধারণকারী মাটি।
পলি: মাটি কণার ব্যাস ০.০০২ থেকে ০.০২ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। পলিমাটি ৮০% এর বেশী পলিযুক্ত মাটি।
কাদা (এঁটেলমাটি): মাটি কণার ব্যাস ০.০০২ মিলিমিটার এর কম। ৮০% এর বেশী কাদা কণা ধারণকারী মাটি।
দোআঁশ: বালি, পলি এবং কাদামাটির মধ্যবর্তী মিশ্রণ। দোআঁশ মাটি ফসল ফলানোর জন্য সবচেয়ে অনুকূল জমিন।
এই সাধারণ ৪ শ্রেণী ছাড়াও মাটি আসলে বারোটি শ্রেণীতে বিভক্ত:
১। বালি, ২. দোআঁশ-বালি, ৩। বেলে দোআঁশ, ৪। দোআঁশ, ৫। এঁটেল, ৬। পলিদোআঁশ, ৭। বেলেএঁটেল দোআঁশ, ৮। এঁটেল দোআঁশ, ৯। পলি এঁটেল দোআঁশ, ১০। বেলে এঁটেল, ১১। পলি এঁটেল এবং ১২। এঁটেল।
মাটির জৈব পদার্থ: জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। জল ধারণ ক্ষমতা, স্থিতিশলতা, অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতা, ও জীব-অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জৈব পদার্থ মাটির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্যকর মাটি মানব জাতির খাদ্য ব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করে। স্বাস্থ্যকর মাটিতে স্বাস্থ্যকর ফসল ফলে যা মানুষকে পুষ্ট করে। গাছপালা দুইটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে পুষ্টি গ্রহণ করেÑ জৈব পদার্থ এবং খনিজ পদার্থ। জৈব পদার্থে এমন এমন উদ্ভিদ বা প্রাণী উপাদান রয়েছে যা আবার মাটিতে ফিরে আসে। মাটিতে বসবাসরত প্রাণীদের পুষ্টি এবং বাসস্থান প্রদানের পাশাপাশি, জৈব পদার্থ মাটির কণাগুলিকে সমষ্টিতে আবদ্ধ করে। মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। মাটিতে ৩-৫% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে গেছে। এখন অধিকাংশ স্থানে ১% এর কিছু বেশী। জৈব পদার্থের পরিমাণ মাটিতে ০.৮% এর নীচে চলে গেলে সে মাটি আর ফসল উৎপাদনের উপযোগী থাকে না। তাই মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এককাট্টা ফসল ধান, গম, ও ভুট্টার আবাদ কমিয়ে অন্যান্য ফসল যেমন ডাল, তৈলবীজ, শাক-সবজি, ফল-মূল, মসলা ইত্যাদির আবাদ বাড়াতে হবে। ফসল চক্রে পরিবর্তন আনতে হবে। মিশ্রফসলের আবাদ বাড়াতে হবে। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, ও মাছ চাষ বাড়াতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মাটির ভূমিকা:
স্বাস্থ্যকর মাটি বায়ু মন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধারণ এবং সংরক্ষণ করে। সবুজ স্থান এবং প্রাকৃতিক এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য পরিবর্তনের সাথে মানুষ এবং প্রকৃতিকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। মাটি একা জলবায়ু পরিবর্তন ঠিক করতে পারে না। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভূমি, কৃষি ও সবুজ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার সাথে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কৌশলের সাথে মাটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেক কিছুই এখনো অজানা রয়ে গেছে। তবে আমরা মাটি এবং জলবায়ূর মধ্যে গতিশীলতাকে যত ভালভাবে বুঝতে পারবো, টেকসই সমাধান এবং বাস্তবায়ন তত ভাল হবে।
মাটির উর্বরতায় অণুজীবের ভূমিকা:
জীব অণুজীব মাটির অপরিহার্য অংশ। মাটির সুস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা মাটির উর্বরতা, গঠন, নিস্কাশণ এবং বায়ু চলাচলে সহায়তা করে। সর্বক্ষণ মাটি গঠন এবং উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
এটা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে এক গ্রাম বিষমুক্ত মাটিতে হাজার হাজার প্রজাতির ১০ মিলিয়ন অণুজীবের আশ্রয় স্থল। (https://bionumber.hms.harvard.edu/bionumber.asprx?s=n&v=O&ID=110152)
তবে রাসায়নিক নির্ভর আধুনিক কৃষি বিস্তারের ফলে আমাদের পায়ের তলার নরম মাটি সরে যাচ্ছে। কৃষি খামার আজ ‘ইনপুট-আউটপুট’ নির্ভর রাসায়নিক কারখানায় পরিণত হয়েছে। ভূমি আজ ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হয়েছে। জমির মালিক জমি চাষ করেন না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বাৎসরিক লিজ হোল্ডার বা বর্গা চাষী জমি চাষ করেন। জমির প্রতি মালিকানার দরদ কারো নাই। মাটিকে মৃত মনে করা হয়।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে মাটি রক্ষা অপরিহার্য। রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক নির্ভর আধুনিক কৃষির পরিবর্তে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর নয়াকৃষি চর্চা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।