বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়


বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী। ভূমিহীন এই মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকাতে বাস করে। এজন্য তাদের জলের জিপসিও বলা হয়। সাপের খেলা দেখানোর জন্যই এরা বেশি জনপ্রিয়। বেদেদের বাদিয়া, বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয়। এই নামগুলোর উৎপত্তি বৈদ্য (চিকিৎসক) থেকে। প্রাচীনকাল থেকেই বেদেরা কবিরাজি, ঝাঁড়ফুঁকসহ বিভিন্ন হাতুড়ে চিকিৎসার সাথে জড়িত। অনেকে অবশ্য দাবী করেন, বেদে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বেদুইন থেকে। আরব বেদুইনদের বেদেরা পরিচয় দেয় নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসেবে।

 বেদেরা ঐতিহ্যগতভাবে নদীতে বসবাস করে, ভ্রমণ করে এবং তাঁদের জীবিকা অর্জন করে, তাই তাঁরা "জল যাযাবর" বা "নদী যাযাবর" নামে পরিচিত। বেদেরা ইউরোপীয় যাযাবরদের অনুরূপ। তাঁরা দল বেঁধে ভ্রমণ করে এবং কখনো এক জায়গায় কয়েক মাসের বেশি থাকে না। কিন্তু এখন বেশীর ভাগ বেদেরা নদীতে থাকতে পারে না। বহু নদী ভরাট হয়ে গেছে। চলাচলে সমস্যা। এখন নদীতে কালভার্ট তৈরী করা, বাঁধ দেয়া, জমি দখল করে ভরাট করার কারণে নদীতে সবসময় পানির প্রবাহ থাকে না।

বেদেদের প্রায় ৯৮% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং প্রায় ৯৫% বেদে শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। ঐতিহাসিকভাবে বেদেরা ভোট দিতে পারতো না কারণ তাঁদের স্থায়ী আবাস ছিল না, একই কারণে তাঁরা ব্যাংক ঋণ বা ক্ষুদ্রঋণের জন্য আবেদনও করতে পারতো না। ২০০৮ সালে বেদেরা বাংলাদেশে ভোটাধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়।

বেদেদের অধিকাংশই সাপ সম্পর্কিত ব্যবসায় জীবনযাপন করে, যেমন সাপ খেলা, সাপ ধরা, সাপ বিক্রি ইত্যাদি। তাঁরা ভাগ্যবতী গুল্ম এবং ভেষজ ওষুধও বিক্রি করে। তাঁরা দাবি করে যে, এতে যাদুকরী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বেদেদের অন্যান্য পেশা হলো বিনোদন পরিষেবা ( যেমন বানর খেলা, জাদু খেলা) এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা। অনেক গ্রামবাসী বেদেদের জাদুকরী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তাঁরা বিশ্বাস করে বেদেরা জাদুকরী ক্ষমতার মাধ্যমে অশুভ আত্মাদের কারও শরীর ত্যাগ করাতে পারে। তাঁদের কেউ কেউ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ভিক্ষাও করে।

অধিকাংশ বেদেদের কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং তাঁরা চিকিৎসা সুবিধা ব্যবহার করে না। তাঁদের অধিকাংশই বাংলা ভাষায় কথা বলে।

 বেদেরা বাঙালিদের সাথে বাংলায় কথা বললেও তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। নিজেদের মধ্যে তারা ঠেট বা ঠার ভাষায় কথা বলে থাকে। বেদেরা অস্ট্রালগোত্রীয়। কিন্তু তাদের ভাষা তিব্বতি-বর্মি (সাক-লুইশ) ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এ ভাষার কোনো লিপি নেই। ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী ঠারভাষী বাংলাদেশি বেদের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।

সমাজকল্যাণ দপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ ভাগ বেদে মুসলিম। বেদেদের ধর্মাচার অবশ্য মিশ্র। অনেকে পীরের অনুসারী, আবার কেউ কেউ মনসা বা বিষহরির ভক্ত। ধর্মে সাধারণত বেদেদের আগ্রহ নেই। হিন্দু দেবদেবীর প্রশস্তি রচনা, বিভিন্ন পার্বণে অংশ নিলেও বেদেরা পূজা অর্চনা করে না। বাঙালি মুসলমানদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বিবাহ মুসলিম ধর্মীয় মতে হলেও বিবাহে বিভিন্ন রীতিনীতি আছে। গোষ্ঠীভেদে এসব রীতিনীতির পার্থক্য দেখা যায়।

বেদে মেয়েরাই প্রধানত কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে যায়। এই মেয়েরা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছুটে বেড়ায়। তাদের আদি সার্বজনীন পেশা হলো কবিরাজি আর ভেষজ ওষুধ বিক্রি করা। এছাড়া ঝাড়ফুঁক, শিঙ্গা লাগানো (কাপিং থেরাপি), ব্যথা দূর করতে গরুর শিং দিয়ে রক্ত টেনে আনা, দাঁতের চিকিৎসা, বানর খেলা, যাদু দেখানো এসব কাজ করে থাকে। গোত্রভেদে কাজের ধরন আলাদা হয়ে থাকে। সাপুড়েরা সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়।

বাংলাদেশের বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, নোয়াখালিতে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের পাওয়া যায়। সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদেদের আবাসের কথাও জানা যায়। ঢাকা সাভারে যে বিশাল প্রান্তিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের মান্তা বলে পরিচয় দেয়। মান্তারা পেশায় মৎস্যজীবী। এদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মাচার বেদেদের মতোই।

দিন বদলের সাথে বেদেদের কাজেও আসছে পরিবর্তন। চুড়ি-ফিতা, খেলনা বিক্রি, ছোটখাট ব্যবসা এসবে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে।

গোলোকায়নের যুগের সাথে বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র ২০০৮ সালে বেদেদের একটি বিশাল অংশকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। নাগরিক অধিকার পেলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার নেই কোনো সুব্যবস্থা। সরকারিভাবে তাদের জন্য বৃত্তি, ভাতা ও প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন ব্যবস্থা থাকলেও বেদেরা শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই নিরক্ষর। সামাজিকভাবেও এরা চরম অবহেলিত। নির্বাচনের সময় ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের সময় হয় না এই উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর কথা ভাবার।

ছবি: সংগৃহীত



Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter