হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে
চিলমারী উত্তর বঙ্গের একটি নামকরা বন্দর। ‘‘হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে”- এই ভাওয়াইয়া গান সকলেরই কম বেশি শোনা। বন্দরের কারণে সবাই না চিনলেও এই গানের কারণে কুড়িগ্রাম জেলার উপজেলা চিলমারী কে না চেনে? এক সময় এই বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নদী পথে ব্যবসা বাণিজ্য চলতো। চিলমারীর দুঃখ কম নয়। আজ তাই চিলমারী সম্পর্কে দুটি কথা তুলে ধরি।
ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে এই বন্দর অবস্থিত। নদী ভাঙ্গনের ফলে চিলমারী বন্দরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গন শুরু হয় ১৯৭০ সাল থেকে। এর আগেও ব্রহ্মপুত্র নদ ভেঙ্গেছে কিন্তু ১৯৭০ সাল থেকে ভাঙ্গন বেশি মাত্রায় শুরু হয়। ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ভাঙ্গন আগে এত মারাত্মক আকার ধারণ করে নি। চিলমারীর যে আদি বন্দর ১৯৭১ সালে তা ভেঙ্গে আরও সাত কিলোমিটার নদের গর্ভে চলে যায়। চিলমারী থানার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ। নয়টি থানা নিয়ে অবস্থিত কুড়িগ্রাম জেলা। এর মধ্যে একটি থানা চিলমারী। চিলমারী বন্দরটি রমনা থানার মধ্যে।
চিলমারী দীর্ঘদিন ধরে গরু-মহিষের জন্য বিখ্যাত। একটি ছোট ইউনিয়ন হওয়া সত্ত্বেও এখানে গরু-মহিষের সংখ্যা বেশি। চাষাবাদ ছাড়াও যানবাহনের প্রধান মাধ্যম এখানে গরু-মহিষ। দশ বছর আগেও গরুর গাড়ি ছিল চিলমারীর প্রধান যানবাহন। যে কোন মালামাল টানা, নতুন বউয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া সব কাজই চলতো গরুর গাড়িতে। এখন গরুর গাড়ি কমে গেছে, পাশাপাশি এসেছে বাস, কোষ্টার, টেম্পু, ভ্যান গাড়ি ও রিক্সা। কিন্তু চর এলাকায় যেতে হলে একমাত্র অবলম্বন নৌকা। চিলমারী বন্দরে ইঞ্জিন চালিত ভাড়া নৌকা সবসময় পাওয়া যায়।
চরের বেশিরভাগ ঘর কাশ বনের তৈরী। ঘরের বেড়াও কাশ বনের। দুই-একটা টিনের ঘর আছে, কারিতাস (বেসরকারী প্রতিষ্ঠান) সংগঠনের মাধ্যমে পেয়েছে। পরিবারগুলোতে বেশিরভাগ একটা করে ছাপড়া ঘর। কেউ কেউ ছাপড়া ঘরের সাথে রান্না এবং খড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছে। এই চরের মানুষ দিনে দুইবার রান্না করে, সকালে ও বিকালে। রান্নার জন্য এখানে খড়ি কিনতে হয় না। ব্রক্ষ্মপুত্র নদ থেকে ছোট ছেলে মেয়েরা এবং বয়স্ক মহিলারা ভেসে যাওয়া কাঠ, খড়ি কুড়িয়ে আনে। শুধু খড়ি নয় কলা গাছ, কচু গাছ এগুলোও তারা নদী থেকে জোগার করে। নদীতে ভেসে আসা গাছগুলো ধরে এনে বাড়ির আশেপাশে লাগিয়ে দেয়। চরে অনেক কাশিয়া (কাশ বন) হয়। অনেক সময় কাশিয়া খড়ির আঁটি করে বাজারে বিক্রিও করে।
চরে বড় গাছ-পালা তেমন নাই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুই একটা শিমুল গাছ দেখা যায়। আর আছে ঢোল কলমি এবং বিচিকলা গাছ। কলা গাছে কলা ধরে না, অনেক লম্বা গাছ হয়। যে চরে কলা গাছ বেশি সেই চরের মানুষদের মনে খুশিও বেশি। বর্ষার সময় এই কলা গাছ তাদের সঙ্গী। কলার ভেলায় নিজেরা থাকে, পরিবারের সদস্য হিসাবে গরুকেও ভেলাতে রাখে। চরে বেশিরভাগ পরিবারে গরু আছে। নিজেরা গরু কিনেছে এমন পরিবার নাই বললেই চলে। এই গরু টাকা দিয়ে কেনা নয়। পরিবারের মহিলারা চিলমারী সদর, উলিপুর (উপজেলা) অথবা কুড়িগ্রামে (জেলা) গিয়ে পরিচিত পরিবারের কাছ থেকে গরু চেয়ে আনে বর্গা বা আধি পালার জন্যে। অথবা ছেলেকে বিয়ে দিয়ে গরু যৌতুক পেয়েছে। তাই পরিবারের মহিলারা বলেন, ‘যার নাই গরু, সেই হয় সরু (চিকন)’।
চরে প্রচুর ঘাস হয়, কাশিয়া হয়। গো-খাদ্যের কোন অসুবিধা হয় না। তবে চরে সাধারণত কেউ ছাগল পালতে চায় না। বন্যার সময় ছাগল পানি সহ্য করতে পারে না। ছাগলের জন্য ঘাস-পাতা পাওয়া যায় না। গরু কাশ বন খেতে পারে কিন্তু ছাগল তা খায় না। মহিষও পালে অনেকে। মহিষের দুধের দই এখানে প্রসিদ্ধ। এখানে একটি চরের নাম আছে “ দই খাওয়ার চর”।
চিলমারী চরের ছোট্ট একটু বর্ণনা দিলাম।