আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও নারী শ্রমিকের কথা
আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি দিন। মার্চ মাসের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে উদ্যাপন করা আরাম্ভ হয় ১৯১০ সাল থেকে। নারী শ্রমিকদের অধিকার অর্জনের ঐতিহাসিক সংগ্রামকে উদ্যাপন করতে এ দিবস পালন করা হয়। এখন ২০১৪ সাল। অর্থাৎ এক’শ চার বছর পরেও নারী এখনও শ্রমশক্তি হিসাবে অবহেলার শিকার এবং সবচেয়ে শোষিত অংশ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস পৃথিবীর সকল নারীদের তথা সকল মানুষের সংগ্রামকে একসুত্রে গাঁথার দিন। সংহতি স্থাপনের দিন। এই দিনটির তাৎপর্য নারী শ্রমিকদের জন্য আরও অনেক বেশী। কারণ আমরা জানি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উৎপত্তি নারী শ্রমিকদের আন্দোলন থেকেই। সে সময় নিম্ন মজুরী, দৈনিক ১৬ ঘন্টা কাজ, শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা, বেতনের বৈষম্য এবং অমানবিক কাজের পরিবেশসহ নানা ধরণের নির্যাতন নারী শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে সহায়তা করেছিল।
দুঃখের বিষয় এখনও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীর প্রতি বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য রয়েই গেছে। নারী শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হয় নাই। বরঞ্চ দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। শিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। নারী শ্রমিক নির্ভর বিকাশমান গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকদের এখনও পরিচয় পত্র সব কারখানায় দেওয়া হয় না। হাজিরা কার্ড, ওভারটাইমের মজুরী, সাপ্তাহিক ছুটি ও বোনাসসহ ন্যূনতম যে সব সুবিধা পাওয়ার কথা তার কিছুই গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকেরা পায় না। দুপুরে খাবার খেতে যে সময়টুকু লাগে মালিকেরা ছুটির পরে সে সময়টুকুতেও শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। কারখানার গেটে তালা মেরে রাখা হয় এখনও।
ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের আইনগত অধিকার। অথচ মালিকের কাছে অপরাধ হিসাবে গণ্য। তাছাড়া নারী শ্রমিকেরা কারখানার অভ্যন্তরে যেমন বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তেমনি বাইরেও তাদের কোন নিরাপত্তা নেই। তবুও সমাজের সকল সনাতন মূল্যবোধ ও পশ্চাৎপদতাকে উপেক্ষা করে নারী আজ বিভিন্ন কলকারখানায় উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। জুট, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, হ্যান্ডলুম, সুগার মিল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও রি-রোলিং মিল, কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, চা বাগান, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, রাবার ও প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি, জুতা ও চামড়া কারখানা, রেল, সড়ক ও জনপথ পরিবহন, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, গ্লাস ফ্যাক্টরি, মোজা ফ্যাক্টরি, রেশম শিল্পসহ আরও শত শত শিল্পে নারী শ্রমিকেরা কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষি কাজ, বাসাবাড়ির কাজ, বাড়ি তৈরীর কাজ ও ইট ভাংগার কাজে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক কাজ করছে। এদের কারোরই অবস্থা ভাল নয়। এদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। তারা সকল ধরণের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এসব নারীদের অনেকেই শ্রমিক হিসাবে এখনও স্বীকৃতি পায়নি। অথচ রাস্তায় বেরুলেই এখন এই নারী শ্রমিকদের দেখা যায়।
নারী নির্যাতন হচ্ছে ঘরে, বাইরে সবখানে। এ লড়াইয়ে তারা যে এগিয়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। নারী তাদের যোগ্যতা দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত নারী শ্রমিকদের যে আর ঘরে আবদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয় তাদের আন্দোলন যে দানা বেঁধে উঠছে এটা বুঝতে পেরে ধনী দেশগুলো তাদের দোসর আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দোষ চাপানোর চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এদেশের শিল্পের সংকোচন ও শ্রমিক ছাঁটায়ের জন্য সব সময় চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে অবাধ আমদানী নীতি প্রবর্তনের জন্য বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অব্যাহত আছে যা দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার ফন্দি।
আট মার্চের উৎস শ্রমিক আন্দোলন থেকে। এখনও শ্রমিক নারীদের প্রশ্নই বড় প্রশ্ন। কারণ এর মধ্যেই আছে পুরো সমাজের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এবারের প্রাতপাদ্য: “অগ্রগতির মূল কথা নারী পুরুষের সমতা”।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে সারা বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজের সুবিধা ও সামাজিক অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করছে। সংগ্রাম গড়ে তুলছে সমান কাজ ও সমান মজুরির জন্য। কারখানার কাজের নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার জন্য। ইউনিয়ন ও দরকষাকষির জন্য। মাতৃত্বকালীন ছুটি ও বেবীক্র্যাশ বাস্তবায়নের জন্য। সকল কাজে নারী পুরুষের বৈষম্য নিরসনের জন্য।
আমরা আশা করবো শ্রমিক নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে এবারের ৮ই মার্চ পালিত হবে। তারা কাজ থেকে ছুটি পাবে। তাদের অধিকারের কথা বলবে সমাজের সব স্তরের নারীদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে।