বিটিবেগুন ও বালাই নাশক


বেগুন আমাদের অতি প্রিয় সবজি। বাংলাদেশ বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থল। হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশে বেগুনের চাষ হচ্ছে। কত রং, আকার, আকৃতি ও স্বাদের বেগুন এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ দেশে এখনও ২৪৮ জাতের বেগুনের সন্ধান পাওয়া যায়। কোন রকম আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই যুগ যুগ ধরে এসব স্থানীয় জাতের বেগুনের আবাদ চলে আসছে। তবে উচ্চ ফলনশীল জাত ও হাইব্রিড বেগুন প্রবর্তনের পর থেকে বেগুনে রোগ বালাই বেড়েছে। তের রকম পোকা, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, মাকড়, শিকড়ে গীট, ভাইরাস ও ফাইটোপ্লাজমা সহ ৩৮টি বালাই দ্বারা বেগুন আক্রান্ত হয়। এ সবের মধ্যে কান্ড ও ফল ছিদ্রকারি পোকার (Leucinodes orbonalis) প্রতি একটু বেশী গুরুত্ব দিয়ে Bacillus thuringiensis ব্যাকটেরিয়ার জিন সংযোজন করে পোকা প্রতিরোধ করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর ভারতীয় শরিক মাহিকো বেগুনের জিন বিকৃতির এ কাজটি করেছে। বলা হচ্ছে কান্ড ও ফল ছিদ্রকারি পোকা বিটি বেগুন গাছের যে কোন অঙ্গের রস খেলে ঠায় মারা যাবে। তবে এ বেগুন খেলে আমার কি হবে তাতো আমি জানি না। 

বাংলাদেশে বেগুন চাষ:

বাংলাদেশে যে ৯৫ রকম সবজি আবাদ হয় তার মধ্যে বেগুন অন্যতম। মোট আবাদি জমির (১৯৩ লক্ষ একরের) ২.৫% অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লক্ষ একর জমিতে সবজির আবাদ হয়। এর মধ্যে ১,১৫,৪২৪ একরে বেগুন চাষ হয় (বিবিএস ২০১০)।

কীটনাশক ও অন্যান্য বালাই নাশক ব্যবহার:

দেশে কোন ফসলে কি পরিমাণ কীটনাশক ও অন্যান্য বালাইনাশক ব্যবহার হয় তার সঠিক হিসাব পৃথকভাবে পাওয়া যায় না। ২০১০ সালে ২১,৪৬৪.৪০ মেট্রিক টন বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে কীটনাশক রয়েছে ১৩,৫৮৫.৪৪ মেট্রিকটন। মোট ব্যবহৃত বালাই নাশকের ১০% সবজি ক্ষেতে ব্যবহার হয় (www.barc.gov.bd/project-com.phb)। বেগুনের ক্ষেতে ৩১৪ মেট্রিকটন কীটনাশক ব্যবহার হয়েছে। কীটনাশক ও অন্যান্য বালাইনাশক মানব স্বাস্থ্য, অন্য সকল প্রাণী, জীব অনুজীবসহ সার্বিক পরিবেশের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর। যথেচ্ছ বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে মারাতœক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ব্যবহৃত ৯৮% কীটনাশক এবং ৯৫% আগাছা নাশক নিশানা প্রজাতির বাইরে অন্য প্রজাতি, বায়ু, পানি, খাদ্য, মাটিসহ পরিবেশের অন্য সকল উপাদানের উপর মারাতœক প্রভাব ফেলছে। আরো জানা যায় যে ব্যবহৃত বালাই নাশকের ১% এরও কম নিশানা প্রজাতির উপর আঘাত করতে পারে। ফসলে ব্যবহৃত বালাইনাশক শেষ পর্যন্ত মাটি, পানি, মাটির তলার পানি তথা সার্বিক পরিবেশ বিষাক্ত করে তোলে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮৩টি সক্রিয় উপাদানসহ ১৩৯১টি ট্রেডনাম সম্বলিত বালাইনাশক বৈধভাবে চালু আছে। তবে ডিডিটি ও হেপ্টাক্লোর সহ ১১টি মারাতœক বালাইনাশক এ দেশে নিষিদ্ধ রয়েছে। নিষিদ্ধ বালাইনাশকগুলির মধ্যে আরো রয়েছে ফসফামিডন, মনোক্রোটোফস, ডায়অলড্রিন, ২.৪.৫. টি ও ক্লোরডেন।

বালাইনাশক সংশ্লিষ্ট আইন:

বাংলাদেশে বালাইনাশকের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত আইন রয়েছে:

১. মারাতœক পোকা ও বালাইনাশক আইন, ১৯৬৬

২. বালাইনাশক অধ্যাদেশ, ১৯৭১

৩. বালাইনাশক আইন, ১৯৮৫

৪. সার (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৯৯

৫. বালাইনাশক অধ্যাদেশ (সংশোধিত), ২০০৭

বালাইনাশক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান থাকলেও তা মানা হয় না, তদুপরি বালাইনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা বিশেষ করে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা:

কৃষকদেরকে রোগ বালাই সহনশীল জাতের ফসল আবাদ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনার যান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেমন আলোর ফাঁদ, ফেরোমোন ফাঁদ, হাতজাল, ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। উদ্ভিদজাত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। বালাই ব্যবস্থাপনার জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা চালু রাখতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর অন্য কোন উপায় না থাকলে সঠিক সময়, উপযুক্ত বালাইনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

আশার কথা সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের ফলে উদানিংকালে বালাইনাশকের ব্যবহার ক্রমেই কমছে। তবে সম্ভাবনাময় সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম উৎসাহিত না করে অন্যভাবে বালাইনাশক ব্যবহার কমাবার কথা বলে জিন বিকৃতির মাধ্যমে স্থানীয় জাতের বেগুনের মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।

জিএম ফসলের অভিজ্ঞতা:

অন্যান্য বিকৃত ফসল (জিএম) যা ইতিপূর্বে বিভিন্ন দেশে ছাড় করা হয়েছে, যেমন-বিটি তুলা, কয়েক বছর আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছাড় করা হয়েছিল। দেখা গেছে কিছুদিন পরে ব্যাপক হারে পোকার আক্রমন বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন কি যে পোকা প্রতিরোধের জন্য জিন বিকৃতি করা হয়েছিল সে পোকারও আক্রমন বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তবে দেখা গিয়েছে জিন বিকৃতির মাধ্যমে সাময়িক অর্জিত ব্যবস্থা কিছু দিনের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়েছে।

বিটি বেগুন না কেন?

বিটি বেগুন জিন বিকৃতির মাধ্যমে বেগুনের প্রতিটি কোষে ক্রিসটাল প্রটিন জিন সংযোজন করা হয়েছে। নাশকতার বিষ প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে পন্নিবেশিত হয়েছে। ছিটিয়ে বিষ প্রয়োগ করলে সে বিষ ধুয়ে পরিস্কার করার সুযোগ থাকে। কিন্তু বিষ যখন প্রতিটি কোষের অংশ তখন তো আর তা বাদ দেবার কোন উপায় থাকে না। তাছাড়া জিন বিকৃতির মাধ্যমে বেগুনে ক্রিসটাল প্রেটিন সংযোজনের ফলে মানব দেহে ক্যান্সারসহ অন্য অন্য যে সব মারাতœক রোগ ব্যাধির আশংকা সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত বিটি বেগুনের উন্মুক্ত চাষাবাদ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter