নয়াকৃষি
স্বস্তি নাই।
আরশিনগর বিদ্যাঘরে বসে লিখছি, সারা উঠান শিমুলের লাল ফুলে ভরে আছে। গাছে গাছে পাখিদের মহোৎসব। আশে পাশের সব জায়গাই তো কীটনাশকে বিষাক্ত হয়ে আছে, নয়াকৃষি বিদ্যাঘরের এই এক টুকরা জায়গা তাদের উল্লাসে ফেটে পড়ছে। কাল থেকে তাই দেখছি, লিখব কি! একেকবার একেকটা পাখি আসে, চিনি কিনা গাছে গাছে দৌড়াতে থাকি; গতকাল সন্ধ্যাবেলা অশ্বত্থের তলায় বাতি আর ধূপধুনার মধ্যেই অদ্ভূত স্বরে ডেকে উঠল পেঁচা। জীবনানন্দীয় কি! এই ডাকটা আগে কান পেতে শোনা হয় নি। নতুন মনে হোল। লুপ্তপ্রায় কেউ কিনা সেই সন্ধানে সকাল থেকে দেশেবিদেশে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
কবিদের কবিতা বুঝতে হলে প্রাণিবিদ্যা বোঝা জরুরী কিনা? জীবনানন্দ পেঁচাকে দিয়ে মৃত্যুসংবাদ – অর্থাৎ প্রতীকে মৃত্যু সংক্রান্ত কী ভাব সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন? নিশাচর সে, তার কায়কারবার রাত্রে। নকটার্নাল হবার সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক নিয়ে খামাখা চিন্তা উসকে দেওয়া কবিতার কাজের মধ্যেই পড়ে। নাকি?
নিশাচর প্রাণিদের শ্রুতি প্রখর, ঘ্রাণশক্ত প্রবল। তো শরীরের এই বিশেষ গুণের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্কটাই বা কি? এক ধরণের পোকা (Helicovera zea) আছে ঠিক এই গুণের কারণে তারা অন্য প্রাণির খাদ্য হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে, মৃত্যুর হাত থেকে সাময়িক অব্যাহতি পায়। সাঁইজী (ফকির লবান শাহ) বলতেন, সাধনা করতে চাও তো নিজের ইন্দ্রিয় সবল করো। কাজটা নাকি শরীরের, বুদ্ধির না। বলতেন, কান দিয়ে শুনতে শেখো। কী শুনব? অন্যের কথা, অন্যের ব্যথা। এটাকেই নাকি শোনা বলে। তো ঘ্রাণ? এটা দ্বারা ভাল মন্দ বিচার করতে হবে। ঘ্রাণ দিয়ে ভাল মন্দ বিচারের কথা আমি ফকির ফ্যাকড়া ছাড়া অন্যদের কাছে শুনি না। তারা হেলিকোভেরা হতে চায়। শরীর এক বিচিত্র যন্ত্র। মৃত্যুপ্রবণ, অথচ একইসঙ্গে ক্ষয়কে পরাস্ত করবার স্বভাব নাকি ওর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ঘ্রাণ, শ্রুতি, মৃত্যু সাধনা , জ্যান্তেমরা এই সবের পারস্পরিক সম্পর্কটা কি আসলে? সাঁইজী তো নাই। কাকে শুধাবো এখন?
নয়াকৃষির বিদ্যাঘরে পাখিদের জন্য গাছে গাছে হাঁড়ি বাঁধা, সেখানে পেঁচার সংসার। দিনের বেলাতেও নির্ভয়ে গট গট করে তাকিয়ে থাকে। রাত্রে ঘরে শুয়ে তাদের দানার আওয়াজ পাই। ডালের ওপর এসে বসে, আর মাঝে মধ্যে তীব্র চিৎকার...
আর শরীরের তুলনায় পেঁচার চোখ অনেক বড়। সেটা কেন? সাঁইজীর ভাষ্য হোল, দেখবার জন্য। সেটা কিভাবে সত্য? পেঁচা তো দিনে দেখেনা বলে শুনি। কিন্তু কথাতো এটাই। দেখা মানেই তো অন্ধকারে দেখা। আলোর সাহায্য ছাড়া দেখবার সাধনা। আলোয় যা আলোকিত সেটা মানুষের দেখা হোল না। আলোর কারিগরী হোল। কেউ কিছু দেখিয়ে দিলে তো আমরা অনায়াসেই দেখতে পারি। কিন্তু যদি চতুর্দিকে দেখিয়ে দেবার কোন আলো না থাকে? দেখিয়ে দেবার কেউ নাই, যা আলোকিত তার বাইরেও অনাবৃত জগত পড়ে আছে, প্রবেশ পথ জানান নাই। তখন নিজের গুণে যে দেখা তাকেই বলে ‘দেখা’।
চতুর্দিকে যখন শুধুই অন্ধকার তখন দেখবার জন্য তাহলে বড় চোখের দরকার হয়ং
নিঃসঙ্গতা? পেঁচা নাকি নিঃসঙ্গ থাকে। প্রাণীবিদ্যা মতে মিলনের সময় আর সন্তান পালন ছাড়া একা একা থাকা -- এটাও নাকি পেঁচার স্বভাব।
এরই মধ্যে প্রায়ই মিয়াজান ফকিরের গানটা মাথার মধ্যে কিড়বিড় করেই চলেছে। আরশিনগরে দৈন্য গানের আসরে প্রায়ই হাশেম গানটি গায়। মিয়াজান সবরি কলা দিয়া তার মুর্শিদকে ভজনা করবে বলে সাধ করেছিল, কিন্তু কলা গাছে থাকতেই বাদুড়ে খেয়ে ফেলেছে। চাকের মধু দিয়া সে মুর্শিদ ভজনা করবে বলে বাসনা করেছিল, কিন্তু সেটা চাকে থাকতেই ভোমরা খেয়ে ফেলেছে। গাভির দুধ দিয়া মুর্শিদ ভজনা করবার ইচ্ছা তার, কিন্তু দুধ বাঁটে থাকতেই বাছুরে খেয়ে ফেলেছে। এখন তার আকুতি – এই যে ডানে বামে তার পাশ ফেরা – একদিকে মুর্শিদের দাবি, অন্যদিকে জীবের অধিকার – সে কোনদিকে যাবে? কার হক আগে? জীবের না পরমের?
কলা তো মুর্শিদের সেবার জন্য পয়দা হয় নি। এটা বাদুড়েরই আহার। মধু তো ভ্রমরের জীবন। সেটা কেড়ে এনে তা দিয়ে মুর্শিদের ভজনা হবে কি? হবে না। মা-গাভির ওলানের দুধ বাছুরের, পরমের নয়। তাহলে সেই দুধে মুর্শিদের সেবা হতে পারে না। ফলে মিয়াজানের আর্তি, ‘দয়াল মুর্শিদরে কি দিয়া ভজিব তোমারে’।
ধর্মের অধিকার আগে? নাকি জীবের? এই হোল সাধকের প্রশ্ন। পরমের দায় আগে নাকি জীবাবস্থার? সাধক ধর্ম অস্বীকার করে শুধু জীবের জীবন চায় না। তাহলে মনুষ্য জীবনের কোন অর্থ নাই। সেটা জীববিজ্ঞান হয়ে যায়। প্রাণিবিদ্যা। মানুষের শরীর ধারণ করে তাহলে লাভ হোল কি? পেঁচার জীবন তুলনায় খারাপ হোতনা মোটেও। অন্যদিকে ধর্মের নামে জীবের জগৎ অস্বীকারও সাধকের ধর্ম নয়। জগত ছাড়া ধর্মের কোন অর্থ নাই। ধর্ম আমরা পরকালে করি না, জগতেই করি। তো পরমের অধিকার আগে, নাকি জীবের? যদি অধিকারের কথা বলি তাহলে জীবের দায় চুকিয়ে না দিয়ে ধর্ম হবে না। বাদুড়কে কলা খাবার অধিকার, বাছুরকে তাদের দুধ পানের অধিকার কিম্বা ভ্রমরকে তার মধুতে অধিকার কায়েম ছাড়া সাধনা হয় না। জীবজীবনের বাইরে পরমার্থিকতা নাই, পরম জীবের মধ্য দিয়েই ভ্রমণ করেন। স্পিরিচুয়ালিটি, আধাত্মিকতা ইত্যাদি বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে যারা সহজ পথের সাধনা করে তারা সহজ ব্যাপার সহজ ভাবেই বোঝে।
সাঁইজি নয়াকৃষির কথা বলে বলতেন, তুমি তো ধর্ম করছোই তো আমাকে কেন দরকার? ধর্ম তো চর্চার মধ্যেই। প্রাণ রক্ষা, প্রাণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ধর্ম চর্চাই। জগত কিম্বা পুরা বিশ্বব্রহ্মান্ডকে তার নিজের ধর্মানুযায়ী বিকশিত হয়ে দেওয়া ইত্যাদি সাধকের সাধনার বাইরের কিছু নয়। একালে ইকলজিকাল মুভমেন্ট নামে অনেক কিছুই আবার ফিরে আসছে। কিন্তু এসেছে পরিবেশ বিপর্যয়ের টেকনলজিকাল সমাধান হিশাবে। গ্রিক-ইংরাজি নামে ভিমরি খেতে হয়। অথচ বাংলার সাধনার জগতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে তার কারিগরি সমাধান খোঁজার আগে বিপর্যয় প্রতিরোধের সাধনা জারি ছিল। টেকনলজির যুগে এটা এখন বুঝি সহজে। সাধনার জগত নয়াকৃষিরই জগত। সহজ পথে গভীর আনন্দে ভ্রমণের পথ এটা। বৈষয়িক জীবন আর ধর্মের জীবনে এখানে কোন ফারাক নাই। অতি সহজ ও সরল ভাবে বোঝা, যে জগতের যার যা জাগতিক প্রাপ্য সেই হক থেকে তাদের বঞ্চিত করা চলে না। তাদের হক আদায় করার নাম নয়াকৃষি।
তাতে কি আর্তি যাবে?
না।
তারপরও সেই খেদ থেকে যাবে: ‘মুর্শিদ, কি দিয়া ভজিব তোমারে? এই ব্যথা এই বেদনা, এই অভাব এই বিরহের মধ্যে কোথাও হয়তো কিছু থেকে যায় অবশিষ্ট আকারে, সেটাই মধুর।
ও আমার মুর্শিদ রে, কি দিয়া ভজিব তোমারে
আমি কি দিয়া ভজিব তোমারে মুর্শিদ কি দিয়া ভজিব তোমারে।।
সবরি কলা দিয়া গো মুর্শিদ ভজিব তোমারে, মুর্শিদ ভজিব তোমারে
সেই কলা গাছে থাকতে আগে খায় বাদুড়ে রে মুর্শিদ
আমি কি দিয়া ভজিব তোমারে।।
গাভির দুগ্ধ দিয়া গো মুর্শিদ ভজিব তোমারে
সেই দুধ দোয়াইতে গেলে আগে খায় বাছুরে রে মুর্শিদ
আমি কি দিয়া ভজিব তোমারে।।
চাকের মধু দিয়াগো মুর্শিদ ভজিব তোমারে, মুর্শিদ ভজিব তোমারে
সেই মধু চাকে থাকতে আগে খায় ভ্রমরে রে, মুর্শিদ
আমি কি দিয়া ভজিব তোমারে।।
মনপ্রাণ দিয়া গো মুর্শিদ ভজিব তোমারে, মুর্শিদ ভজিব তোমারে
মিয়াজান কয় সেই মনটা ডাইনে বামে ঘুরে রে
আমি কি দিয়া ভজিব তোমারে।।
আরশিনগর বিদ্যাঘরে হাশেম।
২৫ ফাল্গুন ১৪২০। ৯ মার্চ ২০১৪। আরশিনগর বিদ্যাঘর।