কুড়িয়ে পাওয়া শাক
ফাল্গুন শেষ হতে চলেছে, চৈত্র আসছে; আসছে শাক খাবার মরসুম।
কিন্তু এটা শহরে পাবার জো নাই। তো ছুটতে হবে রিদয়পুরে, কিম্বা আরশিনগরে। এবার আরশিনগরে গিয়েই বললাম, শাক কুড়াতে যেতে হবে। জামেলা আর জাহেদা তৎক্ষণাৎ খুশি, শাক ছাড়া এই সময় আর কি অন্য কিছু মুখে রোচে?
জাহেদা শাক তুললেন। আলানে পালানে পড়ে থাকা শাক। এরা আপনাতেই হবে, যদি পরিবেশে বিষ না থাকে, আর যদি কেউ নয়াকৃষি করে তো কথা নাই। এক গবেষণায় দেখা গেছে যদি নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় তাহলে মাছে শাকে প্রায় চল্লিশ ভাগ খাদ্য প্রকৃতি এমিনিতেই উৎপন্ন করতে পারে। এই গবেষনার পর ‘অনাবাদি খাদ্য’ আন্তর্জাতিক পরিবেশ রক্ষা ও প্রকৃতি চর্চার আন্দোলনে বিরাট বিষয় হয়ে উঠছে। চাষ করতে হচ্ছে না, অথচ কৃষি ব্যবস্থা নিজের নির্বিষ চর্চার গুনেই অনাবাদী শাক ও দেশীয় জাতের মাছ ইত্যাদি উৎপন্ন করে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অনাবাদি খাদ্যের গুরুত্বের কারনে আধুনিক কৃষির ধারণাও প্রশ্নবোধক হয়ে গিয়েছে। কৃষি করার অর্থ শুধু আবাদি শস্যের জন্য ক্ষেত ব্যবহার ও খাদ্যোৎপাদন না, একই সঙ্গে অনাবাদি ক্ষেত্র সংরক্ষণ ও তার পুনরুৎপাদনও কৃষি। কৃষির অর্থ আবাদি ও অনাবাদি জমি ব্যবস্থাপনা।
আধুনিক কৃষি টেঁকসই না বলে অনাবাদি খাদ্য ও খাদ্যের উৎস ধ্বংস করে। ফলনের হিসাব যখন করে তখন অনাবাদি খাদ্য কী পরিমান সে নষ্ট ও বিষাক্ত করল তার হিসাব নেয় না, পরিমানগত ভাবে একটি ধানের জাত বা ফসলের জাত কি পরিমান উৎপন্ন করল শুধু তার দ্বারা ফলনের হিসাব করে। পুরা কৃষ্যব্যবস্থার ফলনের হিসাব নেয় না। বাংলাদেশের প্রকৃতি ও হাজার বছরের কৃষি ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার কারণে যদি প্রাণসম্মত কৃষি আমাদের প্রয়োজনের চল্লিশ ভাগ খাদ্য আপনাতেই যোগান দিতে পারে, তাহলে ফলন বাড়ানো ও খাদ্য সমস্যা সমাধানের তো এটাই উপায়। কৃষিকে ‘আধুনিক’ করতে গিয়ে যদি চল্লিশ ভাগ অনাবাদী খাদ্য আমরা আগেই নষ্ট ও বিষাক্ত করে ফেলি তাহলে খাবো কি? আর ‘খাদ্য’ তো শুধু মানুষের জন্য না, গরু ছাগল হাঁস মুর্গি, মাছ, জীব অণুজীব – বুনো কিম্বা গৃহপালিত সকল প্রাণীরই খাদ্য ব্যবস্থার নিশ্চয়তা চাই।
অনাবাদি শাক তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। চৈত্রে গ্রামে মেয়েরা কতো জাত আর প্রকারের এই শাক আলানে পালানে পাওয়া যায় তার দ্বারা কৃষি ব্যবস্থার ভালমন্দ বিচার করে। এটা কৃষি ব্যবস্থার স্বাস্থ্য পরীক্ষার মানদণ্ডও বটে।
স্বাস্থ্য আর পুষ্টির কথা যদি বলি তো এই সময় শাক খাবারের অন্য কোন বিকল্প নাই। এই সময় নয়াকৃষির কোন একটি বিদ্যাঘরে হপ্তাখানেক থাকতে পারলে মনে হয় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। শরীর হাল্কা লাগছে। আর মাথা খোলতাই মনে হচ্ছে। মাঠ থেকে শাক সোজা উঠছে রান্নাঘরে, একটু গোটা রসুন আর ঘানির সরিষা দিয়ে হাল্কা করে ভাজা। টেপাবোরো চালের এক গামলা ভাত আপনি খেয়ে ফেলতে পারা যায় শুধু নুন দিয়ে। দারুন।
আমার তাড়াহুড়ায় জাহেদা শাক তুলতে পারল মাত্র চার রকম। যার মধ্যে আছে, হেঞ্চি শাক। তার যুক্তি এতে শরীরের শক্তি হয়। এরপর খৈরাকাঁটা শাক। এতে শরীরের ব্যথাবেদনার উপশম হয়। তেলাকুচা শাক, ডায়বেটিকস রোগীর জন্য মহৌষধ, কিন্তু জাহেদার যুক্তি ভিন্ন। এর স্বাদে নাকি রুচিও ফেরে। এটা আমি নতুন শিখলাম এবার। এর আগে তিল আর তেলাকুচার ভর্তা ছিল আমার প্রিয় খাবারের একটি।
হেঞ্চি (Alternanthera sesilis) , খৈরাকাঁটা (Amaranthus spinosus) ও তেলাকুচা (Coccinia cordifolia) ছাড়া আরেকটি শাক সে আমাকে খাওয়ালো। আমখৈরা (Amaranthus viridis) । শিখলাম, এই শাকে গর্ভবতী মায়েদের ভীষণ উপকার। দাই মায়েরা এই শাক খেতে বলেন গর্ভবতী মেয়েদের।
অন্যদের কি উপকার যারা গর্ভবতী না, কিম্বা যাদের গর্ভবতী হবার কোন ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই? সেই ক্ষমতা পুরুষদের দিলে প্রজাতি হিসাবে মনুষ্যকুল বাঁচত কিনা সন্দেহ। পুরুষ দশমাস নিজের পেটে মনুষ্য শিশুকে ধারণ করত এটা খুব কম মেয়েই বিশ্বাস করে। জাহেদাও করে না, কিন্তু তাই বলে কি পুরুষেরা আমখৈরা শাক খাবে না? তার যুক্তি।
খাবে।
কেন? চারিদিকে বিষের কুফলে শরীর নিজের জন্য দরকারী পুষ্টি ভেতর থেকে তৈরী করতে পারে না। আমখৈরা সেটা করতে শরীরকে তাগিদ দেয়। কে জানে। হতেও পারে। কিন্তু খাবার সময় শরীর যে আরও আমখৈরা খাবার জন্য তাগিদ দেয়, সেটা নিশ্চিত। – বিশেষত জিহ্বা। স্বাদ বলে কথা!
এখন শাক খাচ্ছি। অন্য শাক নিয়ে সুযোগ পেলে পরে লিখব। এই শাকগুলো সম্পর্কে আরও তথ্য জানাবো আস্তে আস্তে।
২৫ ফাল্গুন ১৪২০। ৯ মার্চ ২০১৪। আরশিনগর বিদ্যাঘর।