নয়াকৃষি পদ্ধতিতে স্থানীয় মাছের বৈচিত্র্য ফিরে আনা সম্ভব


নয়াকৃষি পদ্ধতিতে স্থানীয় মাছের বৈচিত্র্য ফিরে আনা সম্ভব গোলাম রাব্বী বাদল নয়াকৃষি গবেষণা বিভাগ উবিনীগ। বাংলাদেশ নদী প্রধান দেশ, খাল বিলের দেশ। মাছের দেশ। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় মাছের বাজারে পাওয়া যায় না তার উপর দাম খুবই বেশি। এমন অবস্থা যে সারারণ ক্রেতারা স্থানীয় মাছের ধারে কাছে ভিড়তেই পারেন না। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা, সারা ইউরোপ মহাদেশে যে পরিমাণ মাছের জাত রয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশী মাছের জাত রাংলাদেশে রয়েছে; যদিও বর্তমানে অনেক স্থানীয় জাতের মাছ বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় মাছের মধ্যে ছোট মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় ছোট মাছের মধ্যে রয়েছে –পুঁটি, মলা, বাতাশি, চান্দা, দারকিনা, খলিশা, বৌমাছ, আনজু, বাঁশপাতা, টেংরা, ইত্যাদি। এসব ছোটমাছ পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় সাধারণত ৬.২৫ সে.মি. আকারের হয়ে থাকে। ছোটমাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। পুষ্টিমানের দিক থেকে ছোটমাছের অবদান উল্লেখযোগ্য। এছাড়া চোখের জন্য ছোটমাছ খুবই উপকারী। ছোটমাছ ছাড়াও অন্যান্য স্থানীয় মাছের মধ্যে রয়েছে- পাবদা, শিং, কৈ, বাচা, টাকি, সোল, বাইলা, বাইম, গুতম, গুচি, একঠোটা, চেলা ইত্যাদি। বর্তমানে এসব স্থানীয় মাছের যে দূর্দশা এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামিতে স্থানীয় মাছ আর পাওয়া যাবে কিনা বলা মশকিল। এই দূর্দশা হয়তো অনেকেই মনে করছেন স্থানীয় মাছের, কিন্তু বাস্তবে এ দূর্দশা বাংলাদেশের মানুষের তথা পৃথিবীর সকল মানুষের। কেননা প্রাণবৈচিত্র্য হচ্ছে মানুষ টিকে থাকার এক মাত্র উপায়। এর বিকল্প নেই। আর প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মিঠা পানির স্থানীয় মাছ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। বর্তমানে সারাদেশব্যাপী স্থানীয় তথা ছোটমাছের যে সংকট এবং দূরবস্থা বিরাজ করছে-এর থেকে পরিত্রাণের হয়তো অনেক পথের কথা বলা যেতে পারে তবে পরিবেশ-প্রকৃতি মানুষের জীবনজীবিকা তথা স্থীতিশীল খাদ্যসার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে-একমাত্র নয়াকৃষি পদ্ধতিতেই স্থানীয় প্রজাতির মাছসহ সকল জলজ-স্থলজ সকল সম্পদ রক্ষা ও বিকশিত করা অনায়াসে সম্ভব। স্থানীয় জাতের মাছ হারিয়ে যাবার কারণঃ বাংলাদেশে স্থানীয় জাতের মাছের সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনেক কারণের কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে স্থানীয় জাতের মাছ সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারণের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে কারণের সমাধান করা হলে অবশ্যই বাংলাদেশে স্থানীয় মাছের সংকট থাকবে না। কারণগুলো হচ্ছে - ১। কৃষিতে ব্যাপক হারে রাসায়নিক বিষ ব্যবহার। ২। কৃষিতে একাট্টা ফসল চাষাবাদের আগ্রাসণ। ৩। বিদেশী হাইব্রিড এবং উফশী মাছের বাণিজ্যিক চাষাবাদ বৃদ্ধি ৪। অবকাঠামো উন্নয়নের (রাস্তাঘাট, ইমারত) নির্মানের নামে দেশের সর্বত্র নদী, নালা-খাল-বিল ইত্যাদি ভরাট করার কারণে পানিশূন্য করা হয়েছে। ৫। প্রাণবৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোন থেকে স্থানীয় মাছের প্রতি কম গুরুত্ব দেয়া। ৬। জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ধ্বংস করা। ৭। স্থানীয় মাছ সম্পর্কে জনগণের অসচেতনতা। স্থানীয় জাতের মাছ ও নয়াকৃষিঃ গত মার্চ মাসে আমি নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজে টাঙ্গাইল জেলার কান্দাপাড়া ও মৌশাকাঠালিয়া গ্রামের কৃষকদের আলোচনা সভায় যোগদান করি। প্রসঙ্গক্রমে সেখানে স্থানীয় মাছের কথা আসে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনাদের গ্রামে কি স্থানীয় জাতের মাছ পাওয়া যায়? উত্তরে কৃষক হালেমা বেগম, শেফালী বেগম, রাবেয়া বেগম, নূরজাহান বেগম, রহিমা বেগম, হাবিবুর রহমানসহ উপস্থিত কৃষকরা জানান যে, কয়েক বছর পূর্বে যখন গ্রামে রাসায়নিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হতো তখন গ্রাম থেকে স্থানীয় জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিল। তখন বর্ষা মৌসুমে বা ঢলের পানিতে তেমন কোনো মাছই পাওয়া যেত না। এটা বলছি ১৫/১৬ বছর পূর্বের কথা। আমরা যখন নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করলাম, আমরা ক্ষেতে রাসায়নিক বিষ, রাসায়নিক সার দেয়া একেবারে বন্ধ করে দিলাম। আস্তে আস্তে গ্রামে নয়াকৃষির কৃষকদের সংখা বাড়তে লাগলো, এখন আমাদের গ্রামের সিংহভাগ কৃষক নয়াকৃষির সাথে যুক্ত। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় জাতের মাছগুলো ফিরে আসে। আমরা এটা দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। তবে এটা বাস্ত সত্য যে প্রবাদ আছে মাছে ভাতে বাঙ্গালী, নয়াকৃষির বাদৌলতে আমরা আজ মাছে ভাতে বাঙ্গালী। আমি জিজ্ঞাসা করলাম মাছে ভাতে বাঙ্গালী মানে বুঝতে পারলাম না তো! তখন নয়াকৃষির কৃষকরা বলেন, আমাদের গ্রামে কৃষিকাজে কোনো রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয় না ফলে বর্ষা মৌসুমে পানিতে মাছ খেলা করে। তখন আমাদের মাছ ধরার আনন্দ পেয়ে বসে। গ্রামের নারী-পুরুষ সকলেই কম-বেশি মাছ ধরে খাই। জ্যৈষ্ঠ মাসের বৃষ্টিতে ডোবা, পাগার, খালে পানি জমে, সেখানে আপনা থেকেই চাটা, ইছা, দারকিনা, তিতপুঁটি, চান্দা, গুইটা চান্দা, এসব মাছ পাওয়া যায় সেসব ধরে খাই। আবার জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে আষাঢ় মাসে দেখা যায় মলা, ঢেলা, খলশা, চেলা ডেবরী চেলা, চান্দা, ইছা, বাইলা, টাকি, বাইলা, টেংরা ইত্যাদি। আবার আষাঢ় মাসের শেষে ঢল নামলে, তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, তখন মাছ খাবার পর অতিরিক্ত মাছ শুঁটকি বনিয়ে রাখি। এভাবে আমরা বিনা পয়সায় অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত মাছ খেয়ে থাকি। আমরা যাতে অন্যান্য মাসেও মাছ খেতে পারি সেজন্য আমাদের প্রত্যেকের খাল, ডোবা, পাগার, যেটাই থাকুক সে মাছসহ পানি সংরক্ষণ করে রাখি। প্রয়োজন মতো আমরা মাছ ধরে খাই। তাহলে এখন বলুন নয়াকৃষির কৃষকরা কি মাছ-ভাতে বাঙ্গালী নয়! স্থানীয় মাছের প্রতি নয়াকৃষির কৃষকদের আগ্রহের কারণ নয়াকৃষির কৃষকদের জীবন ব্যবস্থা, তাদের কৃষি পদ্ধতি ও পরিকল্পনা, এটা যিনি দেখেননি তার উপলব্ধিতে আসা কষ্টকর। নয়াকৃষির কৃষকরা শুধু শস্য নিয়েই ব্যস্ত্য থাকেন না। তারা তাদের দৈনন্দিন কাজের ভেতর দিয়েই সকল প্রাণসম্পদের প্রতিপালন করে থাকেন। সে দিক থেকে শস্যের পাশাপাশি মাছসহ সকল জলজ ও স্থলজ প্রাণসম্পদের প্রতি তাদের নিয়মিত মনোযোগ রয়েছে। এসব ছাড়াও নয়াকৃষির কৃষকরা যেসব সুনির্দিষ্ট কারণে স্থানীয় ও ছোট মাছের প্রতি আগ্রহী সে সব হচ্ছে, (১) এসব স্থানীয় প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশে নিজেদের বংশ বিস্তার করে। প্রতি বছর পুকুরে বা জলাশয়ে মাছের পোনা ছাড়তে হয় না। (২) সব ধরণের জলাশয়ে অল্প সময়ে এসব মাছ প্রতিপালন করা সম্ভব। (৩) এসব প্রতিপালনে তেমন কোনো যত্ন পরিচর্যা এবং আলাদা করে কোনো খাদ্য দেয়ার প্রয়োজন পরে না। (৪) ছোট মাছে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ ও দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান এমোইনো এসিড। (৫) মলা, পুঁটি মাছে আছে অধিক পরিমাণে ভিটামিন ‌‌”এ‍”, ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। (৬) গর্ভবতী মা ও দুগ্ধপ্রদানকারী মায়েদের রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে ছোট মাছের অবদান সবচেয়ে বেশি। (৭) ছোটো মাছে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস ও আয়োডিন। (৮) এসব মাছের বাজার মূল্য এবং চাহিদা সবচেয়ে বেশী। (৯) পানির অল্প গভীরতায় অর্থাৎ এক থেকে দেড় মিটার পানির গভীরতায় ছোট মাছ অনায়াসে প্রতিপালন করা যায়। (১০) প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস অন্তর অন্তর জলাশয় থেকে মাছ তুলে বিক্রয় করা যায়। (১১) গ্রামের গরিব মানুষের পুষ্টি সমস্যার সমাধান হয়। (১২) বর্ষা মৌসুমে ঢলের পানিতে গ্রামের সবাই মিলে একসঙ্গে মাছ ধরার কারণে সামাজিক সুসম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। পরিশেষে আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে যে স্থানীয় জাতের মাছ পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, জীবনজীবিকা এবং দেশের খাদ্য সার্বভৌমত্ত্বের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বানিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ করে হয়তো বা মাছের অনটন ক্ষাণিকটা কমানো যেতে পারে কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ চক্রের ক্ষতি হবে এবং হচ্ছে এটা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার কোনো না কোনো ভাবে মানুষকে হতেই হবে। শুধু কৃষক বা জেলেদের সচেতন হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না, সমাজের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান এব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে। একটা কথা আমাদের সবার জেনে রাখা দরকার, আমাদের অজ্ঞতা ও অহংঙ্কারকে মহাজাগিতিক শক্তি বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না। গোলাম রাব্বী বাদল নয়াকৃষি গবেষণা বিভাগ উবিনীগ।

Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter