স্বল্পনাড়ু গ্রামের নিরাপদ খাদ্য
ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেষা একটি গ্রাম স্বল্পনাড়ু। টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার লাউহাটি ইউনিয়নে স্বল্পনাড়ু গ্রামের অবস্থান। এই গ্রামের বেশীরভাগ পরিবার নয়াকৃষি চাষের সাথে জড়িত। অথ্যাৎ ফসল ফলাতে তারা কোন কীটনাশক বা রাসায়ানিক সার ব্যবহার করেন না। এলাকায় উপযোগী স্থানীয় বৈচিত্র্য জাতের ফসল ফলান। নিজ হাতে উৎপাদিত ফসলের বীজ রাখেন। পরবর্তী মৌসুমে নিজের হাতে রাখা এসব বীজ দিয়ে ফসল চাষ করেন। প্রয়োজন অনুসারে নিজেদের মধ্যে বীজ বিনিময় করা গ্রামের চিরায়িত একটি সাংস্কৃতিক প্রথা।
আজম্মকাল থেকেই ধলেশ্বরী নদীর সাথে মিতালির মধ্য দিয়ে গ্রামটি তার প্রাকৃতিব সৌন্দর্য ও প্রাণসম্পদের ভান্ডারকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ব করছে। তবে সত্তর থেকে নব্বই দশক সময়কাল গ্রামের অধিবাসিরা তথাকথিত আধুনিক কৃষির ফাঁদে পড়ে কিছুটা পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন। নব্বই দশকের শেষদিকে নয়াকৃষি চাষাবাদের (প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা) সাথে যুক্ত হয়ে কৃষকরা প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের চাষাবাদ শুরু করেছেন। বর্তমান স্বল্পনাড়ু গ্রাম প্রাণসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের একটি সমৃদ্ব গ্রাম।
নদীবিধৌত সমতল এলাকা অধ্যুষিত স্বল্পনাড়ু এবং আশেপাশের গ্রামগুলোর চাষাবাদ ব্যবস্থা ও জীবন জিবিকা এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের আলোকেই গড়ে উঠেছে। প্রধান খাদ্য ফসল ধান উৎপন্ন হয় বর্ষা মৌসুমে। পানিসহিষ্ণু ধানের জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে – চামারাদীগা, হরিংগাদীগা, ভাওয়াইলাদীগা, পানিশাইল, কার্তিকঝোল, লতাশ্ইাল, ঢেপা, বকঝোল, পাটজাগ ইত্যাদি। মিষ্টি স্বাদের এসর জাতের ভাত তরকারী ছাড়াই এক-দুই প্লেট খাওয়া যায়। ঢেপা ধানের চিড়া, পাটজাগের মুড়ি ও দীঘা ধানের পিঠা শুধু খাদ্য হিসেবে নিরাপদই নয়, স্বাদেও অতুলনীয়।
রবি ও শীতকালীন ফসলের মধ্যে প্রধানত রয়েছে পায়রা, গম, ডাল, মসল্লা ও নানা রকমের শাকসব্জি। স্বাদে সেরা পুষ্টিসমৃদ্ব পায়রার ছাতু কৃষকদের অত্যন্ত প্রিয়। তাঁরা বিশ্বাস করেন পায়রার ছাতু পাকস্থলি ঠান্ডা রাখা ও শরীরকে রোগমুক্ত রাখার জন্য অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। ভোজ্য তেল হিসেবে কৃষকরা তঁদের উৎপাদিত তিলের তেলই প্রধানত ব্যবহার করেন। তাঁরা মনে করেন ক্যালসিয়াম সমৃদ্ব তিলের তেল ব্যাথাজনিত যে কোন রোগের নিরাময়ের জন্য অত্যন্ত উপাদেয়।
নয়াকৃষি অনুশীলন ও ধলেশ্বরী নদীর আশীর্বাদপু®ট পলিমাটির সমন্বয়ে আবাদী ফসলের পাশাপাশি অনাবাদী ফসলের সমারোহও এই এলাকায় ব্যাপক। প্রায় ৩৭ জাতের অনাবাদী শাকের বিস্তৃতি এই গ্রামে বিদ্যমান। গরীব ও প্রান্তিক চাষিরা প্রধানত কুড়িয়ে পাওয়া বিভিন্ন শাক সংগ্রহ করে থাকেন। বাড়ির আশ-পাশ থেকে এসব খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন। অতি যত্নে নারীরা শাক সংগ্রহ করেন। তিন আঙুলের মাথা দিয়ে শাক ছিড়েন। কারন পরবর্তীতে যেন ঐ গাছ থেকে আবার শাক সংগ্রহ করা যায়। মাঠে গরু, ছাগল চরানোর সময় শাড়ির আঁচলে করে শাক তুলে আনেন। প্রত্যেক মৌসুমে তারা কুড়িয়ে পাওয়া শাক সংগ্রহ করে খান। বিশেষ করে শীত মৌসুমে গম, খেসারী ক্ষেতে অনেক কুড়ানো শাক পাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে গ্রামে প্রচুর কলমি শাক, শাপলা পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় তারা শালুক, কচুর লতি সংগ্রহ করে খান। কচুর মুখি, কচুর লতিসহ এসব কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যে আয়রন, পুষ্টি ও ভিটামিন ভরপুর বলে কৃষকরা মনে করেন।
প্রতি বছর চৈত্র মাসে গ্রামের নারীরা ১৩ রকমের কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য সংগ্রহ করে খান। এই ১৩ রকমের শাক একত্রে মিশিয়ে রান্না করে খেলে শরীরে রোগ-ব্যাধি হয় না বলে এলাকাবাসীরা বিশ্বাস করেন। তাছাড়া এসব কুড়িয়ে পাওয়া শাকে অনেক ওষুধি গুনাগুণও রয়েছে। এসব শাক খেলে মাথা ব্যাথা সেরে যায়। গর্ভবতী মায়েরা বাচ্চার পুষ্টির জন্য এসব কুড়ানো শাক খান। গিমা শাক খেলে পেট ফাঁপা, পেটের গ্যাস ভাল হয়। তেলাকুচা পাতার শাক খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে। ঢেঁকিশাক, কলমি শাক খেলে মাথা ব্যাথা করে না। কস্তুরী শাক খেলে আমাশা রোগ ভাল হয়। এসব শাক যেন হারিয়ে না যায় তার প্রতিও তারা খেয়াল রাখেন। তের রকম শাকের মধ্যে রয়েছে-১. হেলেঞ্চা ২. কলমি ৩. নেটাপেটা ৪. ঢেঁকিশাক ৫. দন্ডকলস ৬. তেলাকুচা ৭. বাইতা ৮. হেঞ্চি ৯. মোরগশাক ১০. ফুলহেঞ্চি ১১. গিমা ১২. কচুশাক ১৩. কস্তুরী শাক। এই ১৩ রকমের খাদ্যের প্রাপ্তি ও প্রাচুর্যতার মধ্য দিয়েও এলাকাবাসিরা বুঝে নেন তাঁদের গ্রামটি খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব ও খাদ্যের সমৃদ্বির দিক থেকে নিরাপদ।