নয়াকৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্যর সামাজিক ব্যবস্থাপনা
নয়াকৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্যর সামাজিক ব্যবস্থাপনা উবিনীগ, আরশিনগর বিদ্যাঘরের অধিনে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার মাঝপাড়া ইউনিয়নের পাড়াসিধাই গ্রাম ও নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার চাঁন্দাই ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর ও কৃষ্ণপুর গ্রামে প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা (সিবিএম) নয়াকৃষির কাজ পরিচালিত হয়। পরিবেশের সমস্ত প্রানের বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রেখে চাষাবাদ করার ব্যবস্থাই হচ্ছে নয়াকৃষি।মানুষসহ পশু পাখি কীট পত্ঙ্গ জীব অণুজীব সকলেরই প্রাণ ও প্রাণরক্ষার শর্ত এবং প্রাণের সম্পর্ক রক্ষার জন্য লড়াই করে নয়াকৃষি। সিবিএম কথার অর্থ (কমিউনিটি বেস বায়োডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট) সহয অর্থে প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে মূল স্রোতে নিয়ে এসে পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি রোধ করে গ্রামের জীবন জীবিকা ও খাদ্য সার্বভেৌমত্ব রক্ষা করা। এছাড়াও কৃষক এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সকলে যেন নিরাপদ পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাদ্য এবং নিজের হাতের বীজ ব্যবস্থাপনাসহ স্থানীয় প্রাণ সম্পদের বিকাশ ঘটিয়ে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কাজ এবং নিজের জ্ঞান ব্যবহার চর্চা করে নিজেদেরকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে নয়াকৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা (সিবিএম) কাজ করে। গ্রামে কাজ করতে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে এবং গ্রামের প্রেক্ষাপট দেখে প্রকল্পের কর্মীরা কৃষকের সহযোগীতায় বিভিন্ন দল গঠন করা হয়। দল গঠনের ফলে ফলোআপ করতে সুবিধা হয় এবং প্রতিটি দলের সাথে আলোচনা করলে গ্রামের সব তথ্য দ্রুত বের করতে সুবিধা পাওয়া যায়। এছাড়াও গ্রামে কাজ করতে গেলে দলব্দ্ধ ভাবে যদি একটি কাজ শুরু করা যায় তবে এর ফলাফল অবশ্যই আসবে। সে অনুপাতে অত্র এলাকায় কৃষকদের কে নিয়ে বিভিন্ন দল সংগঠিত করা হয়েছে। সিবিএম দলের সদস্যগণরা বীজ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আউশ ধানের জাত নির্বাচন প্রশিক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় ভলনারেভিলিটি এ্যাসেসম্যান্ট, বাড়ির উঠানে শাক-সবজি ও ফলমূল এবং গৃহপালিত পশু পাখি বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর তাদের আচরনে/ অনুশীলনে নতুন পরিবর্তন ঘটে যেমন-নিজের জ্ঞান ব্যবহার করে চাষাবাদ, স্থানীয় জাতের বীজের ব্যবহার বাড়িয়ে করা, বীজের পরিমান বাড়ানো, মিশ্র আবাদ বাড়িয়ে করা, মৌসুম ধরে ধরে বীজ বাছাই, নতুন বীজ সংগ্রহ- সংরক্ষন, খাপ খাওয়ানো গবাদি পশুপাখি জাত বৃদ্ধি, বাড়ির আঙ্গিনায় চাষাবাদ বাড়ানো, বীজের জন্য জমিতে বীজ কেন্দ্রিক আবাদ করা, মৌসুমি নার্সারি, বীজ বিনিময়, আউশ ধান আবাদের জন্য কৃষক বৃদ্ধি, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যর কথা চিন্তা করে আবাদ করা, নিজেদের আয় বাড়ানো, এবং শস্যর বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়াও সদস্যরা গ্রাম থেকে প্যাকেট বীজ দিয়ে চাষাবাদ কেউ যাতে করতে না পারে সেই লক্ষ্যে এক হয়ে কাজ করছে। সিবিএম দলের সদস্যগনরা নতুন কৃষকদেরকে নয়াকৃষিকত যোগদানের জন্য উৎসাহিত করছে। এবং বাড়িতে এবং মাঠে জমিতে মিশ্র চাষ এবং খাপ খা্ওয়ানো শস্য আবাদ করে সফলতাগুলো অন্য কৃষকদেরকে দেখিয়ে অনুপ্রানিত করছে। পাশাপাশি কৃষকদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে জৈব্য সার(কম্পোস্ট) তৈরি করা এবং রাসায়নিক সারের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরছে। প্রয়োজনে কৃষকদেরকে বীজ দিয়ে এবং বীজ আখড়ার সাথে যোগসূত্র বন্ধন সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা সহ সার্বিক পরামর্শ দিয়ে প্রাণবৈচিত্র্যে রক্ষায় নিজে ও অন্যকে দক্ষ করে গড়ে তুলছে। গ্রামের নয়াকৃষির কৃষকরাই মূলত সিবিএম দলের সদস্য। এই সদস্যদেরকে বাড়ির আঙ্গিনায় চাষাবাদে এবং বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে জমিতে চাষাবাদের জন্য স্থানীয় জাতের কৃষকের চাহিদা অনুসারে বীজ দিয়ে সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প। এই সিবিএম দলে নারী ও পুরুষ সমান অধিকার। সিবিএম গ্রামে নয়াকৃষির কাজ করতে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, গ্রামে দলের মাধ্যমে কোন কিছু করলে তার বরকত বাড়ে। এরই আদলে স্থানীয় বীজ রক্ষার্থে এবং স্থানীয় গবাদি পশুপাখির জাত ধরে রাখতে সিবিএম দলের মধ্যে বিতরন করা হয়। দলের বর্তমান অবস্থান বলতে সিবিএম দলের সদস্যদের হাতে স্থানীয় জাতের অসনক বীজ রয়েছে যা চাষাবাদ এবং বীজ বীনিময়ের মাধ্যমে পেয়েছে। এই বীজগুলো এখন ব্যবসায়িক আকারে ব্যাপক আকারে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এতে করে সিবিএম দলের সদস্যরা নিজেদের সমস্যাগুলোকে কাটিয়ে উঠে আর্থিক ভাবে সফল হচ্ছে। পাশাপাশি অন্য নতুন দল গুলোকেউ সহযোগিতা করছে।সিবিএম দলের মাধ্যমে একদিকে প্রাণবৈচিত্র্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর অন্যদিকে নতুন গ্রামগুলোতেও সিবিএম প্রকল্পের উন্নয়নমুখী কাজ গুলো সর্ম্পকে অন্যরা অবগত হচ্ছে। এতে করে প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা (সিবিএম) এর সাথে নতুন নতুন কৃষক জড়িত হচ্ছে। নয়াকৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা (সিবিএম)এর কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে নয়াকৃষি ১০ নীতি পদ্ধতিতে মৌসুম ভিক্তিক পরিকল্পনা অনুসারে চাষাবাদ করে একই শ্রমে একই মৌসুমে কয়েকটি ফসল কৃষকের ঘরে তুলতে পারছে। পাশাপাশি আগামী মৌসুমের জন্য বীজগুলো নিজের হাতে ও ঘরে সংগ্রহ ও সংরক্ষন করে রাখতে পারছে। এরফলে আগামী মৌসুমে তাদের আর অন্যর নিকট বা বীজ ভান্ডার থেকে বীজ আর ক্রয় করতে হচ্ছেনা। নয়াকৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্প কৃষকদের মাঝে স্থানীয় জাতের গবাদি পশু পাখি বিতরনের ফলে সহযে লালন পালন করতে পারছে। পাশাপাশি কৃষকরা ফসল বিক্রয় করে অনেকে স্থানীয় জাতের গবাদি পশু পাখি ক্রয় করে লালন পালন করছে।এরফলে নারীদের আর্থিক উন্নতি করতে সুবিধা হয়েছে। পুষ্টির জন্য মাছ,মাংশ,ডিম,দুধ নিজে খাওয়ার পরও বাজারে বিক্রয় করতে পারছে। এতে কৃষকরা তাদের আগের তুলনায় আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হতে পারছে। গ্রামে প্রতিটি মৌসুমে মোকাবেলা করে চাষাবাদের ফলে গ্রামের শ্রমিকদের কাজ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে পাশাপাশি মুজুরিও বাড়ছে। এতে আধুনিক কৃষির উপকরন কমে যাওয়াই গ্রামের কামার- কুমারের কাজও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও সিবিএম গ্রামগুলোতে প্রকল্পের কাজের ফলে প্রাণবৈচিত্র্যে সম্পদ সংরক্ষন বৃদ্ধি হয়েছে। প্রাণ সম্পদ বলতে স্থানীয় জাতের গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পাখি, গবাদি পশুপাখি, স্থানীয় জাতের মাছ, কুড়িয়ে পাওয়া শাক সবজি, কুড়িয়ে পাওয়া মাছ, ঔষধি গাছপালা পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে টিকে থাকতে পারছে। এরফলে কৃষকরা প্রাণবৈচিত্র্যে সম্পদ ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে সকল শ্রেনীর মানুষের কাছে। গ্রামগুলোতে কুড়িয়ে পাওয়া শাক সবজির মধ্যে চিরেকুটা, কাঞ্চন, হেলেঞ্চা, পিপুল, গিমা, ঢেঁকিশাক, থানকুনি, কচু, কলমী, তেলাকুচা ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বন্য পশুপাখির মধ্যে পেঁচা, গুইসাপ, ঘুঘু, দোয়েল, চিল, শালিক, টুনটুনি, বাদুর, শকুন, বেজি, ফিঙেরাজ প্রভৃতির পাখিগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩ টি সিবিএম (পাড়াসিধাই,রাজেন্দ্রপুর এবং কৃষ্ণপুর) গ্রামে অনেক শস্যর প্রজাতী বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকল্প বীজ বিতরনের ফলে। বীজের প্রজাতী গুলো হলো- ধনিয়া, কালোজিরা, খেসারি, মসুরি, লাল শাক, লাউ, করলা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, মিষ্টি কুমড়া। আর আউশ ধানের মধ্যে শনি, ষাইটা, শঙ্খপটি, কালোবকরি, কালা মানিক, ভইরা, ভাতুরি, খড়া জামড়ি এবং মুলকে আউশ। বোরো মৌসুমে বৃদ্ধি পেয়েছে ষাইটা বোরো এবং টোপা বোরো। স্থানীয় বীজ দিয়ে চাষাবাদে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে কারন খরচের চেয়ে লাভ বেশি। এরফলে কৃষক বীজের উপর বীজ সংগ্রহ , সংরক্ষন, মৌসুম ভিক্তিক চাষাবাদ , বীজ চেনা, পরিবেশ বৈপরিত্য আবহাওয়া জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানো জাত নির্বাচন করতে পারদর্শী হয়েছে। এছাড়াও সিবিএম গ্রামে গুলোতে স্থানীয় জাতের (পাবনায়া,পাতি,চাঁদ কপালী) গরু বিতরনের ফলে পরিবার গুলো আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল হয়েছে এবং সামাজিক সর্ম্পক বৃদ্ধি পেয়েছে। গরু থেকে নিয়মিত দুধ পেয়ে নিজে খেতে পারছে এতে পরিবারের পুষ্টি ঠিক থাকছে এবং বাড়তি দুধগুলো বিক্রয় করে নগদ টাকা হাতে পাচ্ছে। গরুর গোবর ব্যবহার ও গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরি করে নিজে চাষাবাদ করছে এতে পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাদ্য সহযে উৎপাদন করতে পারছে। খাদ্য বিক্রি ও পাড়া প্রতিবেশিদের মাঝে বিতরন করতে পারছে। এছাড়াও অন্যরাও গোবর নিয়ে ঘর লেপা এবং গোবর ও জৈব সার তৈরি করে চাষাবাদ করতে পারছে। আর জৈবসার দিয়ে আবাদের ফলে জমিতে সবুজ ঘাস বেশি হচ্ছে। এরফলে গরুর জন্য কাচা ঘাস সহযে মিলছে। পাশাপাশি মুরগি বিতরনের ফলে গ্রামের নারী কৃষকরা স্বাবলম্বি এবং স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিতরনকৃত মুরগির দেওয়া ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়েছে এই মুরগির বাচ্চা এবং মুরগির ডিম বিক্রয় করে নারী কৃষকরা নিজের পরিবারের বাড়তি আয় করতে পারছে। অনেকে এই আয় থেকে টাকা জমিয়ে পরবর্তিতে ছাগল কেনার স্বপ্ন দেখছেন। পাশাপাশি নিজেরা খেয়ে পরিবারের সদস্যদের খাদ্যের পুষ্টির ঘাটতিও দূর করছেন। বাড়িতে মেহমান আসলে নিজের ঘর থেকেই খাবার জোগাড় করতে পারছে এবং প্রতিবেশিকেও সহযোগিতা করা সম্ভব হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রাণবৈচিত্র্যেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও সিবিএম এর গ্রামগুলোতে কৃষকদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে নয়াকৃষি সমবায় সমিতি,সিবিএম ফান্ড এবং শস্য সুন্দর বিক্রয় কেন্দ্র। সার্বিকভাবে সিবিএম এর প্রকল্পের কার্যক্রমের ফলে গ্রামগুলোতে প্রাণ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক ভাবে সকলের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ এবং বিকাশ হয়েছে। সর্বশেষ বলা যায় প্রাণবৈচিত্র্য সামাজিক ব্যবস্থাপনা (সিবিএম)প্রকল্পের মাধ্যমে কাজের ফলে গ্রামে মাঠ পর্যায়ে প্রাণসম্পদের প্রাচুর্যতা বেড়েছে, কৃষক সম্প্রদায়ে পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাদ্যের নিরাপদ অবস্থার বৃদ্ধি ঘটেছে, কৃষক পরিবারের বিশেষ করে নারীদের আয় বেড়েছে, সমাজে নারীদের ক্ষমতায়ন বেড়েছে এবং কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চাষাবাদে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিটি গ্রামে নয়াকৃষির গ্রাম রূপে রূপান্তিরিত হয়েছে।
পরিশেষে সকলকে পাবনা ঈশ্বরদীর আরশিনগর বিদ্যাঘর কেন্দ্রে এবং নয়াকৃষি প্রাণবৈচিত্র্যে সামাজিক ব্যবস্থাপনা(সিবিএম)গ্রামগুলোতে কৃষকের সাথে নয়াকৃষি ভাবচর্চা করার আমন্ত্রন রইল।