বীজ সম্পদ কেন্দ্র,বীজ আখড়া এবং বীজ সঙ্গ...
কৃষকের শক্তি হলো বীজ,বীজ হচ্ছে কৃষকের সন্তানের সমতুল্য। বীজ বিহীন কৃষি বা কৃষক কল্পনা করা যায় না। নিজের হাতের বীজ যার নিকট বেশী আছে সে ততো এগিয়ে। ঘরে ঢুকতে চাঁবি লাগে, কৃষিও একটা ঘর, কৃষি করতে বীজ লাগবে, বীজ ছাড়া চাষ হবে না। কৃষকের মূল হলো বীজ যা দিয়ে একের অধিক ফসল বাড়ানো সম্ভব। নিজেকে পরিবর্তন আনা সম্ভব। আর কৃষকের হাতের বীজের নিরাপদ ও নিশ্চয়তার জন্যই নয়াকৃষির এই বীজ সম্পদ কেন্দ্র। এই বীজ সম্পদ কেন্দ্রের সাথে যুক্ত গ্রাম পর্যায়ের বীজ আখড়া এবং বীজ সঙ্গ।
নয়াকৃষি গ্রামের একটি বীজঘর, কৃষকরা এখানে নিরাপদে বীজ রাখে।
বীজেই প্রকৃতি, বীজেই সৃষ্টি। সৃষ্টির মূলেই বীজ, বীজছাড়া চাষাবাদ চলে না। স্থানীয় জাতের বীজ কৃষকের বড় ধরনের জ্ঞান। গ্রাম পর্যায়ে কৃষকের সাথে কাজ করতে গীয়ে কথা বলে জানা যায় বীজের নিরাপত্তা কমে গেছে, বীজকে স্থায়িত্ব করতে গেলে প্রতিটি এলাকানুসারে একটি করে বীজের প্রাণ কোষের সংরক্ষনের স্থান জরুরি। এরই আদলে কৃষকদের সহযোগিতায় একটি জেলাতে ১ টি করে বীজ সম্পদ কেন্দ্র (CSW বা Community seed wealth center) এবং নয়াকৃষির কয়েকটি পাশাপাশি গ্রাম নিয়ে গড়ে তুলা হয়েছে বীজ আখড়া (SH বা seed hut)। কৃষকের সম্মিলিত ভাবে বীজের নিরাপত্তা, বীজ পাওয়ার নিশ্চয়তা, গুনগত মান ঠিক রাখতে, বীজের সুরক্ষা ঠিক রাখতে, বিভিন্ন দূর্যোগে টিকিয়ে রাখতে এবং কোন কারনে কৃষকের হাত থেকে বীজ যাতে হারিয়ে না যায় এর জন্য নয়াকৃষি আন্দোলনের সহযোগিতায় কৃষকরা গড়ে তুলেছে একেক-টি বীজ সম্পদ কেন্দ্র এবং বীজ আখড়া।
নয়াকৃষির কৃষকরা বীজ নিয়ে আলোচনা করছে।
স্থানীয় জাতের কৃষকের হাতের এবং বিলুপ্তির পথে বীজের জাত গুলো এবং কৃষকদের চাহিদা অনুসারে এছাড়াও স্থানীয় মাটি, বাতাস, পানি, মৌসুম, বিভিন্ন দূর্যোগে খাপ খায় এরকম বীজগুলোই বীজ সম্পদ কেন্দ্র এবং বীজ আখড়াতে সংরক্ষন করা হয়। সহয কথায় নিজের এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্মত খাটিঁ, সুস্থ, এবং রোগ বালাই মুক্ত পরিপুষ্ট বীজের প্রজাত ধরে ধরে জাতগুলো সংরক্ষন করা হয়। বীজ সম্পদ কেন্দ্র এবং বীজ আখড়াতে শাক-সবজি জাতীয়, ডাল জাতীয়, তৈল জাতীয়, মসলা জাতীয়, কাঠ জাতীয়, ফুল জাতীয়, ঔষধী জাতীয়, মা জাতীয় এবং ৩টি মৌসুমের ধানের জাতের বৈশিষ্ট অনুযায়ি বীজ গুলো সংরক্ষন করা হয়।
বীজ সম্পদ কেন্দ্রটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহারিত হচ্ছে। বীজ সম্পদ কেন্দ্র মূলত স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষন, পূনরুৎপাদন, বীজ বিনীময়এবং জলবায়ু মোকাবেলায় সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি বীজ সম্পদ কেন্দ্রের অধিনে ৩ থেকে ৫ টি করে বীজ আখড়া পরিচালিত হয়। আর বীজ সম্পদ কেন্দ্রের সাথে সরাসরি সর্ম্পক নয়াকৃষির বীজ আখড়া এবং নয়াকৃষি কৃষকের। বীজ সম্পদ কেন্দ্রের সক্রিয় কাজের ফলে স্থানীয় বীজ কৃষক নিজের হাতে রাখতে পারছে। কৃষকরা কিছু বীজ, বীজ আখড়ায় রাখছে আর কিছু বীজ, বীজ সম্পদ কেন্দ্রে রাখছে এর ফলে বীজ হারানোর ভয় আর থাকছেনা। এছাড়াও কৃষকদেরকে দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বীজ অভিঙ্গ নারী দল ও বীজ অভিঙ্গ নারী পুরুষ দল। বীজ সম্পদ কেন্দ্রের অধিন থেকে প্রতিটা বীজ কৃষকের চাহিদা অনুসারে আবহাওয়া জলবায়ু সহনশীল, মাটি, পানি, পরিবেশের কতটা খাপ খায় এর উপর গবেষণা করে কৃষক পর্যায়ে বীজ দেওয়া দেওয়া হয়। কেন্দ্র পর্যায়ে বিশেষ গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতিটা ধাপে কৃষকের অংশগ্রহন ও কৃষকের জ্ঞান ব্যবহার করা হয়। জলবায়ু মোকাবেলায় বীজ সম্পদ কেন্দ্র ও বীজ আখড়া বিশেষ জাত নিয়ে কাজ করে। ধান গবেষণায় রয়েছে আউশ , আমন ও বোরো। এই ধানের মৌসুম গুলোর মধ্যে আলাদা ভাবে খড়া সহনশীল, পানি সহিষ্ণু, লবন সহিষ্ণু,অতি বৃষ্টি সহনশীলসহ পিঠা, চিড়া, খই, মুড়ি এবং সুগন্ধি জাতের গবেষণাও চলছে। এর ফলে কৃষক মৌসুমি সময় উপযোগী চাহিদা অনুসারে বীজ নিতে পারছে। এছাড়াও খরিপ ১, খরিপ ২ এবং রবি মৌসুমে শাক সবজি গবেষণা করা হয়। গবেষণার অন্যতম হচ্ছে মরিচ, বেগুন, সীম, মসলা জাতীয়, ডাল জাতীয়, কম সময়ে ফলন আসে, কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজি, এবং শীতকালিন সবজি নিয়ে।এই বীজগুলো কৃষক পর্যায়ে বিনীময় করা হচ্ছে এবং বীজ আখড়াতেও দেওয়া হয়। যারফলে বীজের পরিমান বাড়ছে, জাতের বৈচিত্র্যও বাড়ছে এবং কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনে মোকাবেলা করতে পারছে।
বীজ সম্পদ কেন্দ্র এবং বীজ আখড়ার কাজ একই। তবে বীজ আখড়া পরিচালনা করে সরাসরি কৃষকরাই। কৃষকরাই এই বীজ আখড়া রক্ষনা-বেক্ষনের কাজ করে থাকে। গ্রাম পর্যায়ে বীজ আখড়া থাকার ফলে কৃষকদের সময় মত হাতের বীজ পেতে গুরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। এবং আপদে বিপদে শর্ত ছাড়াই বীজ মিলছে। আর বীজ আখড়া গ্রামে হওয়াতে বীজ বীনিময় বেশি হয়। বীজ আখড়া থাকার ফলে গ্রামের বীজের সংকট কমে গেছে। কৃষকের বাড়ি ঘুরে দেখলে দেখা যায় প্রতিটা কৃষকের হাতে ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির বীজ রয়েছে। কৃষকরা নিজের হাতের বীজ দিয়ে নিজে চাষ করে, নিজেই বীজ আখড়াতে রেখে আসে। প্রয়োজনে আবার নিয়ে আসে। প্রতি মৌসুম অনুযায়ী বীজ আখড়া থেকে পর্যাপ্ত পরিমান বীজ নিয়ে সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে পারছে। কৃষকরা বিভিন্ন দূর্যোগে বীজগুলো এবং সারা বছর নিজেদের হাতের বীজের কিছু পরিমান বীজ, বীজ আখড়াতে সংরক্ষন করে চিন্তা মুক্ত হতে পারছে কারন ঘরের বীজ কোন কারনে নষ্ট হলেও বীজ আখড়াতে রাখা বীজ বিপদে ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়াও নতুন বীজ, বীজ আখড়াতে আসলে কৃষকরাই আগে করার সুযোগ পায়। বীজ সম্পদ কেন্দ্র এবং বীজ আখড়া বিভিন্ন জাত সংগ্রহ ,সংরক্ষন ও পূনরুৎপাদন করার ফলে হারিয়ে যাওয়া বীজ গুলো আবার কৃষকরা নিয়ে করতে পারছে। মোটকথা বীজ আখড়া থাকার ফলে গ্রামে স্থানীয় জাতের বীজের সুরক্ষা নিশ্চয়তা হয়েছে ১০০% ।
ভাল মা হলে মেয়ও ভাল হয়। ভাল বীজ দিয়ে আবাদ করলে ভাল ফসল পাওয়া যায়। আর এই ভাল বীজগুলো পাওয়া যায় বীজ সম্পদ কেন্দ্র ও বীজ আখড়া থেকে। বীজ সম্পদ কেন্দ্র ও বীজ আখড়ার কাজের ফলে নয়াকৃষির গ্রামগুলোতে এখনো বহুজাতিক কোম্পানী বা বাহিরের প্যাকেট বীজ ঢুকতে পারেনি।
প্রতিটি বীজ আখড়া পরিচালনা করার জন্য গঠন করা হয়েছে বীজ অভিঙ্গ কমিটি। প্রতিটি কমিটিতে আছে ১২ জন করে কৃষক সদস্য এর মধ্যে নারীই ৮ জন এবং পুরুষ ৪ জন। নারীকে প্রাধান্য দেয়ার উদ্দেশ্য হলো বীজ রাখার ক্ষেত্রে একমাত্র নারীরাই বুঁঝে কোন বীজ কখন বুনতে হবে, কখন রোঁদে দিতে হবে, কখন বীজ সংগ্রহ করতে হবে, কিভাবে সংরক্ষন করতে হবে। পাশাপাশি নারীরাই স্থানীয় জাতের বীজগুলোকে হাতে রেখে চাষাবাদ করার কারিগরও বটে। নারী কৃষিতে যুক্ত না হলে কৃষকের কৃষি আসা করা সম্ভব হবে না। তাই নয়াকৃষি আন্দোলনের নারীদের প্রতি একটাই চাওয়া “বোনেরা স্থানীয় জাতের হাতের বীজ হাতছাড়া করবেন না”।
নয়াকৃষি গ্রামে অভিঙ্গ কৃষকরাই পরিচালনা করেন বীজ সঙ্গ। নয়াকৃষি বীজ সঙ্গ আছে বলেই কৃষকরা দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন আনতে পারছে। কারন বীজ সঙ্গ দলগুলো প্রতিটি কৃষকের জমি ও কৃষকের বাড়িতে সরজমিনে গিয়ে কাজ করে। কমিটির সদস্যরা মূলত বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষন নিয়ম, মৌসুম ভিত্তিক পরিকল্পনা, বীজ উৎপাদন, বীজ চেনা, পরিবেশ বৈপরিত্য আবহাওয়া জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানো শস্যনির্বাচন, নয়াকৃষি নিয়মে চাষাবাদ, ১০ নীতি, প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি, খাদ্য মজুদ বাড়ানো, পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাদ্য আবাদ করা, রোগ-পোকার আক্রমনে পরামর্শ সহ বিভিন্ন পরামর্শ হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার কাজ গুলো করে। বীজ সঙ্গ প্রতি মাসে প্রতিটি বীজ আখড়ায় একটি করে মাসিক সভা করে থাকে কৃষকদের নিয়ে। এই সভাতে গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবলা করাসহ একে অন্যে মিলে বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষন, পূনরুৎপাদন ও বীজ বিনীময় করে এবং কৃষকের জ্ঞান ব্যবহার করে কৃষকের কাছ থেকে তথ্য দেওয়া ও নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই বীজ সঙ্গের ভূমিকা ও কার্যক্রম গ্রামে অনেক। পাশাপাশি গ্রামের সবাই মিলে জলবায়ু পরিবর্তনে ফসল নির্বাচনে পদক্ষেপ নীয়ে গ্রামে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছে। এছাড়াও বীজ সঙ্গের কাজের ফলে গ্রামগুলোতে সচেতনতা অনেক বেড়েছে।
নয়াকৃষি বীজঘরে বীজ রাখার একটি অংশ।
পরিশেষে নয়াকৃষির আন্দোলনের বীজ সম্পদ কেন্দ্র,বীজ আখড়া এবং বীজ সঙ্গের কাজের ফলে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে স্থানীয় জাতের হাতের বীজ টিকে থাকুক এই প্রতাশা করি।