এক সময় বাংলাদেশে ১৫ হাজার জাতের স্থানীয় জাতের ধান চাষ হতো…
বাংলাদেশে প্রায় ৮০% লোক কৃষি কাজের সাথে জড়িত। আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যর দিক দিয়ে বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় আমাদের এই দেশ ভাল অবস্থানে আছে। আর আমাদের দেশের ৭৫% জমিতে ধান চাষ হয়। আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত হওয়ার কারনে কৃষকরা ধান চাষই বেশী করেন। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতার কারনে এক সময় আমাদের এই ছোট্ট ব-দ্বীপে প্রায় ১৫ হাজার জাতের স্থানীয় জাতের ধান চাষ হতো। সেই ধানগুলো দেখতেও ছিল বৈচিত্র্যময় যেমন- লাল, কালো, সাদা, ছোট, বড়, মোটা, চিকন, গোলাকারসহ বিভিন্ন ধরনের ধান। আর ধানের নামের মধ্যেও ছিল আরো বেশি বৈচিত্র্য যেমন- কাইসা বিন্নি, দূসর, খাজা, মইজুরি, ইন্দ্রশাইল, জামাই আদুরি, বউ আদুরি, কালপাত, বাহারি, পঙ্খিরাজ, বালাম, রাজা শাইল, সাহেব চিকন, রাধুঁনিপাগল, জলকুমারি, পাটজাগ, কালামানিক, কালিজিরা, সূর্যমুখি, লালঢেপা, চিনিসাগর, বটেশ্বর, বাইলাম, কটকতারা, ঘিগজ, কলমিলতা, নয়নমনি ইত্যাদি। সেই সব ধানের মধ্যে ছিল বেশী পানির ধান (পানি বাড়ার সাথে সাথে ধান গাছও বাড়ে) খড়া এলাকার ধান, কোন ধান পানি ছাড়াও হতো, পাহারি এলাকার ধান, চর এলাকার ধান, ঠান্ডা সহনশীল ধানের জাত এবং লবন সহনশীলসহ ইত্যাদি বৈশিষ্টের ধানের জাত ।
ধান দেখতে যেমন বৈচিত্র্য ছিল খাদ্য গুনেও ছিল বৈচিত্র্যতা। কোন ধানের মুড়ি ভাল হয় আবার কোন ধানের খৈ, চিড়া ভাল হয়। এর মধ্যে পিঠা, পোলাও, পায়েশ ভাতের জন্য ছিল আলাদা আলাদা জাতের ধান। সেই সাথে বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে ছিল ধানের সর্ম্পক। বিভিন্ন ধরনের উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ধান ব্যবহার করা হতো। যেমন আদিবাসীদের বিয়েতে বিন্নি ধানের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ষাটের দশকে আধুনিক কৃষির নামে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংশ করা হয়। জানামতে ১৯৯৬ সালে একবার আর্ন্তজাতিক ধান বছর ঘোষনা করা হয়েছিল। সেই সময় উচ্চফলনশীল ধান (উফশী)প্রবর্তন করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। অথচ আমাদের দেশীয় জাতের ধানের ফলন সর্ম্পকে না জেনেই উফশী ধান প্রবর্তন করা হয়েছিল। এই নতুন প্রবর্তিত ধান কৃষকের ভাষায় নম্বরী ধান যেমন আই-আর ৮ । একে বলা হলো মিরাকল রাইস বা অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন ধান। কিন্তু এই ধানের অলৌকিক কিছুই ছিল না। এটা ছিল বামন ধান। অর্থাৎ ধানের চারা ছোট হবে। এ ধান যারা উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধান থেকে তারা খড় হতে দেবেন না। মানুষের খাদ্য চাই, গরুর খাদ্য না হলেও ক্ষতি নেই। ফলে অধিক খাদ্য উৎপাদনের কথা ফলাও করে প্রচার করলেও তাদের লক্ষ্য ছিল অধিক শস্য বা দানা পাওয়ার দিকে। এরফলে গবাদি পশুর খাদ্য অনিশ্চিত হয়ে ওঠার ফলে গবাদিপশু যে খাদ্যর গুরত্বপূর্ন উৎস সেই দিকটা চরম ভাবে অবহেলিত হয়। এই ধরনের অধিক ফলন সম্পন্ন কৃষির নাম দেয়া হলো সবুজ বিল্পব, কেউ বলেন আধুনিক কৃষি। আধুনিক কৃষি প্রর্বতনের সাথে সাথে হারাতে থাকে আমাদের বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন জাতের ধান। প্রথমে আসে উফশী (উচ্চ ফলন শীল) এরপরে হাইব্রীড। এরফলে ধান বীজ চলে যায় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে। কৃষকরা হোন বীজ ছাড়া, কৃষকদের বীজের জন্য বাজারের উপর নির্ভর করতে হয়। কৃষকরা যখন দেশীয় জাতের ধান হারিয়ে হতাশ এমন সময় নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা স্থানীয় জাতের ধান সংগ্রহ করার জন্য মাঠে নামেন। বর্তমানে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের সংগ্রহে আছে ২৩৮১ জাতের স্থানীয় জাতের ধান। এই ধান নয়াকৃষির বিভিন্ন কেন্দ্রে গবেষণা করা হয়। পরে এলাকার ধরন অনুযায়ী যে এলাকার জন্য যে জাত উপযোগি সে জাত সেই এলাকাতে দেওয়া হয়। এই জাত গুলো মধ্যে অনেক জাত আছে যেগুলো উফশী এবং হাইব্রীড ধানের তুলনায় ফলন বেশী আর খরচ নেই বললেই চলে। এই ধানের আবাদে কোন প্রকার রাসায়নিক সার ,কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। তাই এই ধানের খাদ্য যেমনি সুস্বাধু তেমনি স্বাস্থের জন্যও নিরাপদ। নয়াকৃষি কৃষকরা এই সব ধান চাষ করার কারনে যেমন রোগমুক্তি হচ্ছে, তেমনি প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমেছে গবাদি পশুপাখির খাদ্য ঘাটতি । স্থানীয় জাতের ধান চাষাবাদের ফলে হারিয়ে যাওয়া ছোট মাছও ফিরে আসছে। সেই সাথে কৃষকরা হারিয়ে যাওয়া ধানের বীজ ফিরে পাচ্ছে এবং কৃষকদের সাথে কৃষকদের আন্তসম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নয়াকৃষির কৃষকরা বাজার থেকে এখন বীজ কিনেন না। গ্রামের মধ্যে এবং গ্রামের বাহিরে এক এলাকার কৃষক অন্য এলাকার কৃষকের সাথে বীজ বিনিময় (ধান বিনিময়) করে বীজের চাহিদা পুরন করেন। আর এভাবেই ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া বৈচিত্র্যময় ধানের জাত। এক সময় ১৫ হাজার জাতের ধান চাষ হবে বাংলাদেশে এই প্রত্যাশা নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের।
“ধানে প্রাণ ধানে ধন
ধানে জ্ঞান সভ্যতা বিস্তার
স্থানীয় জাতের ধানের বীজ ধরে রাখতে
প্রত্যেকে ধানের পাহারাদার”।