বাংলাদেশে আউশ ধানের আবাদ


ধান বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য শস্য। পল্লী অঞ্চলে প্রায় ৪৮% মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ধান চাষ। মানুষের আমিষের চাহিদার প্রায় অর্ধেক এবং ক্যালোরী চাহিদার প্রায় এক তৃতীয়াংশ ধান থেকে আসে। কৃষি খাতে জিডিপির প্রায় অর্ধেক ধান থেকে পাওয়া যায়। জাতীয় জিডিপির প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ ধান থেকে আসে। সনাতন কাল থেকে বাংলাদেশে তিনটি ধানের মৌসুম চলে আসছে – আউশ, আমন এবং বোরো। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সেচ নির্ভর ইরি বোরো ধান প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত আমন এবং আউশ ছিল ধানের প্রধান ফসল । বোনা আমন চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বীজ বপন করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাঁকা ধান কাটা হয়। রোপা আমন জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসে বীজ তলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপা কার হয় এবং অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে ধান কাটা হয়। বোরো ধান প্রধানত: সেচ নির্ভর। কার্তিক মাস থেকে বীজ তলায় বীজ বপন শুরু হয়। ধান কাটা চলে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য পর্যন্ত। উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান প্রবর্তনের পর থেকে ধান আবাদ তথা সমুদয় কৃষি ব্যবস্থার মস্তবড় একটা পরিবর্তন এসেছে। ফলে একদিকে যেমন আউশ ধানের আবাদ আশংকাজনকভাবে কমে এসেছে, তেমনি রবি মৌসুমে প্রচলিত ফসল যেমন ডাল, তৈল বীজ, শাক সবজি, ফলমূল, গোলআলু, মসলা ইত্যাদির আবাদ কমে এসেছে। প্রচলিতভাবে মাঝারি ও উচু জমিতে রবি মৌসুমে ডাল, তৈল বীজ, শাক সবজি, ফলমূল, মসলা, গোলআলু, মিষ্টি আলুর আবাদ চলে আসছিল। রবি শস্য তোলার পরে ঐসব জমিতে খরিফ - ১ মৌসুমে পাট ও আউশ ধানের আবাদ হত। পাট ও আউশ ধান কাটার পরে আমন ধান রোপন করা হত। তবে ইরি বোরো ধানের প্রবর্তনের পর থেকে ফসল চক্র পরিবর্তন হয়েছে। চৈত্র -বৈশাখ মাসে বোরো ধান কাটার পরে ৩-৪ মাস জমি অনাবাদি থাকে। যদিও মাঠে বৃষ্টি নিভৃর আউশ ধান আবাদের অবস্থা বিরাজ করে। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ব্যাপক এলাকায় ইরি বোরো আবাদের ফলে আউশ ধানের আবাদ প্রায় উঠেই গিয়েছে, এমনকি আউশ ধানের অনেকজাত ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ডেভলপমেন্ট ফান্ড, নরওয়ে এবং লিবার্ড, নেপালের সহযোগিতায় নয়াকৃষি আন্দোলন, উবিনীগের উদ্যোগে ২০১১ মৌসুম থেকে আউশ ধানের সনাতন অঞ্চলে বোরো ধান কাটার পরে আউশ ধানের আবাদ প্রচলনের জন্য নয়াট বাছাই করা জাত নিয়ে আউশ ধানের মাতৃ ও শিশু পরীক্ষা (Mother and Baby Trial) শুরু করা হয়েছে। ২০১২ মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল ও কক্সবাজার এলাকায় নয়াকৃষি কৃষকের মাঠে এ পরীক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে মাঠে আউশ ধানের নির্বাচিত নয়টি জাতের বীজ বপন করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত নীচু জমিতে বীজ তলায় চারা করে পরে মূল জমিতে মাঠে চারা রোপন করা হয়েছে। এ পরীক্ষায় আউশ ধানের মোট নয়টি জাত যেমন: শনি, ষাইটা, ভইরা, শঙ্ক পটি, কালা বকরি, খাড়াজামড়ি, মুলকে আ উশ, কালামানিক ও ভাতুরি রয়েছে। আউশ ধানের মাতৃ ও শিশু পরীক্ষায় ধানের ফলন, খড়ের ওজন, ধান থেকে চাল উৎপাদনের হার (milling recovery rate of rice), চালের মান, বাজার চাহিদা, মাঠে গাছ হেলে পড়ার প্রবনতা, খরা সহিঞ্চতা, পানি সহিষ্ণুতা, রোগ, পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা, চিটার শতকরা হার, ধান ঝরে পড়াসহ ফলন ও মান সম্পর্কে যাবতীয় তত্ব লিপিবদ্ধ করা হবে। আশা করা যায় এ পরীক্ষায় স্থানীয় জাতের আউশ ধানের মধ্য থেকে আবহাওয়া পরিবর্তনসহ অন্যান্য পরিবেশ প্রতিকূলতা প্রতিরোধ ক্ষমতা, ফলন ও মান সম্পন্ন আউশ ধানের জাত বাছাই করা সম্ভব হবে। যে জাত বোরো ধান কাটার পরে খরিফ-১ মৌসুমে বপন/রোপন করা যাবে। বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবে ভাল ফলন দেবে এবং আউশ ধান কেটে খরিফ-২ মৌসুমে আমন ধান রোপন করা যাবে। দ্বোফসলী জমি তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করে খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনে সহায়ক হবে।

Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter