কুষ্টিয়ার মিরপুরে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস, ২০১৪ পালিত হয়
‘সর্বনাশা তামাক চাষ থেকে সরে এসে খাদ্য শস্য উৎপাদন করুন’
গত ৩১শে মে, বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের বড় বাড়িয়া গ্রামে উবিনীগ (নয়া কৃষি আন্দোলন) এর আয়োজনে, ‘তামাকের উপর কর বাড়াও, রোগ মৃত্যুর হার কমাও’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে একটি র্যালী ও আলোচনা সভা করা হয়। উক্ত র্যালী ও আলোচনা সভায় বড়বাড়িয়া গ্রাম ও তার আশে পাশের গ্রাম থেকে কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, সমাজসেবক, ইউপি মেম্বার এবং নারী পুরুষ সহ ২৫০ জন লোক উপস্থিত ছিলেন।
র্যালীটি বড় বাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়ে আমিন বাজার হয়ে ১ কিলোমিটার পথ আতিক্রম করে পূনরায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এসে র্যালীটি শেষ হয়। বিদ্যালয়ের মাঠে সদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান মেম্বার হাবিবুর রহমানকে সভা প্রধান করে, উবিনীগের কর্মী মোস্তক আহাম্মেদ এর পরিচালনায় একটি আলোচনা সভা করা হয়। বক্তব্য রাখেন- উবিনীগ কুষ্টিয়া কেন্দ্রর সম্বনয়ক অধীর চন্দ্র দাস, নয়াকৃষির কৃষক আছির উদ্দিন বিশু, সাবেক ইউ পি সদস্য আব্দুল মান্নান, সমাজ সেবক কাজেম উদ্দিন, কাতলামারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারুক আহম্মেদ এবং উবিনীগের মাঠ পর্যায়ের গবেষক শিউলি খাতুন ও আমিনুল ইসলাম গাইন ।
অধীর চন্দ্র দাস বলেন, তামাক কোন খাদ্য নয়, কিন্তু তামাক চাষ করে এই এলাকায় আপনাদের জমি,স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে হলে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। এখনও সময় আছে সর্বনাশা তামাক চাষ থেকে সরে এসে খাদ্য শস্য উৎপাদন করে নিজে ভাল থাকুন এবং পরিবেশকে ভাল রাখুন।
নয়াকৃষির কৃষক আছির উদ্দিন বিশু বলেন- আমি একজন ভূক্ত ভূগি কৃষক।আমি ৮ বছর তামাক চাষের সাথে জড়িত ছিলাম। নিজে তামাকের চাষ করতাম। তামাকের চাষে যে ক্ষতি সেটা আমার চাইতে অন্য কেউ বেশি জানে না। তামাক চাষ করতে গিয়ে আমি আমার জমির উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়েছে। প্রথম যখন তামাক চাষ শুরু করলাম তখন ২-৩ বছর তামাকের ফলন খুব ভাল হতো তারপর থেকে ধীরে ধীরে ফলন কমতে শুরু করে। যখন আমি বুঝতে পারলাম তামাক চাষ করে মাটির শক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। তখন থেকেই আমি তামাক চাষ বন্ধ করে দেই। তামাক চাষ শুধু আমার জমির ক্ষতিই করে নাই স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করেছে। আমি তামাকের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন রোগ আক্রান্ত হইতাম।গত ৫ বছর ধরে আমি তামাক চাষ বাদ দিয়ে খাদ্য ফসল করা শুরু করছি। নয়াকৃষি পদ্বতিতে চাষাবাদ করে আমি আমার জমির উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনতে পেরেছি এবং বিভিন্ন ধরণের রোগ থেকে দূরে আছি। উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন আপনারা আমার মতো তামাক চাষ বাদ দিয়ে খাদ্য ফসল চাষে ফিরে এসে নিজে ভাল থাকেন এবং পরিবারের সকলকে ভাল থাকার সুযোগ করে দেন ।
আব্দুল মান্নান (সাবেক ইউপি সদস্য )- বলেন তামাক চাষ করা এবং তামাক সেবন করা উভয়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতি কর। এই ক্ষতিকর পথ থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে তা না হলে আমাদের যুব সামাজ ধীরে ধীরে ধংসের পথে চলে যাবে। আজকের যুব সমাজ তামাকজাত দ্রব্য যেমন- বিড়ি, সিগারেট সেবনের পাশাপাশি নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের দিকে ঝুকে পড়ছে। দেশের যুব সমাজকে বাচাঁতে হলে সরকারকে তামাকজাত দ্রব্যের উপর অধিক পরিমানে কর বসাতে হবে। তামাক চাষ যে ক্ষতি করছে সেটা থেকে আমাদের পরিবেশ এবং কৃষিকে বাচাঁতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার যদি তামাক কোম্পানীর কাজ বন্ধ করে দেয় তাহলে এমনিতেই তামাক চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। যারা তামাক চাষ করেন তারা যদি সচেতন হয়ে তামাক চাষ বন্ধ করে দেয় তাহলেও ভাল প্রভাব পড়বে। আমাদের দেশ ও কৃষি এবং কৃষককে বাচাঁতে হলে আবশ্যই তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে ।
কাজেম উদ্দিন (সমাজ সেবক )-বলেন ফসল উৎপাদন করার আগে আমাদের বুঝতে হবে কোন ফসল করলে আমরা সুস্থ থাকবো এবং আমাদের জীবন ভাল থাকবে। তামাক যদিও অর্থকরী ফসল কিন্তু এর ক্ষতির দিকটা অনেক বেশি।তামাক চাষ করে আমরা মাটির যে ক্ষতি করতেছি এর জন্য আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যদা দিতে জানিনা। তামাক চাষ করতে করতে যখন মাটির উর্বরতা একেবারে শেষ হয়ে যাবে তখন আর আমাদের কোন উপায় থাকবে না। তামাক চাষ আসার আগে আমাদের এলাকায় বিভিন্ন ধরণের চৈতালী ফসলের চাষ হতো যেমন- গম, সরিষা, রাই, মুসুর খেসারী ছোলা,মটর ইত্যাদি। তখন মাটির উর্বরতা শক্তি অনেক বেশি ছিল, যার ফলে ফসলের ফলনও বেশি হতো। তামাক চাষের কারণে বর্তমানে আমরা চৈতালী ফসলগুলো হারিয়ে ফেলেছি। যার ফলে আমরা ভারতীয় শস্যের উপর নির্ভরশীল হচ্ছি। যেমন-ভারতের মসুর ডাল আমরা ১২০টাকা দরে কিনে খাচ্ছি। আমাদের প্রত্যেকেরই তামাক চাষ বাদ দিয়ে খাদ্য শস্য উৎপাদনের দিকে ফিরে আসতে হবে। চৈতালি ফসল আমাদের বাপ দাদার আমলের ফসল তারা এই ফসল চাষ করে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পেরেছেন। আমাদের সেই পথ ধরতে হবে তা না হলে আমাদের ভবিষৎ খুবই অন্ধকার।
ফারুক আহাম্মেদ (শিক্ষক কাতলামারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়) বলেন তামাক চাষ এমন একটা চাষ যার কারণে লেখা পড়া থেকে অনেক ছেলে মেয়েরা অকালেই ঝড়ে পড়তেছে। কারণ তামাক মৌসুমে তামাকের জমিতে অধিক পরিমানে শ্রম দিতে হয়। তামাকের ফসলকে ভাল ভাবে ঘরে তোলার জন্য পরিবারের সকলেই তামাকের কাজে লিপ্ত থাকে। বিশেষ করে তামাক পাতা ভাঙ্গা, ষ্টিক বাধা, পাতা পোড়ানো,তামাক বাছাই করা এসব কাজে পরিবারের শিশুরা ব্যস্ত থাকে। যার কারণে ঐ সময় স্কুলে ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতি সংখ্যা খুবই কম থাকে। এতে দেখা যায় ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘ দিন স্কুলে না যাওয়ার কারণেই অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।তামাক চাষ শুধু পরিবেশ, মাটি ও স্বাস্থ্যের ক্ষতিই করেনা,এই চাষ ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ভবিষৎ জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সুতরাং আমাদেরকে তামাক চাষ বন্ধ করে খাদ্য উৎপাদনের দিকে চলে আসতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
শিউলি খাতুন (কৃষক গবেষক উবিনীগ)- বলেন তামাক চাষে টাকা পাওয়া যায় কিন্তু এই চাষ করতে গিয়ে মহিলারা বিভিন্ন ধরণের কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে যেমন- মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, চোখ জ্বালাপোড়া, চুলকানি, দাউদ, শ্বাসকষ্ট, গ্যাষ্ট্রিক ইত্যাদি। এসব রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন গত ২ বছর তামাক চাষে স্বাস্থ্যের ক্ষতি বিষয়ক গবেষণার ফলোআপের কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে তামাক চাষ করে যে টাকা আয় করে, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়। আমাদের এলাকায় গরীব মেয়েরা তামাক চাষীদের বাড়ীতে তামাকের ষ্টিক বাধা, তামাক পোড়ানোর কাজ করে এবং তারা তামাকের ডিপুতে তামাক বাছাইয়ের কাজ করে। এতে দেখা যাচ্ছে পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যেসব মহিলারা তামাকের কাজের সাথে জড়িত তাদেরকে বলি আপনারা তামাকের কাজ করবেন না।
আমিনুল ইসলাম গাইন (মাঠ পর্যায়ের গবেষক, উবিনীগ) বলেন,আপনারা সবাই বলেন তামাক চাষ জমি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সবকিছুরই ক্ষতি করে। তাহলে আপনারা তামাকের চাষ করেন কেন। আপনারা বলেন তো তামাক চাষ করে কয়জন তামাক চাষী টাকার মালিক হয়েছেন। কেহই হতে পারেন নাই, টাকাওয়ালা হয়েছে ব্যসায়ীরা, টাকাওয়ালা হয়েছে কোম্পানীর দালালরা। আমাদের এলাকায় খাদ্যের অভাব ঘটিয়েছে তামাক চাষ। তামাক চাষের কারণে মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য অন্য এলাকা থেকে খাদ্য আনতে হয়। মানুষের খাদ্যের চেয়ে গো-খাদ্যের অভাব বেশি দেখা দিয়েছে। তামাকের গাছ পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমি এক জন তামাক চাষী ছিলাম,গত ১০বছর যাবৎ আমি তামাক চাষ বাদ দিয়ে খাদ্য শস্য উৎপাদন করতেছি। এবছর আমি ২বিঘা জমিতে গমের চাষ করেছিলাম (১ বিঘা=৩৩শতাংশ) প্রতি বিঘায় ১৬ মণ করে গমের ফলন হয়েছে এবং এক বিঘা জমিতে মসুর চাষ করেছিলাম এতে ৮মণ মসুর হয়েছে। বর্তমানে প্রতি মণ গমের দাম ১০০০/= প্রতি মন মসুরের দাম ২৬০০/=। অথচ এই ৩ বিঘা জমি আবাদ করতে খরচের পরিমাণ খুবই কম লেগেছে।কুষ্টিয়া জেলায় সর্বপ্রথম দৌলতপুর উপজেলায় তামাকের চাষ শুরু হয়েছিল,বর্তমানে দৌলতপুরে তামাকের চাষ অনেক কমে গিয়েছে কারণ কৃষকরাই বুঝতে পেরেছে যে, তামাক চাষে জমি, পরিবেশ, গাছপালা, মানুষের স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আজকের এই বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসের র্যালী ও আলোচনা সভায় উপস্থিত সকলকেই আমার পক্ষ থেকে বলছি আপনারা তামাক ছেড়ে খাদ্য উৎপাদনে ফিরে আসুন।
প্রতিবেদকঃ মোস্তাক আহাম্মেদ, আখড়াবাড়ী, কুষ্টিয়া