উবিনীগ সম্পর্কে


‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা’ (উবিনীগ) শুরু হয়েছে ১৯৮৪। দাতা সংস্থাগুলো উন্নয়নের যে ধারণা চাপিয়ে দিচ্ছিলো সেইসব ধারণা ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার তাগিদ থেকে একটি পাঠচক্র থেকে এটি শুরু হয়। একটা পর্যায়ে শুধু কথা নয় কাজও করা দরকার এই চিন্তা আসার পর গ্রাম পর্যায়ে কাজের ইচ্ছাটাও জাগে। সে সময় অন্যান্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা এনজিওরা ব্যস্ত ছিল উন্নয়নের সেবা পৌঁছে দেবার জন্যে, কেউ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কেউ আয় বাড়াবার জন্যে ঋণ দিচ্ছে, কেউ দরিদ্র মানুষকে সচেতন করছে তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য। এই সময় দাতা সংস্থা হিশেবে বিশ্ব ব্যাংক সক্রিয়ভাবে “প্রেসক্রিপশান” দিচ্ছে রপ্তানীমূখী উন্নয়ন নীতি অবলম্বনের জন্য। তৈরী পোশাক শিল্প গড়ে তোলা এবং চিংড়ি রপ্তানির কাজ খুব গুরুত্বের সাথে করা হচ্ছিল। পাশাপাশি জনসংখ্যাকে দেশের ‘এক নম্বর’ সমস্যা হিশেবে চিহ্নিত করে গরিব নারীদের বন্ধ্যাকরণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগের কর্মসুচি চলেছে। অন্যদিকে কৃষিতে প্রাণ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কৃৎকৌশল প্রয়োগ করে ধান উৎপাদন বাড়াবার চেষ্টা চলছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড আসলেই কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে আমরা ভাবতে শুরু করি। প্রথমত ধারণাগত দিকগুলো পর্যালোচনা করি। যেমন ‘উন্নয়ন’ কথাটা বলতে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলো আসলে কী বোঝায়, এর সামাজিক চরিত্রটা কী দাঁড়াবে। একটা বিশেষ ধরণের পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রবর্তন করা হচ্ছে, বাজার অর্থনীতির সুফলও যদি আমরা পেতে চাই তাহলে এই বিশেষ অর্থনৈতিক চরিত্র আমাদের কাম্য কিনা। এর সঙ্গে ছিল নারীর দিক থেকে বিবিধ প্রশ্ন তোলা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের ভূমিকা ইত্যাদি। এভাবে নানান দিক খতিয়ে দেখার জন্য উবিনীগ কিছু গবেষণা কাজ হাতে নেয়।এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যেই উবিনীগের শুরুতে নামের সাথে জুড়ে রয়েছে বিকল্পের কথা। ‘বিকল্প উন্নয়ন’ নয়, ‘উন্নয়ন বিকল্পের...’ – অর্থাৎ উন্নয়নের প্রথাগত চিন্তার বাইরেও আমরা দেশ ও দশের উন্নতির কথা ভাবতে পারি। আসলে ইংরেজি ‘ডেভেলপমেন্ট’ শব্দটির অনুবাদ করে ‘উন্নয়ন’ শব্দটির ব্যবহার আমরা পছন্দ করি নি। বাংলায় ‘উন্নতি’ শব্দটি আরও অনেক শক্তিশালী ধারণা। আমাদের ‘উন্নত’ হওয়া দরকার, ‘উন্নতি’ প্রয়োজন, ইত্যাদি। এইভাবেই উবিনীগের যাত্রা প্রশ্ন দিয়েই।

গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনে এই প্রশ্নগুলোর কিভাবে প্রতিফলন ঘটে উবিনীগ দেখার চেষ্টা করেছে প্রথম থেকেই। তাই শহরে বসে একাডেমিক গবেষণা নয়, গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, তাঁতীসহ সব ধরণের মানুষের সাথে সরাসরি কাজ করাই ছিল মুল কাজের ধারা।এই কাজের মধ্য দিয়েই তাদের সমস্যা সম্পর্কে জানার এবং সমাধানের পথ বের করার চেষ্টা করা হয়।শুরু থেকেই আমরা গ্রামমুখী কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। এই সময়, উবিনীগের কর্মীরা প্রায় সকলেই তরুণ বয়সের। কাজে কোন আলস্য নেই। দিন রাত অবিরাম কাজ করে অল্প সময়েই পরিচিতি লাভ করতে সমর্থ হই। উন্নয়নের নীতি পর্যালোচনা করে তার ব্যাপারে নিজেদের মতামত তৈরির জন্যে নিয়মিত ‘পাঠশালা’ করা হয় উবিনীগের কর্মীদের নিয়ে। এই পাঠশালা এখনো মাসের শেষ শুক্রবার নিয়মিতভাবে হচ্ছে। তাই নতুন প্রজন্মের উবিনীগ কর্মীরা একইভাবে গড়ে উঠছেন।

প্রথম থেকেই আমরা চেয়েছি নারীদের দৃষ্টিতে উন্নয়ন কর্মসুচি পর্যালোচনা করা। তার মানে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করা। এই গোড়ার জায়গা বাদ দিয়ে উন্নয়নের সকল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ কিম্বা চিন্তা ও কর্মসূচির সামগ্রিকতার মধ্যে নারীকে না রেখে তার সমস্যাকে আলাদা ভাবে মোকাবিলার পদ্ধতি আমাদের কাছে সঠিক মনে হয় নি। নারী সকল কিছুর মধ্যে একাত্ম হয়ে আছেন, তাকে আলাদাভাবে দেখা বিশেষ ক্ষেত্রে দরকার হতে পারে, কিন্তু উন্নয়নের মূল চিন্তা, নকশা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির মধ্যে যদি নারী না থাকে তবে আলংকারিক ভাবে নারীর জন্য আলাদা কর্মসূচি কোন ফল দেয় কিনা সন্দেহ।

উন্নয়ন নীতিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসুচীকে সাজানো হয়েছে বিদেশ থেকে আনা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধ্বতি বিতরণ করার জন্যে; বিশেষ করে গরিব নারীদের মধ্যে। সেটা তাদের শরীরের জন্য উপযুক্ত হোক বা না হোক। তাদের জোর করে ধরে বন্ধ্যাকরণ করা হয়।এই বিষয়গুলো তুলে ধরা আমরা শুরুতে জরুরী মনে করে বিস্তারিত গবেষণা করেছি।

দীর্ঘ দিন গ্রাম পর্যায়ে মানুষের সাথে কাজ করে আমাদের উপলবদ্ধ্বি হয়েছে যে বাংলাদেশ গরিব থাকার কথা নয়।আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ যা রয়েছে, খাদ্য উৎপাদনের যে সুযোগ রয়েছে এবং মানুষের যে কর্ম ক্ষমতা আছে তা এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।আশির দশকে আমরা দেখেছি দাতা দেশগুলো আমাদের পরামর্শ দিয়েছে শুধু রপ্তানির জন্যে আমাদের সস্তা শ্রম খাটাতে হবে, যেমন গার্মেন্ট শিল্প স্থাপন করতে হবে এবং প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া চিংড়ীকে সমুদ্র থেকে নিংড়ে নিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। শ্রমিকের অধিকার দেয়া যাবে না, আর পরিবেশের কথা ভাবলে চলবে না।বিদেশকে খুশি করার জন্যে যতটুকু করার দরকার শুধু ততটুকু করতে হবে।

আশির দশকের শেষে এবং নব্বুইয়ের শুরুতে আর একটি দিক ছিল; আমদানী উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল।গ্যাট বিলুপ্ত করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর সাথে কৃষি চুক্তির মাধ্যমে কৃষি পণ্য আমদানীর পথ খুলে দেয়া হোল। পেঁয়াজ থেকে শুরু চাল ডাল সবই বিদেশ থেকে আসতে লাগলো আর কৃষকের সর্বনাশ হোল। এদিকে দীর্ঘদিন আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে (অর্থাৎ সার-কীটনাশক ও ভুগর্ভস্থ পানি) চাষাবাদ ক্রমে কৃষকের জন্যে ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে উঠলো। বিশ্ব ব্যাংক সাফ জানিয়ে দিল সার ভর্তুকী তুলে নিতে হবে।ফলে কৃষকের জন্যে সারের দাম আরও বেড়ে গেল, উৎপাদন খরচ বাড়ল। বাড়তি উৎপাদন খরচের বোঝা নিয়ে বাজারে আমদানী করা ‘সস্তা’ আন্তর্জাতিক কৃষি পণ্যের সাথে পেরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়লো।বিদেশের কৃষি পণ্য সস্তা হওয়ার প্রধান কারণ ছিল যে বড় বড় কোম্পানীকে রপ্তানী ভর্তুকী দেওয়া। তারা প্রকৃত খরচের চেয়ে কম দামে তাদের পণ্য আমাদের দেশে রপ্তানি করতে পারে।

কৃষির এই বেহাল অবস্থায় ক্ষুদ্র কৃষকরা খুব বিপদে পড়ে গেলেন। উবিনীগ সে সময় একদিকে প্রাণবৈচিত্র ও পরিবেশ রক্ষার প্রেক্ষিতে আধুনিক কৃষির বিরোধিতা করেছে, অন্য দিকে কৃষকের জীবন জীবিকা রক্ষার জন্যে নগদ টাকা খরচ না করে নিজের শ্রম, জ্ঞান ও স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো কৃষি ব্যবস্থার পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলো।এরই ফলশ্রুতিতে নব্বুইয়ের শুরুতে নয়াকৃষি আন্দোলন নামে প্রাণবৈচিত্র্য-নির্ভর কৃষি আন্দোলন শুরু হোল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষুদ্র কৃষক ও নারী কৃষকরা। তাঁরা শুরু থেকে স্থানীয় বীজ রক্ষার জন্যে কাজ শুরু করলেন।আধুনিক কৃষির কারণে মাত্র ৪০-৫০টি ধানের চাষ হলেও এদেশে ধানের জাত একসময়ে ছিল ১৫,০০০ টি। নয়াকৃষির কৃষকরা আউশ, আমন ও বোরো ধান মিলে প্রায় ৩০০০ জাতের ধান সংগ্রহ করে রেখেছেন বীজ সম্পদ কেন্দ্রে। কৃষক নিজ নিজ বাড়ীতে বীজ রক্ষা করছেন এবং কয়েকটি গ্রাম মিলে একটি বীজ আখড়া স্থাপন করে শত শত জাতের বীজ সংগ্রহ করে রাখছেন। শুধু ধান নয়, ডাল, সবিজ, ফল, মসলাসহ প্রয়োজনীয় সকল ধরণের বীজ সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং কৃষকদের মধ্যে বিনিময় ও বিতরণ করা হচ্ছে।ফলের মধ্যে আমের জাত সংগ্রহ একটি অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে নেয়া হয়। এখন নয়াকৃষির সংগ্রহে ৫৪৭ জাতের আম গাছ আছে, ফল এসেছে প্রায় ৩০ জাতের। কোন প্রকার সার-কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই এসব জাত চাষ করা যায়, তাই কৃষকের আগ্রহ অনেক বেশী।কৃষকরা আগ্রহ ভরে একে অপরের কাছ থেকে নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি পরিবার নয়াকৃষি পদ্ধ্বতিতে চাষাবাদ করছেন এবং তাদের এই চাষাবাদের কারণে একই সাথে প্রাণবৈচিত্র রক্ষা হচ্ছে।একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, নয়াকৃষির নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানত নারী কৃষক।

খাদ্য সার্বভৌমত্বের ধারণা বিশ্বব্যাপী বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।যারা কৃষকের সার্বভৌম অধিকারে বিশ্বাস করেন বিশ্বব্যাপী তাঁরা “খাদ্য নিরাপত্তা” নামক বাজার নির্ভর খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের বিপরীতে খাদ্য সার্বভৌমত্বের দাবী তুলছেন, যেন প্রত্যেক দেশের কৃষক নিজ দেশের প্রয়োজন, সংস্কৃতি, উৎপাদন পদ্ধতি অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারেন এবং তাদের যেন বাজার নির্ভর হতে না হয়। উবিনীগ ১৯৯৬ সাল থেকে খাদ্য, পরিবেশ ও সংস্কৃতি বিষয়ক দক্ষিণ এশীয় নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এই আন্দোলনে শরিক থেকে কাজ করছেন। কাজেই কৃষকের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়াকৃষি আন্দোলনের একটি নিয়মিত কাজ। আর তাই কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির নামে যখন হাইব্রিড বীজ এবং জেনেটিকালী মডিফাইড বীজের প্রবর্তন করা হয় তখন নয়াকৃষির কৃষক এবং উবিনীগ যৌথভাবে প্রতিবাদ করে। আমাদের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশে উচ্চ ফলনশীল এবং নানা ধরণের দুর্যোগ সহনশীল, (বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, শীত) স্থানীয় অনেক জাত আছে যা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু তা না করে যখন বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে নিজ দেশের বীজের স্বত্ব বিক্রি করে দেয়া হয় তখন তা ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কৃষক তার অধিকার হারাবে এবং দেশ হিশেবে আমরা কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে পড়বো।উবিনীগ তাই ‘গোল্ডেন রাইস’ নামক তথাকথিত ভিটামিন-এ সম্মৃদ্ধ্ব ধান, বিটি বেগুন ও অন্যান্য জেনেটিকালী মডিফাইড বীজের প্রবর্তনের বিরোধিতা করেছে।

বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের সাথে কাজ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে জানা গেল, উর্বর খাদ্য ফসলের জমিতে অর্থকরী ফসল হিশেবে তামাক চাষ হচ্ছে ব্যাপকভাবে এবং কৃষকরা মাটির ক্ষতি, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি জেনেও এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছেন না। কুষ্টিয়া ও বান্দরবান এলাকার কৃষকদের অনুরোধে উবিনীগ তামাক চাষের ক্ষতি এবং খাদ্য ফসল চাষের সম্ভাবনার দিক নির্ণয়ের জন্য ২০০৬ সাল থেকে চার বছর গবেষণা কাজ পরিচালনা করে।যেসব কৃষক তামাক চাষের কারণে অতীষ্ঠ হয়ে বের হয়ে আসতে চাচ্ছেন তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার মাধ্যমে তামাক চাষ বন্ধ করে খাদ্য ফসল উৎপাদন করা হয়। এই গবেষণার ফলাফল সম্বলিত ‘তামাকের শৃংখল থেকে মুক্তি’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ বের হয়েছে। এই ব্যাপারে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধ্বান্ত নেয়ার সময় হয়েছে যে খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ করতে দেয়া কতখানি নৈতিক।তামাক চাষের জন্য সরকারের সার-সেচের সুবিধা এবং ঋণ সুবিধা দেয়া আদৌ যৌক্তিক কিনা।

কৃষির পাশাপাশি শুরু থেকেই উবিনীগের গবেষণার একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক ছিল তাঁত শিল্পের সম্ভাবনা যাচাই করা।এদেশে তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য অনেক পুরণো।সেই ব্রিটিশ আমলে মসলিনের মতো মিহি কাপড় উৎপাদন করে মানচেস্টারের বাজারে কাপড় বিক্রি করা হোত।জমিদারদের জন্যে মিহি কাপড়ে নকশী কারুকাজ টাঙ্গাইলের তাঁতীরা করেছেন।কিন্তু তাঁত শিল্পএমন ঐতিহ্যের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও আশির দশকে টাংগাইলের তাঁতীদের বেকার অবস্থা দেখে উবিনীগ কিছু গবেষণার কাজ করল। সেই গবেষণায় দেখা গেল যে তাঁত শিল্পের এই দুর্ভোগের পেছনে দুটো কারণ স্পষ্ট। একটি হচ্ছে, সরকারীভাবে এই শিল্পকে কোন ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় না। তাঁতীদের সুতা, রং, ডিজাইন ইত্যাদীর ক্ষেত্রে কোন সহায়তা নাই, মহাজন নিজের মতো করে বাজারের চাহিদা নি্রূপন করে কাপড় বুনতে দেন। তাতে করে সব সময় পরিবর্তনশীল বাজারের চাহিদার সাথে তাঁতীদের বোনা শাড়ী ও কাপড় বাজারে বিক্রি হয়না। তাঁতীরা বিপাকে পড়েন। তাছাড়া তাঁতীরা কাপড় বিক্রির ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন সহায়তা পান নাই, ফলে অতি কষ্টে বোনা কাপড় বিদেশ থেকে বিশেষ করে ভারতের কাপড়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারে না। দামের দিক থেকে এবং চাক-চিক্যময় ডিজাইনের সাথে পেরে উঠতে না পেরে তাঁতীরা নিজেদের বোনা কাপড় নিয়ে বসে থাকেন।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আমাদের সমাজে যাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে, তাদের মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ অর্থাৎ নাগরিক দায়দায়িত্ব বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ নাই। নিজ দেশের বোনা কাপড় বা ফসল ভোগ করার সাথে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে, এই কথা ভেবে কেউ তাঁর নিজের দেশে তৈরী কাপড় বা খাদ্য যদি না কেনেন, তাহলে তাঁর নাগরিক দায় উপলব্ধির ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে বলতে হবে। দেশপ্রেম কথাটা তো বিমুর্ত কিছু নয়। আমাদের জীবনযাপনের মধ্যেই তা ফুটে ওঠে। আমাদের রাজনীতিবিদরাও এ ব্যাপারে সচেতন নন। ১৯৮৭ সালের দিকেই তাঁত শিল্প নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে উবিনীগের এই উপলব্ধি হয়েছিল। এই সময় তাঁতীদের একটি সভায় যখন জিজ্ঞেস করা হোল আমরা কী করতে পারি। উত্তর এলো, “আমাদের কাপড় বিক্রির ব্যবস্থা করেন”। টাঙ্গাইলের তাঁতীদের এই আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৮৯ সালে প্রবর্তনা প্রতিষ্ঠা করা হয়। আপাত দৃষ্টিতে এটা কাপড় বিক্রয়ের জায়গা হলেও এটা হয়ে গেল সাথে তাঁতী, কাপড় ব্যবহারকারী ভোক্তা, বিশেষ করে নারীরা, এবং নীতি নির্ধারণী মহলের সংযোগস্থল। ‘প্রবর্তনা’+র ইতিহাস ব্যবসার ইতিহাস নয়, বরং দেশীয় শিল্পের বিকাশের ইতিহাস। এরই পরের ধাপ হচ্ছে দেশী দশের সাথে প্রবর্তনার কাজ। অর্থাৎ আরও যে নয়টি প্রতিষ্ঠান দেশীয় কাপড়ে ও কারু শিল্পের প্রসারে নেমেছেন তাদের কাজে উৎসাহ দেওয়া।

প্রবর্তনার সাথেই গড়ে উঠেছে নারীদের জন্যে এবং নারীদের দ্বারা রচিত বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রয় কেন্দ্র, নাম নারীগ্রন্থ প্রবর্তন। নারীগ্রন্থ আজ অনেক ব্যাপক আকারে কাজ করছে। সারা দেশব্যাপী প্রায় ৪৫টি জেলায় নারী সংগঠন ও লেখিকাদের সাথে।নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা বেগম রোকেয়ার রচনার চটি বই প্রকাশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে এক হাজারের অধিক। নারী ও প্রাণ বৈচিত্র নেটওয়ার্ক এবং তামাক বিরোধী নারী জোটের (তাবিনাজ) সচিবালয় হিশেবে কাজ করছে।

বিভিন্ন জনগোষ্ঠির সাথে কাজ করতে গিয়ে শহরে পোশাক শিল্প শ্রমিক এবং নির্মাণ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ আমাদের দীর্ঘদিনের, বলতে গেলে উবিনীগের শুরু থেকে। প্রথম অবস্থায় পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরী, শ্রমিক হিশেবে স্বীকৃতি নিয়ে কাজ হয়েছে।১৯৯৪ সালে সারাকা গার্মেন্টের আগুনের ঘটনায় শ্রমিক মারা যাওয়া এবং কারখানায় তালা দেয়ার ব্যাপারে আমরা সোচ্চার হই। কারখানার গেটে তালা না খোলার কারনে পদ দলিত হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু মানবিকতার লংঘন। কিন্তু আমরা দেখেছি এই অবস্থা এখনো চলছে, এবং ২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টে আগুনের ঘটনায় শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু একই কারনে। কাজের পরিবেশ উন্নত করা শ্রমিকের ন্যায্য মুজুরীর দাবী আমরা তুলেছি।রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমিক আহত ও নিহত হয়েছেন- এবিষয়েও আমাদের বিস্তারিত কাজ চলছে।

বিভিন্ন অবস্থায় মানুষ তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে।প্রতিষ্ঠান হিশেবে আমরা বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়ে তাদের সাথে কাজ করছি। উবিনীগের কাজের ক্ষেত্র ও বিস্তার অনেক, সব স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। তবে যা সহজেই বলা যায় তা হচ্ছে, উবিনীগ মানুষের সাথে কাজ করে, প্রথাগত চিন্তার পর্যালোচনার জন্য মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগায়। আর ঠিক সেখানেই উবিনীগের শক্তি।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।