নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় লেখিকাদের সভা


শুধু নারী নির্যাতন নয়, নারীকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্যান্য বিষয়ে বর্তমান সমাজে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা নিয়ে লেখিকারা কি ভাবছেন এবং করণীয় কি সে বিষয়ে ২২ আগস্ট, ২০১৭ বিকেল ৩:৩০ টায় ঢাকায় নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কবি এবং লেখিকাদের নিয়ে এই সভায় উপস্থিত ছিলেন-সুফিয়া রহমান, মালেকা ফেরদৌস, ড. সৈয়দা মোতাহেরা বানু, প্রফেসর অনামিকা হক লিলি, নাজমা আরেফিন, লিলি হক, রিফাত আরা শাহানা। আরও উপস্থিত ছিলেন সোমবারের আড্ডার সদস্য, উন্নয়কর্মী, শিক্ষক এবং গবেষক ফেরদৌস আখতার লিলি, তাসনীম ফেরদৗস, তাহমিনা হাবীব, সেলিনা রশিদ, সাইদা আখতার, রুবীনা রহমান, শিরীন আজীজি, রোকেয়া বেগম ও সীমা দাস সীমু। সভায় সভাপ্রধান ছিলেন লেখিকা সুফিয়া রহমান। অংশগ্রহণকারী উপস্থিত সদস্য ছিলেন প্রায় ২০ জন।

নব্বই দশকের শুরুতে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নারী লেখিকাদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক তৈরী করে। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় পর্যায়ে নারীদের বইমেলা ও নারী সমাবেশ এর আয়োজন করা হয় ঢাকার ধানমন্ডিতে সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। মেলা চলেছে মোট ৭ দিন, ডিসেম্বরের ৩-৯ তারিখ পর্যন্ত। এই বইমেলা আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া কবি সুফিয়া কামালের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নারীদের আয়োজনে নারীদের বইমেলা ও নারী সমাবেশ এটাই ছিল প্রথম।

প্রায় ১৪টি জেলা থেকে ১৫০ জন নারী লেখিকা এই সমাবশে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ঢাকা থেকেও প্রতিদিন নারী লেখিকারা অংশগ্রহণ করেছেন। এভাবে ১৫০০ জনেরও বেশী নারী লেখক বইমেলা ও নারী সমাবেশ সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন।

নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা জেলা পর্যায়ে লেখিকাদের নিয়েও আলোচনা সভা করেছে। আমাদের এই কাজটি আরও এগিয়ে নিতে হবে। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় ‘সোমবারের আড্ডা’র সদস্যদের নিয়ে একটি নতুন কমিটি করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের সদস্যদের কাছে নারী লেখিকাদের পরিচিতি এবং সমন্বয় ঘটানোও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার একটি কাজ। বর্তমান প্রজন্মের সদস্যদের জানতে হবে লেখা মানে ফেসবুক, লেখা মানে ওয়েবসাইট নয়। নানা বিষয়ের উপর নারী লেখিকারা লিখছেন। তাদের লেখা পড়তে হবে। পরিচিতি ঘটাতে হবে। আমরা বর্তমান প্রজন্মের সদস্যদের সাথে নারী লেখিকাদের নিয়ে একত্রে কাজ করতে চাই। আলোচনার শুরুতে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সম্বয়ক সাইদা আখতার এ কথা বলেন।

লেখিকাদের সভা

প্রারম্ভিক আলোচনার পরে উপস্থিত সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেয়-

প্রফেসর অনামিকা হক লিলি: নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার অগ্রগতির উদ্দেশ্য জেনে খুব ভাল লাগছে। আমরা দলবদ্ধভাবে কচুরিপানার মত অচ্ছতা সরিয়ে স্বচ্ছ হতে পারি। ফুটে উঠতে পারি। ছোট বেলা থেকেই মেয়েরা বৈষম্যের শিকার। এই বিষয় নিয়ে লিখেছিলাম। “আমার খোকা স্কুলে যাবে, মা বলছে আমার ছেলেকে সব কিছু দিয়ে সাজিয়ে দে।” ছেলে প্রথম স্কুলে যাবে। তার জন্য সমস্ত কিছু নতুন। তাকে সাজান হচ্ছে, খাওয়ান হচ্ছে। আরও কত কি! এবারে ছোট বোন মাকে বলছে, সব মনে রাখলাম। আমারও যেন এমন দিন আসে।” সমাজের বৈষম্য দূর হবে না যতদিন এই পরিবর্তন না আসবে। সামাজকে ছেলে মেয়ের বৈষম্য ঘোচাতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। নারীদের লেখা যত ভালই হোক তা ছাপা হয় না। কেন? তা কখনও ভেবে দেখারও কেউ নেই। তাই আমাদের কাজ আমাদেরকেই করতে হবে। দলবদ্ধভাবে। একত্রে।

মালেকা ফেরদৌস: ঢাকায় যে সব নারী সাহিত্য সংগঠন আছে তা গতানুগতিক। সভাগুলোতে সব সময় একই জন সভাপতিত্ব করেন। এখানে নারীদের বিকশিত হওয়ার পথগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সভাগুলোতে এখন থেকে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা আসবে এবং অংশগ্রহণ করবে তাই যেন একই ব্যক্তি সব সময় সভাপ্রধান না হন সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। সমাজটা বহুদূর এগিয়েছে কিন্তু নারীর উপর নির্যাতন কমেনি, বলবো বাড়ছে। সমাজের অস্থিরতা বাড়ছে যা লেখিকাদের লেখায় ফুটে উঠতে পারে।

ড. সৈয়দা মোতাহেরা বানু: কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সৃষ্টিকে নিয়ে গবেষণা করেছি। বিশেষকরে নজরুলের শিশু সাহিত্য নিয়ে কাজ করি, লেখালেখি করি।

কবি নাজমা আরেফিন: সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স, ধানমন্ডিতে নারীগ্রন্থের বই মেলায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। রোমেনা আফাজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রোমেনা আফাজকে নিয়ে আমি ছোট একটি লেখা লিখেছিলাম। ঐ লেখাটি পড়ে তিনি বলেছিলেন, ‘একটি বইয়ে হবে না আমাকে আরো বই দিতে হবে।’ আরো বলেছিলেন, আমরা এক সময় থাকবো না, তোমরাই তো লিখবে।’ দস্যু বনহুরের সবগুলি বই তিনি আমাকে গিফট করে ছিলেন। জনকণ্ঠ পত্রিকার একটি মেয়ে আমার ওই লেখা দেখিয়ে বললেন, আপনার নাম নাজমা আরেফিন। সে আমাকে বই মেলা থেকে খুঁজে বের করেছিল। নারীগ্রন্থের বই মেলায় আমি সার্থক হয়েছি। আমরা নারীগ্রন্থের সাথে সব সময় আছি।

কবি লিলি হক: একত্র হওয়া মানে অনেক সাহসী হওয়া। নারীগ্রন্থকে জাহাজ মনে করি। আমরা সবাই সেই জাহাজের নাবিক। আমাদের উত্তরসুরী যারা ছিলেন তাদের হাত ধরে আমরা এগিয়েছি। তারা হলেন, নয়ন রহমান, নীলিমা ইব্রাহীম, আজিজা ইদ্রিস, সাঈদা খানম, খালেদা সালাউদ্দিন, মকবুলা মঞ্জুর, শ্রদ্ধেয়া বেগম সুফিয়া কামাল, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, হালিমা খাতুন, জাহানারা ইমাম আরও অনেকে। দিন বদলের দিনে প্রকৃতির সাথে প্রত্যেকেই সফল কান্ডারী। আমি নারীকে নারী মনে করি না, সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখি। নারীদের অনেক দায়িত্ব থাকে তারপরও বলবো একটি দিন আমরা নতুন প্রজন্মের সাথে বসবো। নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা এটা আলোর দিশারী হবে।

রিফাত আরা শাহানা: ভাল কিছু করতে আগে যেমন সকলে একত্রে নারীগ্রন্থে আসতাম এখনো আসবো। নতুন প্রজন্ম আমাদের দেখে কিছু শিখবে এই আশা করি।

ফেরদৌস আখতার লিলি: নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা একটা শক্তি, একটা আনন্দের জায়গা। অনেকদিন পর সবার সাথে কথা বলতে পারছি এটা আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। বাংলাদেশেই যে শুধু অন্যায়, নির্যাতন চলছে তা নয়। পৃথিবীর কোন দেশেই আজ শান্তি নাই। সব জায়গায় অশান্তি বিরাজ করছে।

সীমা দাস সীমু: নারী যা বলতে চায়, যা প্রকাশ করতে চায়, তার সব কিছুই ছাপান গ্রন্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। নারীর জ্ঞান আদান প্রদান হয় একে অপরের সাথে কথা বলায়। আমরা ১৯৯৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে বই মেলা ও নারী সমাবেশ করেছিলাম। সেখানে বহু জেলার বহু লেখিকা এসেছিলেন। পরিচয় হয়েছিল সেই সব লেখিকাদের সাথে। অনেক লেখিকাকেই নিজের প্রতিভা বিকাশে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। জানানো হয়েছিল শ্রদ্ধাঞ্জলি। শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছিল লেখিকা মাফরূহা চৌধুরীকে। যিনি ছিলেন একাধারে একজন লেখিকা এবং সাংবাদিক।

ছোট বেলায় ‘দস্যু বনহুর’ পড়ে বড় হয়েছি। লেখক কেমন, কে লিখছে, এটা তেমন গুরুত্ব পায় নি। রোমাঞ্চকর বই ‘দস্যু বনহুর’ পড়তে হবে এটাই প্রধান ছিল। বই মেলা ও নারী সমাবেশে ‘দস্যু বনহুর' এর সাথে রোমেনা আফাজ বা লেখিকাকে জানলাম। রোমেনা আফাজ এর বাবা পুলিশে চাকুরী করতেন। তার মুখে শুনতেন চোর ডাকাত ধরার গল্প। আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় ‘দস্যু বনহুর’।

নতুন প্রজন্মকে লেখিকাদের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার যে উদ্যোগ এট খুব ভাল প্রভাব ফেলবে বলেই বিশ্বাস। প্রতিমাসে নতুন প্রজন্মসহ একেত্রে আলোচনা সভা হলে ভাল।

লেখিকা সুফিয়া রহমান: আড্ডায় এসে নারীদের নিয়ে আলোচনা করতে করতে নারী বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমরা আর “লেখিকা” বলে নিজেদের ভাগ করতে চাই না। আমরা নিজেদের এখন থেকে “লেখক” বলবো। আজকে নারীগ্রন্থে একত্রে বসার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমরা লেখিকারা যাতে আরও এগিয়ে যেতে পারি তার জন্য আলোচনা করা। আগেও নারীগ্রন্থের সাথে কাজ করেছি। আজকে আবার নতুন করে সূচনা করছি যাতে আবার আমরা নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে পারি।

সভার সিদ্ধান্ত:

১. প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে লেখিকা এবং নতুন প্রজন্মের সদস্যদের সাথে একত্রে সভা।
২. প্রতি সভাতেই একজন নতুন সভাপ্রধান দায়িত্ব পালন করবেন।
৩. সেপ্টেম্বর, ২০১৭ মাসের শেষ সপ্তাহে সভার দায়িত্ব পালন করবেন লেখিকা সংঙ্ঘের রিফাত আরা শাহানা।
৪. আমাদের পূর্বসূরী লেখিকা, যারা পথ দেখিয়েছেন তাদের লেখা নিয়ে আলোচনা।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।