নবপ্রাণ আন্দোলন শুরু


আমরা নবপ্রাণ আন্দোলন খুব ভেবেচিন্তে সভাসমিতি ডেকে দশদিক বাছবিচার করে শুরু করি নি। এর আবির্ভাব যেন নিজের দরকারে আপন তাগিদে ঘটে গিয়েছে। একজনের বা গুটিকয়েকর ইচ্ছা এখানে প্রধান ভূমিকা পালন করে নি, বড়োজোর জোগালির বেগার খেটেছে। কিন্তু সেই ইচ্ছাকে অসচেতনা বা স্বতঃস্ফুর্ত ইচ্ছা বলা ভুল হবে। নিজেদের ইচ্ছা নিজেদের পরিকল্পনা নিজেদরে চিন্তাভাবনা আগাগোড়া তৎপরই ছিল। কিন্তু তবু মনে হচ্ছিল এ যে শুধু নিজেদেরই ইচ্ছা নয়। এই সময়ের রপর সওয়ার হয়ে আছে আরেক ইচ্ছা। সেই ইচ্ছা শুধু আমাদের ব্যক্তিগত নয়। মানুষের বেড়ে ওঠার ইতিহাস এমন কিছু সন্ধিক্ষণ আসে যার মধ্য থেকে কিছু কাজ করার তাগিত উত্থিত হয় নইলে সামনের দিকে পা আর এগায় না। সেই তাগিদ থেকে এই ইচ্ছার জন্ম। সেই ইচ্ছা আমাদের তাড়া করেছে, চাবুক মেরেছে পেছন থেকে, তার আঘাত পড়েছে হাড়ে পিঠে স্নায়ুর ওপর। ইচ্চার সঙ্গে সেই ইচ্ছা একাকার হয়ে গিয়েছে।

সন তারিখ ধরে তাই নবপ্রাণ আন্দোলনের শুরু কবে থেকে তা বলা মুশকিল। তবে সংগঠিতভাবে চর্চার কাজ শুরু হয়েছে ১৯৯২ সালে থেকে। ঢাকা শহর এবং কুষ্টিয়াতে নিয়মিত সঙ্গীত চর্চার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া সারা দেশে নবপ্রাণ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সাধক গায়ক রয়েছেন।

নবপ্রাণ আন্দোলন কোন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি নয়

দশজনকে গান গেয়ে, নাটক অভিনয় করে, কবিতা শুনিয়ে বা অন্য নানা ভাবে খুশি করা মন্দ কাজ নয়। মানুষ শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকে না, তার প্রাণের আরো নানা তাগিদ আছে। সে কারণে বিনোদনের একটা দিলখোশ ভূমিকা আছে এবং থাকবে সন্দেহ নেই। তা নিয়ে বিতর্ক থাকার কথা নয়। মুশকিল হচ্ছে সংস্কৃতি বা সংস্কৃতি চর্চা বলতে এই সাধারণ ধারণাই সমাজে কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। যাঁরা ‘নবপ্রাণ আন্দোলন’-কে একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি হিসাবে দেখেন তাঁরা এই ধারণার আলোকেই হয়তো আমাদের বিচার করবেন। কিন্তু এটা নবপ্রাণ আন্দোলনের পরিচয় না।

তবুও সংস্কৃতির আলোচনায় বিনোদনের কথা এসেই যায়। সংস্কৃতি যখন কেবল বিনোদনের মাধ্যম হয়ে ওঠে তখন সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে একান্তই বাইরের একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে। দেখা যায় যাঁরা গান করছেন তাঁরা গাইছেন কথার সঙ্গে বা ভাবের সঙ্গে কোন একত্মতা বোধ ছাড়া। সেই সেক্ষে গায়কের গলার কেরামতি, রেওয়াজি কণ্ঠস্বরের কের্দানি এবং শ্রোতার মনোরঞ্জনই মুখ্য হয়ে ওঠে। সঙ্গীত তখন বহিরঙ্গ-সর্বস্ব বা পোশাকি হয়ে ওঠে। স্যুট-প্যান্ট-টাই দেখে যেমন আমরা আভিজাত্য বিচার করি তেমনি সঙ্গীতকেও বিচার করি তালের মুন্সিয়ানা, গিটকিরির ঠমক, কিম্বা কথার চটক ইত্যদি দিয়ে। সঙ্গীতের বাইরের আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত চর্চার যে পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ফুঠে উঠে সেটা অসম্ভব শুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কোন কিছুর মর্ম এবং তার রূপের সম্পর্কে মোটেও সরল একটা সম্পর্ক নয়। সেই দার্শনিক বিচার এখানে প্রবেশ না করেও আমরা বলতে পারি বিশেষ সময়ে সঙ্গীতের আঙ্গিকের উৎকর্য সাধনই যদি সঙ্গীতের প্রধান লক্ষ হয়ে ওঠে তখন ভেতরের ভাবের দিকটার সঙ্গে সহযোগ ছিন্ন হওয়ার বিপদ উপস্থিত হয়। সঙ্গীত তখন একপেশে হয়ে পড়ে। সঙ্গীতের সঙ্গে তখন শ্রোতা এবং গায়ক উভয়েরই সম্পর্ক হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন।

সংস্কৃতি যখন শুধু বিনোদন হয়ে ওঠে, গান যখন কেবল শ্রোতার ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি সাধনকেই প্রধান লক্ষ্য বলে ধরে নেয় তখন শিল্পকলা প্রাণের সঙ্গে প্রাণের সংযোগ ঘটাবার আনন্দময় অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বঞ্চিত করে। সমাজ যখন এখনকার মতো জটিল ছিল না তখন হয়তো সেই অভিজ্ঞতা অর্জন সহজ ছিল। বলা মুশকিল। ইতিহাসের সর্বকালে সঙ্গীতের উদ্দেশ্য বা লক্ষ নিশ্চয়ই এক রকম ছিল না; সঙ্গীত চর্চার পেছনে বিবিধ সামাজিক কারণ কাজ করেছে; জাতে পাতে বর্ণে নারীপুরুর ভেদে শ্রেণীতে চর্চার রকমফের ছিল নিশ্চয়ই। এখনো আছে তবে সমাজ ও অর্থনীতির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এই কালে এখন পণ্য হয়ে ওঠা ছাড়া সংস্কৃতির কোন বিভাগই নিজের গুণে আমাদের কাছে হাজির হতে পারছে না। এটা হোল আমাদের সময়কালে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের যোগ ঘটানোর কাজটা তখন সংস্কৃতির মূল ধারার বাইরে রীতিমতো আন্দোলন হিসেবে গড়ে গত্যন্তর থাকে না। পণ্য উৎপাদনের খোদ ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে লড়াই না করে সংস্কৃতির চর্চা তখন অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোন নান্দনিক কারণে নয়, একান্তই নান্দনিকতা বর্জিত বাস্তব অর্থনৈতিক গতি ও প্রকিয়া গানকে পণ্যে রূপান্তরিত করছে। একে মোকাবিলা করে গানের চর্চা চালানো কঠিন। এই সময়টায় সংস্কৃতি বিনোদনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, কিম্বা ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু এর একটা ইতিবাচক ফলও আছে। সংস্কৃতি নানান ঐতিহাসিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়, সেই সথ্যটা প্রমাণিত হয়। ফলে সংস্কৃতির একটা সংজ্ঞা নির্মাণ করার চেষ্টা যে নেহায়েতই বাতুলতা নেই কথাটা কায়েম হয়ে যায়। সেই দিক থেকে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্কে গড়ে তোলার যে কথাটা আমরা বলেছি তাকেও আমরা আর স্থির কোন অর্থে বাঁধতে পারি না। এই কালে এই সময়ে এই মুহূর্তে আমাদের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং এই সময়ের গর্ভে আমরা ভবিষ্যতের কী বীজ শনাক্ত করতে পারছি তার দ্বারাই প্রাণের সঙ্গে প্রাণের বন্ধন ঘটানোর কাজ বলতে আমরা কী বুঝি তার মানে দাঁর করাতে আমরা বাধ্য হই। ছক বাঁধা সংজ্ঞার বাঁধন থেকে সঙ্গীত বা সংস্কৃতির মুক্তি ঘটে। একই সঙ্গে তার বিকাশের সম্ভাবনাকেও আরো বিশাল ও বিস্তৃত করে তোলে। সেই কারণেই সঙ্গীত বা সাধারণ ভাবে সংস্কৃতির দিক থেকে এই সময়টা স্ববিরোধী। একদিকে সংস্কৃতির প্রধান ধারা বিনোদনমূলক এবং তার স্বভাব একান্তই পণ্যমূলক, বাজারে বেচারিক্রির জিনিস; অন্যদিকে, সংস্কৃতির মাধ্যম, বিষয়, পরীক্ষানিরীক্ষা ও মানুষের কল্পনা প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার বিচারে এই কাল তার আগের সময়গুলোর চেয়ে অনেক অনেক বেশি উর্বর।

তাহলে এটা মেনে নেওয়া যায় যে ইতিহাসের রূপান্তর মানে সংস্কৃতিরও রূপান্তর। কিন্তু এই দিকটা মনে করিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জোর দিতে চাই সেই দিকটির দিকেও যে সংস্কৃতি মানুষকে বদলায়, আমাদের রূপান্তর ঘটায়। দুই রূপান্তরের মধ্যে তফাৎ আছে, একাকার করে ফেললে চলবে না। সাংস্কৃতিক সাধনা বা চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষের যে রূপান্তর তার মধ্য দিয়ে মানুষের বিকাশ ঘটে। যিনি সংস্কৃতির সরাসরি চর্চা করেন তিনি যেমন চর্চা বা সাধনার মধ্য দিয়ে বদলে যান, তেমনি সংস্কৃতির সংস্পর্শে অন্যেরও রূপান্তর ঘটে। সংস্কৃতির এই দিকটা আমাদের মনে রাখতে হবে। কিন্তু এই বিকাশ আপনাতেই ঘটে না। আমরা নবপ্রাণে বিশ্বাস করি না আমাদের বিকাশ ঐতিহাসিক রূপান্তরের অন্ধ প্রক্রিয়ার অধীন; মনে করি না এক রহস্যময় বিমূর্ত ইতিহাস নিয়তির মতো আমাদের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে; যেন ইতিহাসই কর্তা, আমরা উদ্যমহীন ইচ্ছাহীন কর্মহীন পদার্থ মাত্র। বরং মনে করি ইতিহাসের সামগ্রিক কর্মকা-ের সঙ্গে ব্যক্তির কর্মকা-ের সম্পর্ক আরো বেশি জটিল। যে দিকটা আমাদের উপলব্ধির জন্য জরুরী সেটা হোল কখনো ভুলে না যাওয়া যে আমরা নিজেরাই সেই রূপান্তর বা বিকাশের কর্তা। কারণ আমরা কাজ করি, আমরা সুনির্দিষ্ট কর্মকা-ের সিদ্ধান্ত নিতে পারি, অতএব সুযোগ ও সম্ভাবনা যদি থাকে তাহলে ইতিহাসকে কানে ধরে সেই রাস্তায় চলতে বাধ্য করতে পারি যেটা রাজপথ, সরু গলি নয়। সেই ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ভূমিকা অসাধারণ। কিন্তু আপনাতেই আমরা কর্তা হয়ে উঠি না, কর্তা হয়ে ওঠার ব্যাপারটা সুনির্দিষ্ট চর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত। সংস্কৃতির কোন শাশ্বত সংজ্ঘা নেই,কিন্তু ইতিহাসের প্রতিটি মুহুর্তে আমাদের নিজেদেরই বিকাশের দরকারে তার সুনির্দিষ্ট দাবি, দায়, কর্তব্য ও কর্মকা- রয়েছে। আমরা নবপ্রাণ আন্দোলনে নিজেদের কাজটা যেন করে যেতে পারি সেই চেষ্টা করছি। আপন কর্তৃত্বে বিশ্বাস করি বলে, দায়িত্ব এড়াতে পারি না।

এখানে একটা গোড়ার কথা বলে রাখা দরকার। বিনোদন আর আনন্দ এক নয়। সঙ্গীত আনন্দ দেয় যখন তার লক্ষ্য ইন্দ্রিয় নয় কেবল, লক্ষ্য পুরো মানুষ, মানুষের সকল বৃত্তি। মানুষের বুদ্ধি বোধ আবেগ, ভাব, চিন্তাসহ মানুষ তার সকল বৃত্তি নিয়ে যখন জেগে ওঠে তখনই সেটা হয়ে ওঠে আনন্দ। সেই স্বাদ যখন মানুষ তার রূপান্তর ঘটে। সে আর তখন মানুষ থাকে না। নিজের মধ্যে নিজের বিকাশ বোধ করে মানুষ। কারণ মানুষের গোড়ার অস্তিত্ব ধরে তখন সঙ্গীত মানুষকে টান দেয়। নবপ্রাণ আন্দোলন সেই আনন্দকে পেতে চায়। তার নিজের রূপান্তর যেমন সে কামনা করে তেমনি কামনা করে তার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শ্রোতারও যেন ইতিবাচক বিকাশ ঘটে।

নবপ্রাণের কেন্দ্রমূলে রয়েছে বাংলার সাধক-গায়ক-কবির

নবপ্রাণ আন্দোলনের সংস্কৃতি চর্চা একপেশে চর্চা নয়। সংস্কৃতি আমাদের সমাজের ভাবুকতা, দার্শনিকতা, চিন্তা চেতনা ধ্যান ধারণার প্রকাশ এবং বিকাশের মাধ্যম। আমরা সেই ভাবেই একে চর্চা করতে চাই। যেসব গানে কথা এবং সুরকে আলাদা করা যায় না তার স্বাদ আলাদা। হোক তা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলের গান বা লোকগীতি। মনে হয় এই গানের জন্যেই যেন আমরা অপেক্ষা করে আছি অনেক কাল। ভাল গান মানেই কথা এবং সুরের একত্মতা। এটা হোল সাধারণ একটা সূত্র। সাধক-গায়ক-কবিদের গানের ক্ষেত্রে এই সাধারণ সুত্রের গানকে সাধারণ এককথায় ভাবসঙ্গীত বলা হয়। দেখা যায় এঁদের গানের কথা এবং সুর যে গভীর ঐক্যবসূত্রে বাঁধা তার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। গানগুলোর কথাকে সুর থেকে আলাদা করা যায় না তা বটেই মনে হয় সূরের ছাঁদ যেন গড়ে উঠেছে ভাবের মর্মকে ধরবার জন্যে। সূরের মধ্য দিয়ে কথা বা ভাব প্রকাশিত হচ্ছে নাকি কথার মধ্য দিয়ে সূর সেই সীমারেখা লুপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে গানের যে-আনন্দ স্ফুর্তি লাভ করে তার তুলনা মেলা ভার।

কথা ও ভাবের জন্য বাংলার ভাবঙ্গীততের প্রতি অনেকরই বিচ্ছিন্ন আছে। আমাদের আগ্রহের সেটাও একটা কারণ। কিন্তু সুর থেকে কথাকে আলাদা করে নয়, আমাদের আসল আগ্রহ সমগ্র সঙ্গীতের প্রতি। আমরা লক্ষ্য করেছি সামগ্রিক ভাবে ভাবসঙ্গীতের প্রতি বাংলাদেশ দারুন অনাগ্রহ বিরাজ করছে। এর নানা কারণ আছে সেই ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। এই অনাগ্রহের ফলে আমরা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। একদিকে ভাব, কথা, দর্শন ও চিন্তার ধারা হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ভাবুকতা বা দার্শনিকতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটছে না, কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ সংস্কৃতি ও আমাদের চিন্তাচেতনার ওপর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধিপত্য প্রবল ভাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। সমাজের অগ্রগতির জন্যে এই আধিপত্য শেকল হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভাবসঙ্গীতে সূরের যে এক বিশাল দিক রয়েছে সেটাও হারিয়ে যাচ্ছে। বহুবছরের চর্চা ও পরিক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এই গানগুলো এগুচ্ছে। খুব কাঁচা শ্রুতি বা কান নিয়েও যদি কেউ শুধু লালনের গান, জালালের গান, মনোমোহন দত্তের গান শোনে তাহলে সুরের দিক থেকে সম্পূর্ণ তিন রকমের ধারা এবং গায়কী চিহ্নিত করা সম্ভব, অতি অনায়াসে। আমরা বাংলার এই বিপুল ঐশ্বর্য হারাতে রাজি নই।

ফকির লালন শাহের প্রতি আমাদের আগ্রহের বড়ো কারণ একদিকে তিনি কবির কবি আর ভাবের স¤্রাট, অন্যদিকে সুরের দিক থেকে তিনি অনন্য। তাঁর গানের সুরের বৈশিষ্ট্য এতো আলাদা ও অনন্য যে অবাক হয়ে যেতে হয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস জালাল উদ্দীন খাঁর গানের ওপর ভাটিয়ালির প্রভাবের কথা বলেও তার মধ্যে ‘জালালী’ ঢং শনাক্ত করেছেন। ওখানেই জালালে নিজস্বতা। অন্যান্য সাধক-কবিদের গানে আবহমান লোকসঙ্গীতের প্রভাব আছে। থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফকির লালন শাহের সঙ্গীতকে ঠিক লোক সঙ্গীতের প্রধান ধারার কোনটির মধ্যে ফেলা যায় না। মনে হয় হঠাৎ নিজের শেকড় থেকে নিজে গাছপালা শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে ফকির লালন শাহের গানের সুর দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেটা দারুন দুঃখজনক সেটা হোল এই গানগুলোকে বিকৃত করে এবং মনগড়া সুর বসিয়ে রেডিও টেলিভিশনে গাওয়া হয়। লালনের গান নিয়ে প্রচুর গবেষণার দিক আছে। এটা সত্যি যে বাংলার সাধক-ভাবুকদের গানের কোন প্রমাণ্য সুর প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা তাঁরা নিজেরাও চাইতেন না। আমরা গবেষণা করতে নেমে দেখেছি যে কুষ্টিয়া ও বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে অনেক সাধক বাইল আছেন যাঁদের সূর ও গায়কীর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যাকে আলাদা করে লালনের গায়কী বলে শনাক্ত করা সম্ভব। অনেকে বহু পুরনো সুর এখনো কমবেশী নির্ভূল মনে রেখেছেন। তবে এই ধরণের ভুল নির্ভুলের কিতর্ক নেহায়েতই সময়ের অপচয়। তাঁদের সহযোগিতায় এবং পরিশ্রমী গবেষণায় বাংলা গানের এই মেধাবি ধারাকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। কথা হোল লালনের গানকে ‘পল্লী গীতি’ বা মাছে ময়দানের গান হিসাবে ধরে নিয়ে যা তা করে গাইবার যে বিকৃতি চলছে প্রথম কাজ হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

সঙ্গীত মাত্রেই নবপ্রাণের বিষয়। আমরা সবরকম গানেই উৎসাহী। তবে ভাবসঙ্গীত বা বাংলার ভাবুকতার ধারার প্রতি আমাদের বিশেষ পক্ষপাত আছে। এর অনেক কারণ আছে। প্রথমত বাংলার ভাবুকতার চর্চার সঙ্গে আমরা আমাদের এখনকার প্রাণের অন্বেষণ বাঁধতে চাই। কারণ বহু প্রশ্নের উত্তর তো আমরা এখনো পাই নি। এখনো বাংলার দর্শন চর্চার ইতিহাস মানে সাধক ও ভাবুকদের গান, কথা ও জীবনীর ইতিহাস। দ্বিতীয়ত কথা এবং সুরের মিশ্রমাধ্যমে প্রজ্ঞা নিজেকে যে রূপে ও আঙ্গিকে হাজির করে আমরা মনে করি সেই দিকটা আমাদের দৈনন্দিন চর্চার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। তৃতীয়ত সুরের যে আবহ আমরা হারিয়ে ফেলেছি তাকে আবার আমাদের শ্রুতি ও ইন্দ্রিয়ের অভ্যাসের মধ্যে না নিয়ে এলে বাংলা গান তার নিজের ছাপটা বিশ্বসঙ্গীতে রেখে যেতে পারবে না। চতুর্থ কারণ হোল, সংস্কৃতির নিধর্মীকরণের প্রশ্ন। এই ব্যাপারটি খানিক ব্যাখ্যা করে বলতে হবে।

সংস্কৃতির নিধর্মীকরণ (detheolisation)

আচার বা বিধানের দিক বাদ দিলে সরল অর্থে ধর্ম মানে চৈতন্যের নতুন কোন “ভাব”, এক ধরণের দশাপ্রাপ্ত হাল। এই দিক থেকে দার্শনিকতা বা ভাবকতার পূর্বাবস্থা হচ্ছে ধর্ম। সমাজের যখন শিশুকাল তখন সমাজ মনে করতে পারে এই “ভাব” আসছে ঐশ্বিরিক কোন থেকে, ওপর থেকে। যার মধ্যে সেই “ভাব” জাগে তার মনে হতে পারে এই ভাব তার নিজের নয়, অন্য কোন উৎস থেকে তার নিঃরসণ ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি খাঁটি কবি বা শিল্পীর এই দশা জীবনে একবার না একবার ঘটা স্বাভাবিক।

নিজের আদি ভাবের দিকটা ধর্ম যখন ভুলে যায় তখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় আচারসর্বস্ব ঠুনকো জিনিস, সমাজের জন্য সেটা বোঝা হয়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধেই সমাজকে ফের লড়তে হয়, সেই লড়াইয়ে জিততে না পারলে সমাজ এগুতে পারে না। কিন্তু এখানে লড়াইটা কার বিরুদ্ধে সেই নিশানা পরিস্কার না থাকলে ক্ষতি হয়ে যায় মারাত্মক। আমাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে এবং ঘটছে। আমরা আচার সর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মানুষের সহজাত ভাবুকতা ও দার্শনিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াই। ভাবের বিকাশের জন্যে এবং আমাদের চিন্তা বুদ্ধি চৈতন্যের বিবর্তন ও বদলের দরকারে যে দরোজা খোলা রাখার কথা সেটা আমরা উল্টা পেরেক মেরে বন্ধ করে রাখি। সেই দরোজা ভেতর থেকে খোলা যায় না, বাইরে থেকেও নয়। নিজের হাদপি-ের ওপর নিজেরই মোহর মেরে বসে থাকি।

পাশ্চাত্য এই অধঃপতন আংশিক এড়াতে পেরেছে চার্চের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যার রাজনৈতিক ফলাফল দুটো ধারায়প্রবাহিত হয়েছে। একদিকে, রাষ্ট্র ধর্ম থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। আইন প্রণয়নের, বিধান তৈরীর, শাস্তিদেবার অধিকার বা ক্ষমতা কিছুই আর ধর্মের এখতিয়ারে রইল না। তার স্থান গ্রহণ করল রাষ্ট্র। সমাজের একটা রাজনৈতিক নিধর্মীকরণ ঘটল, ইতিহাসের দিক থেকে তাকালে এটা একটা বড়ো ধরণের অগ্র পদক্ষেপ। দ্বিতীয় ধারা গড়ে উঠল ধর্মের অন্তর্গত ভাবুকতা বা দার্শনিকতার প্রশ্নগুলো নিয়ে। সেই প্রশ্নগুলো লুফে নিল দর্শন। কারণ সেই প্রশ্ন তো মানুষকে অবশ্যই ভাবায় যে “আছে” বলে যে কথা সহজ ভাষায় বলি তার মানেটা আসলে কি? কি আছে? কি করে বুঝি যে কোন একটি সত্তা দেশ কালে আছে? কি করে নিশ্চিত বোধ করব যে-কথা আমি বলছি সেটাই সত্য? সাধারণ আর বিশেষের সম্পর্ক কি? কী সম্পর্ক অসীমের সঙ্গে সীমিতের? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। এই সকল চিন্তা ভাবনার উত্তর খুঁজতে গিয়ে একসময় ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। পাশ্চত্যে সেই স্থানটা গ্রহণ করল দর্শন। দর্শন হয়ে দাঁড়াল নতুন ধর্মতত্ত্ব। কিন্তু সেটা আর ধর্ম রইল না, শুধু এই অর্থেই যে দার্শনিকরা দাবি করেন নি তাঁদের চিন্তা আল্লার কাছ থেকে নজিল হয়েছে। মানুষই চিন্তা দর্শন ভাবুকতার প্রণের এটা অবিতর্কিত সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ধর্মের মতোই চিন্তার প্রচার প্রসার সংগ্রাম ও প্রষ্ঠিার লড়াই চলেছে। এখনো চলছে। নানান মতের নানা চিন্তার নায়ক আর অনুসারীরা ধর্ম প্রচারকদের মতো পুরানো দুনিয়া ভাঙতে চেয়েছেন, নতুন দুনিয়া গড়তে চেয়েছেন। সেই সকল শক্তিশালী প্রক্রিয়ার প্রভাব পড়েছে সমাজের সর্বত্র। সবসময়ই পড়ছে। মোট ফলাফল হোল এই যে দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমাজের নিধর্মীকরণ ঘটেছে পাশ্চাত্যে।

পাশ্চাত্যের এই ইতিহাসের সঙ্গে যদি আমরা আমাদের ইতিহাসের তুলনা করি তাহলে দেখবো সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার যে-খুঁটির ওপর ধর্ম দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের মতো সংগ্রাম আমাদের করতে হয় নি। মসজিদ বা মন্দিরের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের মতো একটি রাজনৈতিক লড়াই লড়তে হয় নি আমাদের, যেমন করে চার্চের বিরুদ্ধে লড়াতে হয়েছে ইউরোপকে-রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে চার্চকে আলাদা করতে হয়েছে। তার মানে আচারসর্বস্ব নিপীড়নমূলক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা লড়ি নি তা নয়, কিন্তু সেটা ইউরোপের মতো ছিল না। কেন সেটা একরকম হয় নি তার প্রধান কারণ ইউরোপের চার্চের সঙ্গে জনগণের সংঘাতের ভিত্তি ছিল অথনৈতিক। চর্চা জমিজমা, সয়সম্পত্তির মালিক হয়ে বসেছিল।জনগণের সঙ্গে পুরোহিতদের শ্রেণীগত সংঘাতের সম উপাদান উপস্থিত ছিল সেখানে। সেই অথনৈতিক সংগ্রামটাই রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করেচে। আমাদের ক্সেত্রে সেটা সীমিত ও বিক্সিপ্ত বাবে একটু আধটু কিন্তু সেটা কোন সর্বব্যাপী রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করে নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে বেশী, ধর্মের উল্টো আধিপত্য ঘটেছে আমাদের জীবনে এবং রাজনীতিতে। কোন ধারাবাহিকতা না মেনে। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ধর্ম বরং উল্টো লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্সেত্রেই। বাইরের দিক তেকে দেখলে আমরা দেখি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটা প্রগতিশীল দিক আছে, কিন্তু চিন্তাচেতনা ভাবুকতা দর্শনের দিক থেকে দেখলে দেখি সেটা দারুন অন্দকারা ছন্ন কাল। কারণ এই একদিকে দানা বেঁধেছে খেলাফাত- ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাবে বিশুদ্ধ মুসলমান বানাবার সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারার বিপুল উত্থান ও শক্তি বৃদ্ধি, বাংরা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে যার আদিপত্য আমুল প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া এই সময়েই আমাদের চিন্তা ভাবনা ভাষা সংস্কৃতির মূল ধারা থেকে বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রাকৃত চিন্তার উপাদানের ক্ষয় ঘটেছে, ক্ষ হয়েছে নিজেদের বিপুল ভাবসম্পদ।। ইংরেজ “চক্রান্ত” করে হিন্দু মুসলমান বিভেদ বানিয়ে শাসন কায়েম রেখেছে,এই কথাই আমরা এ যাবতকাল শুনে এসেছি। চিন্তা চেতনা ভাবুকতা দার্শনিকতার দিক থেকে পাহাড় প্রমান ময়লার মধ্যে আমরা নিজেরাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছি আর এখনও পড়ে রয়েছি, অথচ অন্যকে দোষী করার আনন্দে আজও আমরা বিচার বসার ফুরসত পর্যন্ত পাই নি।

দেখা যাচ্ছে নিধর্মীকরণ ঘটা দূরে থাকুক আমরা ধর্মের নিগড়ে নিজেদের ভাব এবং বৃদ্ধি দুটোই বন্ধক দিয়ে বসে আছি। আজ যখন সাম্প্রদায়িকতা আমাদের অজগরের মতো খেয়ে ফেলার উপক্রম করছে তখন একবার জামাতে ইসলামীর রিরুদ্ভে আরেকবার বিজেপির বিরেুদ্ধে আমরা লড়বার পাঁয়তারা করছি। দৈত্যের সঙ্গে আমরা লড়তে নেমেছি গুলতি দিয়ে। ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের হুঙ্কারে আকাশ ফেটে চৌচির হয়। আমরা চেঁচাতে শিখেছি, ইতিহাসের দুই কান ধরে তার পথ বাৎলে দিতে শিখিনি।

কেন এই অধঃপতন? কারণ একদিকে আছে চিন্তা চেতনা ভাব দর্শনের প্রতি আমারে অসুস্থ অনীহা, অথচ অন্যদিকে আছে অন্যদের অনুকরণের অসামাণ্য প্রতিভা। পশ্চিমকে আদর্শ ধরে নিয়ে নিরস্তর চেষ্টা করছি আমরা। কিন্তু পশ্চিমের ইতিহাস আর আমাদের ইতিহাস তো এক নয়। তাছাড়া আমারে স্বার্থের সঙ্গে পশ্চিমের অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত আছে। আমাদের পথ আমাদের নিজেদেরই তৈরী করতে হবে। আমাদের হয়ে ওঠার পথ, নিজেদের গড়বার পথ আলাদা হবে। অন্যদের যেমন করে হয়েছে তেমন করে আমাদের হবে না, হতে পারে না। এটা অন্তত যেন আমাদের উপলব্ধিতে আসে যে ধর্মের নিধর্মীকরণ বা ভেঙে বললে , একদিকে দর্শন ভাবুকতা চিন্তা চেতনা সংস্কৃতির নিধর্মীকরণ আর অন্যদিকে রাজনীতির নিধর্মীকরণের কাজ আমাদের তো সম্পন্ন করতে হবে। করতেই হবে, নইলে আমরা এগুতে পারব না। কি করে সেটা আমাদেরই ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা করব সেটা না ভেবে ধর্মের দিকে পিঠ দিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়ালে রেহাই পাওয়া যাবে না।

অন্যদিকে, যেহেতু আমরা অনুকরণ করতেই শুধু শিখেছি সে হেতু ধর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা ধর্মের ভাব, বা মানুষের স্বাভাবিক সহজাত দার্শনিকতাকেও উপড়ে ফেলে দিচ্ছ। অথচ নিজ ধর্মের নিধর্মীকরণের মধ্য দিয়ে, নিজ ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে নিজেদের চিন্তা চেতনা দার্শনিকতা ভাবুকতা ভাবসম্পদ উদ্ধারের একটা কর্তব্য আছে আমাদের। সেটা আরো একটি বাড়তি কারণে যে পাশ্চাত্যে বা পশ্চিম আজ শক্তিশালী। সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতার সবদিকে থেকেই পশ্চি পৃথিবীর অন্য সকল সমাজ ও সংস্কৃতির হুমকি হয়ে উঠেছে। আ আমাদের দাঁড়াতে হবে পশ্চিমের এই সর্বগ্রাসী আধিপত্যের বিরুদ্ধে।

পাশ্চাত্যে বা পশ্চিম মানেই মন্দ, এই ঠিক নয়। তাছাড়া পাশ্চাত্যোর অর্জন একই সঙ্গে মানবেতিহাসেরই অর্জন। দুনিয়াকে উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্য ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা সঠিক সেই সন্দেহ থেকেই যায়। তবে এর মধ্য দিয়ে দুনিয়ার অধিপতি শ্রেণী ও কারা তাদের পদানত হয়ে রয়েছে উভয়কে চেনার কাজটা ভৌগলিক দিক থেকে শনাক্ত করে আপাতত চলছে। পশ্চিম দাবি করছে তার সংস্কৃতিটাই দুনিয়ার শ্রেষ্ট সংস্কৃতি, এটাই সভ্যতার চ’ড়ান্ত বিকাশ, আর অন্য সকল সংস্কৃতি অসভ্যতার স্তর পেরোয় নি, “আধুনিক” হয়ে ওঠে নি। অতএব অন্যেরা সভ্য নয়। অন্যদের পদানত রাখা শোষণ করা অতএব ন্যায্য একটা কাজ। পশ্চিমের আদলে অন্যান্য জাতিকে গড়ে তোলাও একটা কর্তব্য। এই প্রক্রিয়া আমাদের রুখতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের ন্যায্য জায়গা আমাদের দাবি করে আদায় করে নিতে হবে। যদি হামলা হয় তাহলে জনগণ তাদের সাংস্কৃতিক স্বভাবের কোন অমূল্য সম্পদ রক্ষা করছে সেটা স্পষ্ট থাকতে হবে তাদের সামনে, চোখের সামনে থাকতে হবে। নইলে আমাদের মরে যাবার সম্ভাবনা। আজ স্বার্থবুদ্ধি দুনিয়ায় এতো প্রবল হয়েছে যে নিজের খুঁটি যদি নিজেরা শক্ত না করি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।

কিন্তু নিজেদের চিন্তা চেতনা দর্শনের ভাবুকতার যদি কোন হদিসই আমরা না নেই তাহলে কি করে এগুব আমরা? তারা খোঁজ করতে গিয়ে আমাদের এক দারুন উপলব্ধি হয়েছে, নবপ্রাণ আন্দোলন সেই উপলব্ধির ফসল বলা যায়। সেই উপলব্ধি সম্পর্কে কিছু কথা বলার মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচয় দেবার চেষ্টা করব এখানে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দিক থেকে একটি প্রকট প্রশ্ন হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে জামাতে ইসলামের রিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম চলছে। এই সংগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে যে শক্তিশালী সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী উপাদান রয়েছে তার সঙ্গে এই শ্রেণীর কোন যোগ নেই। কৃষক ও মেহনতি মানুষের সংস্কৃতি, ভাবুকতা, চিন্তাচেতনাকে ‘মরমী’ ভাব, আধ্যাত্মিক সঙ্গীত পল্লী সঙ্গীত প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে একে নিম্নস্তরের সংস্কৃতির বেশি মূল্য এই শ্রেণী কখনই দেয় নি। দেখা যায় একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলার কোন সাংস্কৃতিক প্রস্ততি এই শ্রেণীর নেই। সাংস্কৃতি প্রস্তুতি কথাটা আমরা ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করছি। যার মধ্যে ভাবুকতা বা দার্শনিক প্রস্তুতিও অন্তর্ভক্ত জামায়াতে ইসলামীকে মোকাবেলা করা হচ্ছে সাংগঠনিক শক্তির জোরে। এ লাড়াইয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকাকে কেন্দ্রে করেই জনমত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু বাংলার সাধারণ জনগণের সংস্কৃতির মধ্যে যে অসাম্প্রাদায়িক ধারা লারন ও আরো অনেক সাধক-কবি গায়কের গানের ফলে বিরাজ করঝে তার সঙ্গে এই সংগ্রামের কোন যোগ ঘটছে না। ফলে এই সকল আন্দোলন মর্মহীন হয়ে পড়েছে বা রাজনৈতিক ক্ষমতা কোন্দল হিষাবে জনগণের চোখে আবির্ভূত হচ্ছে। আচারসর্বস্ব ধমের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছে না। প্রথাগত ধর্মের খোলস ও নিপীড়নমূলক বহিরঙ্গ খসিয়ে ধর্মের ভাবের দিক বা মানবিক দিকটা সাধকরা যতটা প্রকাশ করতে পেনেছিলেন তা সহজে সামনে আসতে পারছে না এবং বাবুকতার বিকাশও ঘটছে না।

মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি ও রাজনীতির শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার কারণে লালনের প্রতি আগ্রহ তেমন নেই। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির এই সহিংস সময়ে লালন ও তার গান অসাধারণ অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে। শক্তি দিতে পারে সকলকে। প্রাণের গভীর দিকগুলোকে নাড়া দিতে পারে। জামায়াতে ইসলামীসহ দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের তীব্র দিকগুলোতেও সাধারণ জনগণের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির কোন খোঁজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে না দেখা যাওয়াটা আগামি দিনে এই আন্দোলনের সম্ভাব্য ব্যর্থতার দিকটাকেই হয়তো ইঙ্গিত করছে।

সামাজিক বিধানদানকারি ধর্মের বিরুদ্ধে ফকির লালন শাহ ও অপরাপর সাধক কবিদের দীর্ঘ লড়াইয়ের রাজনৈতিক-দার্শনিক মর্মও আজো গুরুত্ব লাভ করে নি। ধর্মের একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা জামায়াতে ইসলামী বা দক্ষিণপন্থী শক্তিগেিলা সমাজে ক্রমাগত প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। এর প্রাধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মের নামে নিজেদের হাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিধান কেন্দ্রিভূত করা। সাধক-গায়করা এই কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন ইতিহাসের নানান সময়ে। কিন্তু ধর্ম মানে শুদু আচার নয়, সংস্কার নয়। সহজাত স্বভাবে অস্তিত্ব ও জগৎসংসার সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তোলে মানুষ ধর্মের মধ্যে। সাধক গায়করা সেই প্রশ্নগুলোকে নতুন আলোকে নতুন অভিজ্ঞতায় নতুন উপলব্ধির তাগিদ থেকে তোলেন। সেটা আর তখন ধর্ম মাত্র হয়ে থাকে না, বা দর্মীয় ব্যাখ্যাও হয়ে ওঠে না। হয়ে ওঠে মানুষের সহজাত ভাবুকতা বা দার্শনিকতার অবিপ্রকাশ। এর মধ্য দিয়ে সমাজের চিন্তা ধ্যান ধারণা এগোয়। চিন্তা বিকশিত হয়। নতুন উপমায় প্রতিকে ভাবে আবেগে মানুষ নিজের নতুন অভিজ্ঞতাকে নতুন করে বাঁধে। ফকির লালন শাহ বাংরার ভাবুকতা ও দার্শনিকতার বিকাশের ইতিহাসে একটা বিশাল স্থান দখল করে আছেন। তাঁকে ছাড়া বাংলার সংস্কৃতি কল্পনা করা যায় না। ভাবুকতা বা দার্শনিকতার দিক থেকে সামনে এগুবার কথাও ভাবা যায় না।

বাংলার বাউল সাধকদের মধ্যে এই অঞ্চলের নানান আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং প্রভাব আছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মে, বৈষ্ণব ধর্ম এবং ইসলামের প্রভাব বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়। তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনাকে রেখে বৈষ্ণব বা রসিক বৈষ্ণবের ধারা গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে, অনেকে হিন্দু সমাজভুক্ত থেকে যায়। উভয়ের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের মনোভূমি রয়ে যায়। সে কারণেই হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে বাউল মত গড়ে উঠেছে। ইসলাম এখানে শরিয়তি ইসলাম নয়। মারেফতি ইসলাম বা সুফি ইসলাম বাংলার অন্যান্য সাধকদের গানে যতো স্পষ্ট ভাবে প্রভাব ফেলেছে বাউলদের গানে ততোটা নয়। লারনের গানে সুফি তত্ত্বের ভাষা ও শব্দের উৎক্ষেপ আছে, কিন্তু রালন সুফি তত্ত্ব দ্বারা প্রতিভাবিত ছিলেন না। তাঁর মধ্যে বাংলার ভাবুকতা একটা বিশেষ রূপ পেয়েছে, যা সম্পূর্ণ নতুন জিনিস।

এই কারণে নবপ্রাণ আন্দোলন ফকির রালন শাহকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একই সঙ্গে বাংলার সকল সাধক-গায়ককেও। এর মধ্য দিয়ে পুরো উপমহাদেশের ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গেও একটা নাড়ির টান আমরা বোধ করি।

কোত্থেকে শুরু করা যায়?

আমাদের আছে এক অসাধারণ শক্তিশালী দর্শনের ধারা। একদিকে ভৌগলিক কারণে এবং ভাষা ও জাতিগত বির্বনের দিক থেকে আমরা ব্যাপকার্থে ভারতের নানান ধর্ম, দর্শন ও ভাবুকতার উত্তরসূরী আর অপর দিকে ধর্মবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক আদান প্রধানের সম্পর্কে বিশাল ইসলামি সভ্যতাও ব্যাপকার্থে আমাদের। ইসলামে আমাদের হক আছে, সেই হিস্যা আমাদের বুঝে নিতে হবে। একদিকে মুসলমান সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারত উপমহমাদেশের ধর্ম, ঐতিহ্য ও দর্শনের সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ কেটে ফেলে দিতে চায় আর অপরদিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা। ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজী ভাষা ও জ্হান বিজ্হান আমাদের সামনে এক বিশাল জগতে উন্মোচন করে দিয়েছে। ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে, পাম্চাত্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তারা ভালো জিনিসগুলো যেন আমরা আবার অভিমানে ফেলে না দেই। এই তিনদিকে নজর রেখেই আমাদের কাজ মুরু করতে হবে।

বিশাল প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার চিন্তা চেতনা দার্শনিকতায় একটা ছেদ পড়েছে। যদি ভাবুকতার দার্শনিকতার বিবর্তন ঘটত তাহলে তার একটা নিজস্ব ধারা ও পথ গড়ে উঠত। সেটা হয় নি। আজ যখন আমরা খোঁজার তাগিদে ঘরের বার হয়েছি তখন দেখি যে দর্শন বলতে গ্রন্থায়িত কোন পদ্ধতি গড়ে ওঠে নি ঠিকই কিন্তু এক আশ্চর্য শক্তির বাংলার সাধক সুফি বাউলদের গানে দর্শনের একটা অপরিসীম শক্তিশালী ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে, সকলের অলক্ষ্যে সাস্বত সমাজের কোন সমর্থন সহায়তা ছাড়া, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কোন আগ্রহ বা উৎসাহ ছাড়া, এই চর্চা টিকে রয়েছে। এমনি গান তো আছেই, তাছাড়া পালা গান, বিচার গানে, কড়চায় -অর্থাৎ গানের যে কোন রূপের কথাই ধরি না কেন, সে এক বিপুল সম্পদ। অসাধারণ তার প্রশ্ন উত্থাপনের ধরন, বিচিত্র তার জবাবের পদ্ধতি। যদি বাংলার সাধক সুফি বাউল কবিদের গানের মর্মার্থ নিয়ে বসি তাহলে আরো বিস্মিত হতে হয়। দেখা যায় এক অসম্ভব সংগ্রাম চলছে আচার সর্বস্ব ধর্মের বিরূদ্ধে। সাংস্কৃতিক নিধর্মীকরনের লড়াই চরছে তীব্র ভাবে। ধর্মকে ধর্মের ভেতর থেকে জর্জরিত করা হচ্ছে। দেখা যায় যে শব্দ, প্রতীক ভাষাটাই শুধু ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে নেয়া, কিন্তু ভেতরে রয়েছে অন্য জিনিস। ধর্মের ভাবুকতা দার্শনিকতা চিন্তা চেতনার সারাৎসারকে প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রতীকে, কল্পনায়, কাহিনীতে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে।

প্রথমেই প্রশ্ন জাগে কি করে এই ধারা টিকে থাকছে? এর উত্তর সহজ, কারণ মানুষের সহজাত দার্শনিক প্রশ্ন

যে-ধারার মধ্য থেকে উঠছে তাকে জনগণ নিজের বলে রক্ষ করছে। মোল্লারা তারা বিরোধিতা করছে, পুরোহিত চোখ রাঙ্গাচ্ছে। কিন্তু জনগণ, বিশেষত সাধারণ কৃষক আর নিরক্ষর মেহনতি মানুষ তাকে প্রাণে তুলে রাখছে। কারণ আচার সর্বস্ব ধমের সঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতাশালী শ্রেণীর স্বার্থের ঐক্যটা তার কাছে স্পষ্ট। তার বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই সে রাজনৈতিক ভাবে লড়ছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে টের পাচ্ছে শুধু রাজনৈতিকভাবে জিতলে তার শ্রেণীর জয় হবে না। ধর্মের ভেতর দাঁড়িয়ে আচার সর্বস্ব ধর্মের ঠুনকো খোলসটা বাজিয়ে দেখাতে হবে। ওটা করতে গিয়েই ধর্মের ভেতর থেকে দর্শন আর ভাবের দিকটা সে আলাদা করে ফেলছে। কৌশলের জর্য বলছে এটা হচ্ছে মারেফাতের পথ, সাধনার পথ, সাধকের পথ, ভাবের পথ। কিন্তু লড়াই সে থামাচ্ছে না।

শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের শ্রেণীগত স্বার্থের সীমাবদ্ধতার কারণে এই মর্ম ধরতে পারে না। আচার সর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইটা তার কাছে একেবারেই জিনিস নয়, অর্থাৎ তার দর্শন বা বাবুকতার ব্যাপার নয় এটা। পশ্চাতপদ সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণীর সঙ্গে আচার সর্বস্ব ধর্মের যে স্বার্থের ঐক্য তার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তা গ্রামের কৃষক আর মেহনতি শ্রেণীর মতো তার কাছে তীব্র নয়। ফলে সে যখন এই গান গুলো শোনে তখন এগুলোকে পল্লীগীতি বা গ্রামের মানুষের গানের বেশী ভাবতে পারে না।

দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক আমলে দর্শন আর ভাবুকতার সঙ্গে সত্যিকারের ছেদ যাদের মধ্যে পড়েছে তারা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এরা সাধারণত ইংরেজি শিক্ষিত, পশ্চিমী সভ্যতার আবহে তৈরী। যাদের কাছ থেকে এই শ্রেণী “আধুনিকতা” শিখেছে তাদের কাছ থেকে তারা হীনমন্যতাও রপ্ত করেছে। তাদের বদ্ধমূল ধারণা সাধারণ মানুষের গানের মধ্যে কোন নতুন ভাবের নতুন দর্শনের নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটতে পারে না। আর “প্রগতিশীল” গান বলতে তারা সেই গানগুলোকেই বোঝায় যে গানগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেরা জনগণের নামে রচনা করে। সেখানে কৃষকের কথা থাকে, শ্রমিকের সংগ্রামের কথা বলা হয়। তার সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ নেই। ধমের নিধর্মীকরণের প্রয়োজনটা নিজেদের প্রাণ থেকে উত্থিত প্রশ্নের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য গ্রামের কৃষক মেহনতি মানুষের মধ্যে তাদেরই অজান্তে এসেছে যে-বা বতার কারণে মধ্যবিত্ত সেই বা বতার মধ্যে বাস করে না।

কিন্তু যদি সংস্কৃতির আর চিন্তাচেতনার নিধর্ধীকরণ একই সঙ্গে নান্দনিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে থাকে তাহলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে এই বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটা বড়ো ধরণের কাজ হবে সাধকদের গানগুলো বোঝা, এর বিবর্তন ও বাঁকগুলো চিহ্নিত করা এবং তার বিকাশের পথ করে দেয়া। আমাদের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধার করা। বলাবহুল্য এর চর্চা করার কর্তব্য তো আছেই, চর্চা করতেই হবে। সেই চর্চার ধারাটা কি হবে সেটা অবশ্য নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। নিজেদের নাড়ীর স্পন্দনের সঙ্গে যদি আমরা একবার যুক্ত হতে পারি তাহলে বাংলা গান ভাবুকতা, চিন্তা ও দর্শনের মাধ্যম হয়ে উঠবে। সাধকের গানে নিধর্মীকরণের লড়াই একটা জায়গায় থেমে রয়েছে, এখনো ধর্মের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয় নি। সেই বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করতে হবে। ভাব ভাবুকতা দার্শনিকতার মর্মশাঁস বের করে ধমের বাইরের খোলসটা ফেলে দেবার কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক উল্লম্ফনটা ঘটবে ঠিক তখনই।

আমরা মনে করি গান অসাধারণ শক্তিশালী মাধ্যম। এই মাধ্যমকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের বিকাশ ঘটবে অত্যন্ত দ্রুত বেগে

নবপ্রাণ আন্দোলন নিজেই সেটা একা করবে এই অহংকার আমাদের নেই। আমাদের মধ্যে যে বোধ কাজে করছে সেটা আমরা সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করে আগ্রহী। সেই সাহসেই আমরা আমাদের নামের সঙ্গে আন্দোলন কথাটা জুড়েছি। এটা অতি সাহস হয়ে গেল কিনা একমাত্র ভবিষ্যতই সেটা প্রমাণ করবে।

অক্ষর এবং গান

আরো একটি দিক খানিক এখানে তোলা দরকার। কবিতার সঙ্গে গানের বিচ্ছেদ চলছে। গানের জন্যে এটা খুবই ক্ষতিকর হয়েছে, কবিতার জন্যেও হয়েছে। আমরা মনে করি না সঙ্গীত মানেই কথাসহ গান। বিশুদ্ধ স্বর সাধনারগুরুত্ব ও ভূমিকা ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ কিন্তু কবিদের সঙ্গে গানের যদি বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে ভাবের বিকাশ ঘটে খুবই ধিমা তালে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে ধর্মের প্রকাশ প্রায় সবসময়ই বাক্য এবং সুরের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে, শুধু বাক্য কিম্বা শুধু সুর দিয়ে ভাবুকতার প্রকাশ সহজে ঘটতে চায় না। বাংলা গানে জোয়ার বয়েছে তখনই যখন কবিতা এবং গান হাত ধরাধরি করে চলেছে। আমরা চেষ্টা করব কবিতাকে গানের কাছে ফিরিয়ে আনতে। এর জন্যে কবিদের অনুপ্রাণিত হয়ে উঠতে হবে। সাধক-কবিদের ক্ষেত্রেনিরক্ষরতা অসুবিধা না হয়ে একটা সুবিধা হয়ে ওঠে বরং। তাঁরা সাধারণত গান মনে রাখেন সমঋতিতে, খাতাকলম লিখে নয়। খাতাকলমের অক্ষর শ্রুতিগ্রাহ্য নয়। কাগজের অক্ষর আওয়াজ করে না। সমঋতির অক্ষর বোধ হয় অনায়াইসেই যখন তখন গুনগুন করে কানের কাছে বাজানো যায়। অক্ষরগুলোর স্বভাব থেকে খোদাই করে সুর বের করার কাজ এই ক্ষেত্রে যেভাবে হয়, সাক্ষর অবস্থায় তার চরিত্র অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়। বলাবাহুল্য মুদ্রাযন্ত্র আমাদের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে বিস্তর বদল ঘটিয়ে চলেছে। কখনো সেটা আমরা বুঝি আর কখনো টের পাই না। এই দিকগুলো আমাদের আরো খতিয়ে দেখতে হবে। দেখার ব্যবহারিক উদ্দেশ্য হোল কাব্যকে গানের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। এই বাজে ধারণা কবিদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে ববে যে কবিতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে মুদ্রাযন্ত্র। কবিতা যখন কণ্ঠস্বরকে তার প্রকাশের বাহন হিসাবে পের দাবি করতে তখন বাংলা গান নতুন একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারবে।

ফলে নবপ্রাণ আন্দোলন কবিদের সঙ্গে, কবিতার সঙ্গে কাজ করছে। এর সঙ্গে স্বভাবতই যুক্ত হবে কাব্যনাট্যক, গীতিনাট্যা কা নাট্যকলার অন্যান্য শাখা। তবে যা কিছুই আমরা করতে চাই গানকে কেন্দ্র রাখার পক্ষপাতি আমরা।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও অন্যান্য গানের সঙ্গে সম্পর্ক

রবীন্দ্রনাথ, নজরুর ছাড়া বাংলা গান চিন্তাই করা যায় না। নবপ্রাণ আন্দোলন অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের চর্চা করছে। তবে আমাদের ধারণা রবীন্দ্র, নজরুল চর্চার শক্তিশালী ধারা বাংলাদেশে আছে। তাঁদের কাছ থেকে সেখার আছে অনেকে আমাদের। এই ক্ষেত্রে যে বিশেষজ্ঞতা গড়ে উঠেছে তাকে সপ্রাণ রাখাই আমাদের কাজ। প্রয়োজনে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, পরস্পরকে সহায়তা করতে হবে। তবে নবপ্রাণ আন্দোলন বিশেষভাবে মনোযোগ দিচ্ছে সেই সব গানগুলো আবার সচল করে তোলার জন্যে যার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক কারণে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ ভাবে শ্যামা সঙ্গীত এবং কীর্তন। কোন ভাবেই গানের এই দুই ভাবসম্পদ হারানো চলবে না। আমরা কাজে নেমে দেখছি এই ক্ষেত্রে বাধা আছে অনেক, কিন্তু সেটা পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে উঠতে হবে।

পাশ্চাত্য সঙ্গীত

পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ব্যাপারে আমরা গভীর ভাবে উ্যসাহী। বাংলা গানের সুরে, গায়কীতে, পরিবেশনায় বৈচিত্র আনার জন্যে নানামুখী পরীক্ষানিরীক্ষায় আমরা দারুন উৎসাহী। কিন্তু আমরা অনুকরণে বিশ্বাসী নই। আমাদের দাঁড়াতে হবে আমাদের নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর। নিজের জায়গায় ওপর দাঁড়িয়ে নতুন জিনিস গ্রহণ করে সমৃদ্ধহতে চাই আমরা। পাশ্চাত্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা আর পাশ্চাত্যের ইতিবাচক অর্জন গুলো জানা এবং শেখার মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। দুটিকে আমরা যেন গুলিয়ে না ফেলি।

অতএব নবপ্রাণ আন্দোলন কোন ‘গ্রুপ’ বা গানের ‘দল’ মাত্র নয়

নবপ্রাণ আন্দোলন কোন ‘গ্রুপ’ বা শুধুমাত্র গানের দল মাত্র নয়্ ভাবের যাঁরা সাধক, ভাবের রাজনৈতিক দিকটা যাঁরা বুজতে চেষ্ঠা করছেন এবং কবিতা ও গানের মধ্য দিয়ে চিন্তা চেতনা দার্শনিকতার প্রকাশে যাঁরা উৎসাহী তাঁরা যেমন এর সঙ্গে যুক্ত তেমনি যাঁরা গান ভালবাসেন তাঁরাও এর সাথে যুক্ত। শুধুমাত্র উচ্চভাব সম্পন্ন গানই আমরা গাইব এটা আমরা পণ করে বসি নি। আমরা সরল সাধারণ প্রেমের গান ধিখতে ও গাইতে যেমন আগ্রহী, তেমনি গভীর তত্ত্বকথার গানও গাইতে চাই। বাংলা গানের ভাবুকতার ধারাকে শক্তিশালী করা এবং সংস্কৃতির নিধর্শীকরণের কর্তব্য আমরা কোন ক্ষেত্রেই ভুলে যাব না, সেটাই হোল আসল কথা।

যাঁরা গান করেন বা করবেন তাঁরাই আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, অন্যেরা নয়, সেই সংকীর্ণতার মধ্যে আমরা পড়তে রাজী নই। আমরা গান নিয়ে প্রচুর আলোচনা ভাবনা চিন্তা তর্ক বির্তক করতে আগ্রহী। গান শুধু গাওয়া আর পরিবেশনার ব্যাপার নয়, এটা ভাবনারও বিষয়। গান পর্যালোচনার একটা শক্তিশালী ধারা তৈরী হোক আমরা তা চাই। সঙ্গে সঙ্গে তৈরী হোক সচেতন ও সতর্কএকদল শ্রোতা, এই আমাদের ইচ্ছা।

সকল সম্প্রদায়ের সাথে নবপ্রাণের সম্পর্ক

তৃতীয় বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে না তুললে দুনিয়ার অধিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ লড়াই অসম্ভব। সেই ব্যাপার রক্ষ্যের কথা ভেবে শুরু থেকেই আমাদের সম্পর্ক গড়ে তুলেতে হবে তাদের সঙ্গে যাঁরা বাষা এবং ইতিহাসের কারণেই আমাদের আত্মার আত্মীয়। অন্যদিকে, দুই বাংলার মানুষের সঙ্গে গভীর সাংস্কৃতিক সংােগ ছাড়া বাংলার ভাবুকতার বিকাশ অসম্ভব। জাতীয়তারোধ, রাষ্ট্র, সম্প্রদায়গত পরিচয় ও অন্য যে কোন ভেদবুদ্ধির উর্ধে ওঠা খেটে খাওয়া শ্রেণীগুলোর জন্য সহজ, কারণ ভেদবুদ্ধিতে তাদেরই ক্ষতি সর্বাধিক। এই সম্পর্ক রচনা শুধু বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে নয়। সকল আদিবাসীদের সঙ্গে ও বটে, সেটা,যেন আমরা ভুলে না যাই। যে সংস্কৃতির আমরা স্বপ্ন দেখি ও চর্চা করি তা কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা বিশেষ গোষ্ঠির সংস্কৃতি হয়ে ওঠার সাধনা নয়। কোন এককাট্টা সংজ্ঞায়িত কর্মকাণ্ডও নয়। আমরা গর্ত হতে চাই না, যেখানে পানি জমে থাকে। আমরা নদী হয়ে উঠতে চাই যেখানে সকল জলের ধারা এসে মিশে যায়্ এবং ইতিহাসের প্রবাহ হয়ে ওঠে।

ফরহাদ মজহার
নবপ্রাণ আন্দোলনের পক্ষে।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।