লালন সাঁইজীর ১২৬ তম তিরোধান দিবস, নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি, ছেঁউরিয়া, কুষ্টিয়া
“কে তোমার আর যাবে সাথে”
পহেলা কার্তিক, ১৬ অক্টোবর। লালন ফকির ভক্ত-অনুরাগীদের জন্য কার্তিকের এইদিনটি বিশেষ দিন। এইদিনে ১২৬ বছর আগে ফকির লালন সাঁইজী কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তিরোধান করেন। এবারেও তাঁকে স্মরণ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু-গুরু, লালন ভক্ত ও অনুসারীরা কুমারখালি, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে লালান স্মৃতিধামে হাজির হন।
লালনের তিরোধান ও দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দুটো বড় অনুষ্ঠান হয়। প্রধান উদ্যোক্তা লালন একাডেমি। পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও তাদের নিজ নিজ উদ্যোগে অনুষ্ঠান করে থাকে। লালন একাডেমির বিপরীতে রয়েছে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি। লালন একাডেমির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আখড়াবাড়ি তাদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। লালন একাডেমি ও নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে সারাবছরই ফকির লালন সাঁইজির ‘কালাম’ উচ্চারিত হয়। তাঁর গান ও তত্ত্বচর্চা চলে। সরকারিভাবে পহেলা কার্তিককে মৃত্যু বার্ষিকী হিসাবে উদযাপন করলেও নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি এই দিনটিকে উদযাপন করেছে সাধুগুরুর ভাষায়: ‘তিরোধান দিবস’ হিসাবে। ফকির লালন সাঁইয়ের বিখ্যাত একটি গানের চরণ থেকে এবারের অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল: “কে তোমার আর যাবে সাথে”! গানটির শুরু নিজেদের প্রশ্ন করার মধ্যে যে ‘যখন কালের হাতে আমাদের পড়তে হবে তখন ভাই, বন্ধু কেউ সাথে যাবে না। একাই যেতে হবে। ফকির লালন সাঁইজী এ কথাই বলে গেছেন। তাঁর মহিমা কতোটুকুই বা আমরা বুঝতে পেরেছি।
এই তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে তিন দিনের অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। হাজার হাজার ভক্তরা দুরদুরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন এই দিনে, সাঁইজীর কাছে এসে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে। এই সময় লালন অনুসারী সাধুরা সাঁইজীর ধামে আসন নিয়ে বসেছেন। কেউ থেকেছেন দুইদিন, কেউ তিনদিন। সাঁইজীর গান গেয়ে ও নিজেদের মধ্যে নানা ব্যাখ্যা তত্ত্বালোচনায় তাঁরা সময় কাটিয়েছেন ভক্তদের নিয়ে।
নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে অনুষ্ঠান চলাকালিন সময়। লালন অনুসারী ও সাধারণ শ্রোতাবৃন্দের এক অংশ
নবপ্রাণ আখড়া বাড়িতেও লালন অনুসারী সাধুরা আসন নিয়ে বসেছেন। চার দিন (১৫-১৮ অক্টোবর, ২০১৬) সাঁইজীর গান গেয়ে ও নিজেদের মধ্যে নানা ব্যাখ্যা তত্ত্বালোচনায় তাঁরা সময় কাটিয়েছেন। পাশাপাশি নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির মঞ্চে (সকাল ৬টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত) নবপ্রাণ আন্দোলনের শিল্পীরা পরিবেশন করেছেন লালন সাঁইজীর বিভিন্ন ধারার গান । এই গানের মধ্যে বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে ফকির লালন সাঁইজীর দৈন্য গান । নবপ্রাণ আন্দোলনে কিছু নিয়ম মেনে অধিবাস শুরুর সময় বিকাল থেকেই দৈন্য গান, ভোরে গোষ্ঠ গান, বিধান মেনে সাধু সেবা ইত্যাদির চর্চা করা হয় ।
গোষ্ঠ গান:
লালনের গোষ্ঠ গান রয়েছে বলতে গেলে কেবল মাত্র আট অথবা নয়টি। সুর্য ওঠার আগেই গোষ্ঠ গান গাওয়ার নিয়ম। নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে প্রতিদিনই গোষ্ঠ গান শুরু হয়েছে ভোর ৬টায়। এই ভোরের সকালে লালন অনুসারি ভক্ত, অসংখ্য সাধারণ মানুষ যারা লালনের কথা শুনতে এবং বুঝতে চায়, লালনের “কালাম” এর মানে বুঝতে চায় তারা নিয়মিত আখড়াবাড়িতে এসে ভিড় করেছেন। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনেছেন।
আর লালন সম্পর্কে কথা বলা এবং গানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কবি ফরহাদ মজহার। এখানে আলোচনার কিছু অংশ তুলে ধরছি-
‘কুষ্টিয়া একসময় ছিল বৃহত্তর নদিয়া জেলার অংশ। নদিয়ায় যে ভাবের তুফান তুলছিলেন ‘তিন পাগল’ কুষ্টিয়া সেই নদিয়ারই প্রাণ। সীমান্ত বিভাজিত হয়ে যাবার পর নদিয়ায় প্রাণ ভ্রমর রয়ে গিয়েছে কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া এবং তার আশপাশের জেলা বা ভূখণ্ডই এখন নদিয়া। এটা এখন আর ভূখণ্ড নয়। ‘নদিয়া’ এখন একটি ভাবপরিমণ্ডলের নাম। ছেঁড়িয়াই এখন নদিয়ার হৃদয়। ফকির লালন শাহ আমাদের তাঁর বিখ্যাত ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে’ গানে নদিয়ার যে ‘তিন পাগল’ সম্পর্কে আমাদের জানান দিয়েছেন সেই তিন পাগলের প্রধান ‘পাগল’ শ্রীচৈতন্য বা শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নদিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তার জন্য নদিয়ার অভিমান আছে। তিনি গণমানুষের পক্ষে জাতপাত বর্ণ বিরোধী যে রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করেছিলেন সেটা আবার উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণের হাতে পড়ে আবার উচ্চকোটির মানুষের বর্গে উঠে যায় বা ফিরে যায়। বৃন্দাবনের গোস্বামিদের অবদানে সংস্কৃত ভাষায় শাস্ত্রচর্চায় টিকাভাষ্যে গৌরাঙ্গের শিক্ষা যে রূপ নিয়ে দাঁড়ায় সেটা আর গণমানুষের ধর্ম বা লড়াই হয়ে টিকে থাকে নি। বিশেষত সুলতানি আমলে ইসলামের জাতপাতবিরোধী লড়াইয়ের সংস্পর্শে যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের সূচনা ঘটেছিল সেটাও ক্রমে ম্লান হয়ে যায়। সুলতানি আমল এবং সেই সময় বঙ্গে ইসলামের ভূমিকার বিচার ছাড়া নদিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ভাবপরিমণ্ডলের তাৎপর্য বোঝা কঠিন। যদিও সেই দিকে গবেষণা এখনও খুবই অপ্রতুল। কিন্তু তিন পাগলের ‘আসল’ পাগল নিত্যানন্দ থেকে যান নদিয়ায়। অন্য ‘পাগল’ অদ্বৈতাচার্যকে কেন্দ্র করে ‘শান্তিপুর’ ভাবচর্চার আরেকটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু কেউই নদিয়ার গণমানুষের লড়াই ও তত্ত্বচর্চার মূল ধারাটি ধরে রাখতে পারে নি। নদিয়া যতোটুকু এখন অবধি ধরে রাখতে পেরেছে তার ছাপ কিছুটা আমরা পাই বাউল ফকির বয়াতিদের গানে ও সাধুগুরুদের জীবনযাপনে।’
গোষ্ঠ গানের পর্ব শেষে সারা দিন ব্যাপী সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নবপ্রাণ আখড়া বাড়িতে ফকির লালন সাঁইজীর গান পরিবেশিত হয়েছে। নবপ্রাণ আখড়া বাড়ির মঞ্চে শুধু নবপ্রাণের শিল্পীরা গান গেয়েছেন এমন নয় এখানে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এসে একটি গান গাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমরা তাঁদের এই মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। নবপ্রাণ আন্দোলনের শিল্পীরা ছাড়াও এই মঞ্চে গান গেয়েছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সাধুগুরু, কৃষক, ছাত্র, ডাক্তার, এবং বাউল শিল্পীরা।এই মঞ্চকে গান গেয়ে আরও সমৃদ্ধ করেছেন লালন অনুসারী ও লালন ভক্ত, সাধু কুষ্টিয়া দৌলতপুরের রওশন ফকির।
নবপ্রাণ আন্দোলনের শিল্পী পূর্ণিমা
নবপ্রাণের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন, আব্দুল কুদ্দস, আমির হোসেন খান, আকরাম হোসেন বাবলা, রুবিনা আকরাম, রোকেয়া বেগম, আমিনুল ইসলাম গাইন। নবপ্রাণ সঙ্গীত ঘরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে, পরশ, বৃষ্টি, পূর্ণিমা, নমিতা রানী, আন্নু, রুমা ও নিশি। যন্ত্রে ছিলেন মঞ্জু মিয়া, রাজেশ কুমার ও শঙ্কর দাস, মোকাব্বর হোসেন, আব্দুল কুদ্দুস ও আকরাম হোসেন বাবলা।
আখড়াবাড়িতে এ সময় যারা আসেন তারা একই সঙ্গে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার গুরুত্ব এবং কোন প্রকার সার, রাসায়নিক ও বিষ ব্যবহার ছাড়া চাষাবাদ করতে হয় সে ব্যাপারেও জানবার সুযোগ গ্রহণ করেন। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা এ সময় আখড়াবাড়িতে তাঁদের উৎপাদিত বিভিন্ন ফসল প্রদর্শন করেন এবং আগ্রহীদের উত্তর দেন।