নয়াকৃষির কৃষকের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা


টাঙ্গাইলের নয়াকৃষির কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া খাদ্য ফসল উৎপাদন করেন, এবং উৎপাদিত ফসল নিরাপদ হতে হলে কি করতে হয়, বা কি করলে তারা বুঝবেন তা বোঝার জন্যে নান্দুরিয়া গ্রামে কৃষকরা নিজেরা আলোচনা করেন। এই গ্রামটি দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নে। মার্চের ৯ তারিখে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় আটিয়া ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের সবজী ব্যবসায়ী, দাইমা, মুরগীর খামারী, ছাত্রী, গৃহিণী, কৃষকসহ মোট ৩২ জন অংশগ্রহণ করেন।

এই এলাকায় কৃষকরা নানা ধরণের ফসল বিশেষ করে ১. দানাদার জাতীয়- ধান, গম, যব, ভুট্রা, ২. ডাল জাতীয়- মাসকালাই, খেসারী, মশুর, মটর ৩. তৈল জাতীয়- রাই সরিষা, মাঘী সরিষা, তিল ৪.শাক-সবজী জাতীয়- ঢেঁড়শ, ডাঁটা, আলু, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, পুঁইশাক, পালংশাক, টমেটো, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, বরবটি, লালশাক, মিষ্টিআলু, লাউ, সীম, কচু, মুলা, ফুলকপি, পাতাকপি, বেগুন, পেঁপে, পাটশাক, লেবু, এবং ৬. মশলা জাতীয়- পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া , হলুদ, আদা, মিষ্টিসজ, রাধুনীসজ, মরিচ ইত্যাদী। আবাদী ফসলের পাশাপাশি অনাবাদী শাক পাওয়া যায়, যেমন হেঞ্চি শাক, গিমা শাক, বাইতা শাক, দন্ডকলস শাক, কলমী শাক, ঢেঁকি শাক, কচু শাক, মোরগশাক, নেটাপেটা শাক, হেলেঞ্চা শাক, তেলাকুচা শাক, খারকন , পিপুল শাক, কানাই শাক, খুইরা কাটা শাক, ভুলখুইরা শাক।

নয়াকৃষির কৃষকরা এক কাট্টা ফসল উৎপাদন করেন না, তাই প্রতি মৌসুমেই তাদের বৈচিত্র্যময় ফসল থাকে। মৌসুম অনুযায়ি ফল উৎপাদন হয় যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপে, কলা, জলপাই, পেঁয়ারা, আমড়া, বড়ই, বেল, আতা, সাগর কলা, সবরী কলা, মদনা কলা, বীচি কলা, জাম্বুরা, তেঁতুল ও কামরঙ্গা।

কৃষকের বাড়ীতে দেশী হাঁস, মুরগী, গরু ও ছাগল পালা হয়।

নয়াকৃষি কৃষকদের উৎপাদিত খাদ্য শুধু সার-বিষমুক্ত বলেই নিরাপদ, তা তাঁরা কখনোই দাবী করেন না। তাঁরা নিজেদের উৎপাদিত ফসল নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্যে কতগুলো বিষয় নিজেরাই লক্ষ্য রাখেন। তার মধ্যে কয়েকটি হোলঃ

  • জমি নিরাপদ (কৃষকরা মনে করে যে জমিতে ফসল উৎপাদন করা হবে সে জমি নিরাপদ অর্থ্যাৎ এই জমিতে কোন রাসায়নিক সার-বিষের কোন ক্রিয়া নাই। এই জমিতে যে ফসল উৎপাদন করব তার জন্য উপযুক্ত)
  • নিজে উৎপাদন করে (কৃষক মনে করে আমার নিজের উৎপাদিত ফসল সম্পর্কে আমি ভাল-মন্দ বলতে পারব)
  • নিজের হাতে রাখা বীজ ব্যবহার করে (নিজের হাতে রাখা বীজের গুণাগুণ সম্পর্কে কৃষক ভাল জানে এবং এই বীজে কোন সার-বিষ ব্যহারের প্রয়োজন পড়ে না।)
  • রাসায়নিক সার-বিষের পরিবর্তে খৈল, গোবর, ছাই, কম্পোষ্ট ব্যবহার করে
  • মালচিং ব্যবহার করে
  • সামান্য পোকা-মাকড় আক্রমণের চিহ্ন থাকে (কৃষক নিশ্চিত মনে করে তার উৎপাদিত ফসল নিরাপদ না হলে পোকামাকড় আসবে কেন)
  • পাখিতে খায়

এগুলো দেখা খুব সোজা কিন্তু তাঁরা এই বিষয়ে খুব নজর রাখেন এবং সে হিসেবেই বলেং নিরাপদ কিনা। শুধু তাই নয়, মাঠ থেকে ফসল তুলে ঘরয়ে আনা এবং বিক্রি করার মধ্যেও নিয়ম মানতে হয়। নয়াকৃষির কৃষকরা বাণিজ্যক কৃষক নয়, তারা প্রান্তিক, মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষক। তাদের জমির পরিমাণ এক থেকে তিন একরের বেশী নয়। যা উৎপাদন করেন তার একটি বড় অংশ নিজেরা খান, নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে দেন; গ্রামের প্রতিবেশী মানুষের কাছে বিক্রি করে; এবং স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করে। গ্রামে পাইকারের কাছেও কিছু অংশ বিক্রি করা হয়।


সবজি ফসলের মাঠ

নয়াকৃষির কৃষকের সবজি ফসলের মাঠ


ফসল বাজারজাত করতে হলে বাজার পর্যন্ত পৌছাতে অনেক কিছু লক্ষ্য রাখতে হয়। কৃষক হায়দার আলী বলেন, আমার উৎপাদিত ফল-মূল ও ফসল সবই নিরাপদ। কারণ আমার জমিতে কোন পোকা লাগে নাই। কোন প্রকার বিষ ব্যবহার করি নাই। এ পর্যন্ত জমিতে যে সকল শাক-সবজী এবং বাড়িতে যে ফল-মূল উৎপাদন করেছি তা নিজেরাই খেয়েছি । যখন পোকায় আক্রমণ করবে তখন বিষ দিলেই অনিরাপদ/দূষিত হয়ে যাবে। হায়দার আলীর কথার সুত্র ধরয়ে অন্যান্য কৃষকরা বলেন, ফল জাতীয় খাদ্য যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কৃষকদের হাতে থাকে ততক্ষণ নিরাপদ থাকে। আমরা খাদ্য হিসেবে খাই। কিন্তু পাইকারের কাছে বিক্রি করার পর তারা কাঁঠাল পাকানোর জন্য আম, কলা রঙ হওয়ার জন্য বিভিন্ন জাতের রাসায়নিক দ্রব্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করে। তখন এসব ফল নিরাপদ খাদ্য হিসাবে থাকে না। েখানে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই।

তাদের উৎকন্ঠা আধুনিক কৃষকদের নিয়ে। কৃষক আলমগীর বলেন, আমার ৩৫ শতাংশ জমিতে এ পর্যন্ত রাসায়নিক সার-বিষ দেই নাই । তাই আমি মনে করি আমার জমির উৎপাদিত ফসল নিরাপদ কিন্তু আমার পাশের জমিতে রাসায়নিক সার-বিষ দিচ্ছে। তার জমির পানি আমার জমিতে আসছে, এতে আমার উৎপাদিত ফসল কতটুকু নিরাপদ থাকছে তা আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। পরীক্ষা করে দেখলে বোঝা যাবে কোন রাসায়নিক প্রভাব আছে কিনা।

ফসল উৎপাদনের পর বাজার পর্যন্ত পৌছাতে নিরাপদ রাখার বিষয়ে অনেক ব্যাপার আছে। কৃষক লালউদ্দিন (লালু) বলেন, আমি একজন কৃষক এবং সবজী ব্যবসায়ী। জমি থেকে শাক-সবজী তুলে যেটা পানিতে ধোয়া দরকার সেটা বাড়িতে এনে মহিলাদের সহযোগিতা নিয়ে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে পরিষ্কার করে কলার খোল ও ড্যাম চিরে রশি বানিয়ে সবজী আটি তৈরী করি। যদি ধোয়ার কাজটা ময়লা ডোবা বা ডীপ টিউবওয়েলের ড্রেনে (যেখানে স্প্রে করা রাসায়নিকসার- বিষযুক্ত পানি) করা হয় তাহলে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে নিশ্চয়তা দেওয়া চলবে না। কৃষক লালউদ্দিন (লালু)সহ অন্যান্য কৃষকরা আরো বলেন, বাজারে নেয়ার আগের প্রস্তুতি হিশেবে যা করতে হবে টা হচ্ছে, ১. ময়লা রশি বা গরুর ঘরে বিছানো খড় দিয়ে শাক-সবজীর আটি বাঁধা যাবে না। এতে উৎপাদিত ফসল অনিরাপদ হতে পারে। ২.বাজারে পরিষ্কার স্থানে, পরিষ্কার পাত্রে রেখে বিক্রি করতে হবে। ৩. পরিমাপ করার জন্য পালা-পাথর পরিষ্কার রাখতে হবে।

কৃষক বানেজ মিয়া মনে করেন তার উৎপাদিত মাছ (কৈ, শিং, মাগুর,শৈল, রুই, কাতল, টাকি ও পুঁটি) নিরাপদ। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, ১. পুকুরে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ছাড়া কোন সেচের পানি প্রবেশ করতে পারে না; ২. কোন রাসায়নিক সার-বিষ ব্যবহার করেন না; ৩. বাইরের খাবারের পরিবর্তে কুড়া, খৈল, ভু’ষি, গোবর দেওয়া হয়; ৪.পুকুরে কিছু পানা আছে যা মাছে খায়; ৫. পুকুরের চারপাশে আলো-বাতাস পাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

বানেজ মিয়া আরো বলেন, যখন মাছ নিজেরা খাই তখন মাছ নিরাপদ অবস্থায় থাকে কিন্তু মাছ পাইকারের কাছে গেলে তা নিরাপদ থাকবে কিনা তার নিশ্চয়তা দিতে পারি না। মাছ ধরার পরে জাল, মাছের ডালি, পালা-পাথর সাবান-পানি দিয়ে পরিষ্কার করি।

দাইমা খাদিজা ও জায়েদা বলেন, কুড়িয়ে পাওয়া শাক নিরাপদ কিন্তু ময়লাযুক্ত নর্দমা, ডোবায় এবং ইরি জমির আইলে যে সকল কুড়িয়ে পাওয়া শাক পাওয়া যায় তা নিরাপদ খাদ্য হিসাবে নিশ্চিত করা যায় না। এইসব জায়গার শাক মিচমিচে কালো ও লকলকে । স্বাভাবিক আলোতে চুপসে যায়। যে ইরি জমির আইলের/বাতর এর ঘাস গরু খাইলে ছেইড় পারে সেখানকার কুড়িয়ে পাওয়া শাক নিরাপদ বলা যায় না।

হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগল সম্পর্কে কথা তোলেন জায়েদা ও আমিনুর। আমরা এবং আমাদের এলাকার কৃষকরা স্থানীয় জাতের হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগল পালন করি। আমরা বাজারের তৈরী ফিডের পরিবর্তে হাঁস-মুরগীকে ধানের কুড়া, শামুক, ধান, ভাত, ভ’ষি, চাউলের খুঁদ খাওয়াই। হাঁস-মুরগী নিজের মত ঘুরে ঘাস খায়। তাই হাঁস-মুরগীর মাংস, ডিম নিরাপদ। খাদ্য হিসাবে নিশ্চয়তা দিতে পারছি। গরু মোটাতাজা করার জন্য বাইরে থেকে ফিড, ভিটামিন, ইনজেকশন এবং খড়ের সাথে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়াই না। আমরা গম ও ভুট্রার ভুষি, চাউলের কুড়া, খুঁদের ভাত, খড় এবং কাঁচা ঘাস খেতে দেই। ফলে আমাদের গরুর দুধ ও মাংস নিরাপদ হিসাবে নিশ্চিত করতে পারি।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।