দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা বাস্তবায়নে পথ খাবার নিরাপদ রাখা সপ্তাহ উদযাপন


হাট বাজার পর্যবেক্ষন, আলোচনা সভা ও পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী বিতরন

আয়োজনে: দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ ও উবিনীগ (উন্নয়ন বিকলেপর নীতিনির্ধারনী গবেষনা)। ডিসেম্বর ২০১৫

ভূমিকা:

দেলদুয়ার উপজেলাকে নিরাপদ খাদ্য উপজেলা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ ও উবিনীগ সংশ্লিস্ট সকল স্টেকহ্ল্ডোরদের অংশগ্রহনে কাজ করে আসছে। দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা বাস্তবায়নের অন্যতম একটি কার্যক্রম হচ্ছে পথ খাবার বিক্রেতাদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে যেখানে বিশেষ করে খোলা খাবার বিক্রি হয় সেসব বিক্রেতাদের নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হিসেবে ১২- ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ পথ খাবার সপ্তাহ উদযাপপন করা হয়। সকলের মাঝে নিরাপদ খাদ্যপথ খাবার সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সেই সব হাট বাজারে নিরাপদ খাবার, বিষমুক্ত খাবার উৎপাদন ও বাজারজাত করনের উপর বিভিন্ন প্রচার মূলক কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নয়াকৃষির কৃষকেরা তাদের নিজ নিজ এলাকার হাট বাজারে পর্যবেক্ষন, সচেতনতামূলক বিভিন্ন লিফলেট বিতরন ও প্রচার মূলক কাজ করেছেন। উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণের মাঠ পর্যায়েও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণও রাসায়নিক সার- বিষ ব্যবহার বন্ধ করিয়ে আনার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এর ফলে খোলা খাবার বিক্রি না করা, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পথ খাবার নিরাপদ রাখা সপ্তাহ উদযাপন : হাট বাজার পরিচিতি

দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি হাটের অবস্থানঃ লাউহাটি হাটের অবস্থান দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের স্বল্পনাড়ু, তাঁতশ্রী, পাঁচুরিয়া, ডামখণ্ড গ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে। এসব গ্রামগুলি ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী চর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। লাউহাটি হটে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জড়িত। হাটে অধিকাংশ মানুষ নৌকা বা পায়ে হেটে যাতায়াত করেন। হাটে স্থানীয় লোকজনই বেশি তাদের উৎপাদিত ফসল কেনা-বেচা করেন। পাশাপাশি বাইরের কিছু কিছু ব্যবসায়ীরা দানাদার ফসল যেমন- ধান, গম, ডাল, সরিষা কিনতে আসেন ।

পাথরাইল ইউনিয়নের পুটিয়াজানি হাটের অবস্থানঃ দেলদুয়ার উপজেলার পাকা রাস্তা সংলগ্ন হাফ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পুটিয়াজানী হাটের অবস্থান। কৈজুরী, চন্ডি, নলশোধা, পাথরাইল, গোপালপুর, বিষ্ণুপুর, কাজীপুর, আকন্দপাড়া, পাইকপাড়া গ্রামগুলোর লোকজন প্রধানমএই হাটের ক্রেতা বিক্রেতা। এসব গ্রামের স্থানীয় লোকজন তাদের উৎপাদিত ধান, সবজী, ডাল, সরিষা, গম, মশলাসহ অন্যান্য ফসল কেনা-বেচা করেন।

ফাজিলহাটি ইউনিয়নের ফাজিল হাটি হাটের অবস্থানঃ টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার ফাজিলহাটি ইউনিয়নের ফাজিল হাটি হাটটি পুটিয়াজানী গ্রামের পাকা রাস্তা সংলগ্ন এবং ইউনিয়ন পরিষদ ঘিরে হাটের অবস্থান। হাটের আশপাশের গ্রামগুলির লোকজন হাটে ফসল কেনা-বেচা করেন। ফাজিলহাটি, পুটিয়াজানী, মোমিননগর, বিশ্বনাথপুর, চরপাড়া গ্রামের মানুষ বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং খোলা খাবার বিক্রি করেন। অধিকাংশ পায়ে হেটে এবং কিছু মানুষ সিএনজি করে মানুষ হাটে যাতায়াত করেন।

দেলদুয়ার উপজেলার দেলদুয়ার হাটের অবস্থানঃ এই হাটটি দেলদুয়ার উপজেলা কাছাকাছি অবস্থিত। মাদারকোল, পাকুল্লা, জাঙ্গাালিয়া,দেলদুয়ার এলাকার মানুষ হাটে ফসল কেনা-বেচা করেন। হাটে স্থানীয় লোকজন ফসলের পাশাপাশি রাস্তার পাশে খোলা-খাবার বিক্রি করেন। অধিকাংশ মানুষ পায়ে হেটে হাটে কেনা-বেচা করেন। কেউ কেউ সাইকেল বা সিএনজি করে হাটে চলাচল করেন।

দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের নাল্লাপাড়া হাটঃ আটিয়া ইউনিয়নের মুশুরিয়া, নাল্লাপাড়া, গোয়ারিয়া, কান্দাপাড়া গ্রাম নিয়ে নাল্লাাপাড়া হাট। এই হাটে স্থানীয় লোকজন পায়ে হেটে এবং সাইকেলে করে যাতায়াত করেন । গ্রামের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল এই হাটে কেনা-বেচা করেন। নাল্লাপাড়া গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের সাথে সপ্তাহে একদিন হাট বসে। রাস্তার দু-পাশে খোলা খাবার বিক্রি হয়।

পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষন

দেলদুয়ার উপজেলার সাপ্তাহিক হাটগুলোতে বিভিন্ন ধরনের খোলা খাবার কিভাবে বিক্রি হচ্ছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো-

সাধারণত স্থানীয় লোকজন এবং হাটের আশ-পাশের গ্রাম থেকে লোকজন হাটে আসেন ধান, গম, ডাল, সবজীসহ হাঁস-মুরগী কেনা-বেচা করতে। কোন কোন হাটে গরু-ছাগলও বিক্রি হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও গরীব শ্রেণীর মানুষ টিনের, ষ্টিলের ডিশ, পলিথিন, বড় থালায় করে বিভিন্ন ধরনের খোলা খাবার বিক্রি করেন। রাস্তার দুপাশে, জনাকীর্ণ স্থানে বিশেষ করে যেখানে মানুষের সমাগম বেশি সেখানে খোলা খাবার বেশি বিক্রি হয়। ২/১জন এসর খোলা খাবার পেপার বা পাতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে বিক্রি করছেন। বেশিরভাগ খাবারই খোলা অবস্থায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজু, জিলাপী, রুটি, শিঙারা, বড় চাপরি এসব খাবার রাস্তার পাশেই বসে ভাজা হচ্ছে। খালি হাতে এসব খাবার তুলে বিক্রি করছে। রাস্তায় মানুষজন চলাচলের কারনে এসব খাবারে ধুলা-বালি উড়ে পড়ছে। রুটি বিক্রির স্থানে ধান, ডালসহ অন্যান্য ফসল বিক্রি করার কারনে ফসলের ধুলা-বালি খাবারে গিয়ে পড়ছে। রাস্তার পাশে সিএনজি, ভ্যান বা অন্যান্য পরিবহন চলাচল করায় খোলা খাবারে ধুলা-বালি পড়ছে। আর খাবারের উপর মাছি আর মাছি। গ্রামের অনেক মানুষ ছোট-বড় বিভিন্ন অসুখে কবিরাজ দেখায়। হাটে একজন কবিরাজ বিভিন্ন গাছন্ত ওষুধ গুড়া করে বিক্রি করছেন এসব ওষুধ প্লাষ্টিকের পাত্রে রাখা আছে। এসব ওষুধও খোলা অবস্থায় বিক্রি করায় মাছি, ধুলাবালি গিয়ে পড়ছে।


পথ খাবারপথ খাবার


খোলা খাবারের ধরন

চানাচুর, গজা, বাদামের টানা, নিমকি, চিনির টানা, বুন্দি, মুড়ি মাখানো, বাদাম, বুটভাজা, ছোলা ভাজা, কাবলি মটর, নারকেলের খাজা, ছোলা ভুনা, পেঁয়াজু, জিলাপী, শিঙারা, গুলগুলি(ময়দা, চিনি দিয়ে তৈরী), বিস্কুট, কটকটি, চিপস, রুটি, ডাল, লাবড়া তরকারী, ডিম ভাজি, বড় চাপরি, বাতাসা, চিনির মিছরি,গ্লাস দই, তিলের টানা, গুড়ের টানা, দানাদার, সন্দেশ, চমচম, ফুচকা, আলুর চপ, ডিমের বড়া, সবজীর চপ, চিংড়ির বড়া, হালিম, বেগুনি, খেঁজুর গুড়ের পাটালি, বিভিন্ন প্রকার গাছন্ত গুড়া ওষুধ ইত্যাদি।


পথ খাবার


খাবার রাখার পাত্র

খাবার অনুপথ খাবারযায়ী বিভিন্ন ধরনের পাত্রের ব্যবহার হয়। যেমন- টিনের বড় কৌটা, পলিথিন ব্যাগ, টিনের বড় থালা, সিলভারের বড় থালা, সিলভারের ডিশ, ষ্টীলের ডিশ, পলিথিন বস্তা, বাঁশের চালা, মেলামাইনের প্লেট, চামচ, সিলভারের অপিরষ্কার পুরাতন পাতিল, প্লাষ্টিক বাটি।

কারা খাবার গ্রহণকারী

বাজার করতে আসা কৃষক শ্রেণীর লোকজনই এসব খাবার বেশি ক্রয় করছেন। এছাড়াও স্কুলের ছাত্র, শিশু, বাচ্চাসহ অভিভাবকরা এসর খাবার ক্রয় করছেন। কেউ কেউ কিনে বাড়িতে নিচ্ছেন আবার কেউ কেউ এসব খাবার কিনে দোকানের সামনে দাড়িয়ে খাচ্ছে। বিশেষ করে শিশু, ছাত্র, যুবকেরা দোকানের সামনে দাড়িয়ে ছোলা ভুনা, মুড়ি মাখানো,ফুচকা, শিঙারা, পেঁয়াজু জিলাপী খাচ্ছে। আর হাটে ফসল বিক্রি করতে আসা বেশিরভাগ লোকজন রুটি, ডাল,বড় চাপরি, লাবড়ার তরকারী, ডিম ভাজি খায়।


পথ খাবারপথ খাবার


পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

যারা খাবার বিক্রি করছেন তারা খালি হাতে এসর খাবার তুলে বিক্রি করছেন। রাস্তার পাশেই খাবারের দোকান বসায় ধুলা-বালি খাবারে গিয়ে পড়ছে। একই হাতে লাকড়ি দিয়ে চুলায় জাল দিচ্ছে এবং অন্যান্য কাজ করছে ঐ ময়লা হাতে আটা গুলছে এবং তাওয়ায় রুটি ছেঁকছে। নোংরা পানিতে গ্লাস, প্লেট পরিষ্কার করছে।


পথ খাবারপথ খাবার


খাবার পরিবেশনের ধরন

শুকনা খাবারগুলি পেপার, কাগজের ঠোঙা, পলিথিন প্যাকেট, পলিথিন ব্যাগ করে বিক্রি হচ্ছে। রুটি, বড় চাপরি মেলামাইনের প্লেট করে পরিবেশন করছে। হাত ভাল করে না ধুয়ে গ্লাস, প্লেটে খাবার দিচ্ছে। ফুচকায়ালা ময়লাযুক্ত হাতে বাটি চামুচে করে ফুচকা বিক্রি করছে আর একই পানিতে বার বার প্লেট পরিষ্কার করছে। দধি বিক্রেতা গ্লাস দই বিক্রি করেন আর বিক্রেতা দোকানে দাড়িয়ে কিনে খান। দইয়ের উপর রাস্তার ধুলা আর মানুষের পায়ের ধুলা পড়ে কালো হয়ে গেছে।


পথ খাবারপথ খাবার


পথ খাবার বিকেতা ও বণিক সমিতির সাথে আলোচনা সভা

দেলদুয়ার উপজেলার ৫ টি হাটের পথে খাবার বিক্রেতা ও নাল্লাপাড়া বাজার বণিক সমিতির সাথে পথ খাবার নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বনিস সমিতির সাথে আলোচনা সভায় সমিতির সেক্রেটারী, সাধারণ সদস্য, নয়াকৃষির কৃষক, পথ খাবার বিক্রেতা, উবিনীগ ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জনি, টাঙ্গাইল উবিনীগ কেন্দ্রের সমন্বক রবিউল ইসলাম চুন্নুসহ অন্যান্য কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। বনিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আঃ কুদ্দুস বলেন, এটা একটা ভাল উদ্যোগ। খোলা খাবার যারা বিক্রি করেন তারা যেন খাবার ঢেকে বিক্রি করেন আমরা তার তদারকি করব। উবিনীগ, দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা টাঙ্গাইল দেলদুয়ার উপজেলার একটা ভাল উদ্যোগ। দেলদুয়ার উপজেলার অন্যান্য হাটে যারা খাবার বিক্রি করেন তারা এরকম সহযোগিতা পেলে খোলা খাবার ঢেকে বিক্রি করতে সচেতন হবেন।

আলোচনা শেষে বাজার নয়াকৃষির কৃষক এবং কমিটির সদস্যসহ বাজার পরিদর্শন করা হয়। পর্যবেক্ষণকালে খোলা খাবার বিক্রেতাদের সাথে আলোচনা করা হয় এবং ৫টি হাটে মোট ৪০জন পথ খাবার বিক্রেতার মাঝে খাবার ঢেকে বিক্রি করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

উপসংহার

পথ খাবার সপ্তাহ উদযাপনের সময় হাট বাজারে ক্রেতা ও ভোক্তাদের মাঝে যথেষ্ট ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। নিরাপদ খাদ্য ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে প্রত্যেকেই তাদের তৎপরতা ও তা নিশ্চিত করার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। ভোক্তারা বলেন, আপনারা জনগণকে সচেতন করার জন্য একটি ভাল উদ্যোগ নিয়েছেন। মানুষকে সচেতন করতে আরো ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো দরকার। তবে খাবারে যে বিষাক্ত ফর্মালিন ব্যবহার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে জোড়ালোভাবে কাজ করা প্রয়োজন। ছবি উঠাতে দেখে কিছু দোকানদার পেপার দিয়ে তাদের খোলা খাবার ঢাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। কিছু দোকানির সাথে কলা বলে জানা যায় তারা পুঁজির অভাবে সাপ্তাহিক হাটগুলোতে রাস্তার পাশে এরকম ছোট খাবারের দোকান দিয়ে খোলা খাবার বিক্রি করেন। তবে পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে তারা খুবই তৎপর। দেলদুযার উপজেলা পরিষদ ও উবিনীগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা, পর্যবেক্ষন ও খাবার ঢেকে রাখার সামগ্রী পেয়ে পথ খাবার বিক্রেতারা তাদের উৎসাহ ও তা বাস্তবায়নের পক্ষে যথেষ্ট আন্তরিক ও তৎপর। নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি ও নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এই ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ আরো গ্রহন করা প্রয়োজন।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।