মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নৈরাজ্য


বিগত কয়েকদিন ধরে শহীদ মিনারে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। তাদের দাবী হচ্ছে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন আগের দিন রাতে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তাই যে ফলাফল বেরিয়েছে তার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তারা এই পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার দাবী করছে। আমি এ দাবীর প্রতি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিশেবে আমার সংহতি প্রকাশ করছি, এবং আশা করছি দ্রুত এই সংকটের সমাধান হবে। একই সাথে আশা করছি এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেন্দ্র করে যে কয়েকটি মূল প্রশ্নগুলো সামনে আসছে তার একটা সুরাহার পথ খোলা হবে।

প্রথমেই মেডিকেল কলেজে ভর্তিচ্ছু শিকার্থীদের কথায় আসি। শিক্ষার্থীদের হাতে একটি ফেস্টুনে লেখা আছে ‘প্রশ্ন যদি হয় ফাঁস, পড়ব কেন বার মাস?’ সহজভাষায় মূল কথাটি বলে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাবী করা হলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা প্রমান হিসেবে ইন্টারনেটের প্রিন্টগুলো টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। তাদের কাছে অকাট্য প্রমান আছে বলেই তারা পুলিশের লাঠিপেটা ও বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। উল্টো দিকে সরকার শুধু অস্বীকার করে যাচ্ছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, কিন্তু প্রমান হাজির করছে না। শুধু তাই নয়, সরকার ফলাফল ঘোষণায়ও একটু তড়িঘড়ি করেছে। সে প্রশ্নও শিক্ষার্থীরা তুলছে। তাহলে সমস্যা কিছু একটা অবশ্যই আছে। মোট কথা হচ্ছে, দোটানায় পড়ে এই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে যারা এখন ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে তাদেরও ক্ষতি হবে। তারা ডাক্তার হয়ে যখন বের হবে তাদেরকে সেই ফাঁস হওয়া ব্যাচ হিসেবে চিহ্নিত করা হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। এতে তাদের ক্যারিয়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমার ধারণা। এই কথাটি ফাঁস হলে তাদের আজীবন খেসারত দিতে হবে। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ফাঁসের সুযোগ নিতে পারে নি, তারা হয়তো সঠিকভাবেই পরীক্ষা দিয়েছিল কিন্তু তাদের গায়েও একই কলংকের দাগ পড়ে যাবে। কাজেই এই পরীক্ষা বাতলের দাবী মেনে নেয়ার মধ্যে সকলেরই উপকার আছে। আর, প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপার তো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যেন গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার গুঙত মানের ক্ষয় এবং তার পরিণতি তরুণদের ক্যারয়ারে প্রভাবকে কোন ভাবেই হাল্কা ভাবে নেবার সুযোগ নাই।

শিক্ষার্থীদের এই দাবীর সাথে দেশের মেডিকেল শিক্ষার পুরো ভবিষ্যত জড়িত। একটা পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনা করা হয়ে গেছে বলে আবার পরীক্ষা নেয়া যাবে না এমন কথা যারা বলছেন আমি তাদে্র সাথে একমত নই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীরা ঢুকলে পরবর্তী সময়ে পুরো পেশার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে’’। তাদের কথাটি মোটেও অযৌক্তিক নয়, কাজেই এখন এই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল না করলে এই নিয়ম কোন দিনই বন্ধ হবে না ।

‘প্রশ্ন যদি হয় ফাঁস, পড়ব কেন বার মাস?’ প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়ে এটাই আসল কথা। কারণ যারা ভালভাবে পড়ে, প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এবং সে পরীক্ষায় যে ফল আসে তাই মেনে নিয়ে ডাক্তারি পড়তে চান তাদের নৈতিক মনোবল অনেক বেশী থাকবে। আর যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে অনায়াসে ডাক্তার হবেন তাদের শুরুতেই নৈতিক স্খলন ঘটে গেলে তার ভবিষ্যত ঠিক করা মুশকিল হয়ে যাবে।

যারা চিকিৎসক হতে চান তাদের মেধা এবং নৈতিক চরিত্র উভয় খুব গুরুত্বপুর্ণ। নৈতিক বলতে তাদের আমি ফেরেস্তা হয়ে যেতে বলছি না। তারাও মানুষ, তাদের ইচ্ছা, আকাংখ্যা অনেক কিছুই থাকবে। কিন্তু ডাক্তারি পেশাটা এমন যে সাথে মানুষের বাঁচা মরার সম্পর্ক একেবারে সরাসরি। কেউ ডাক্তার হবে বলে মনস্থ করলে আমরা ধরে নেই তিনি সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে চান। তার কাছে মানুষ আসে সবচেয়ে দুর্বল মুহুর্তে। তবে কারো অসুখ হলেই সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ী যেতে পারবে, মারা যাবে না, এমন কথা কেউ বলে না। কিন্তু চিকিৎসা সঠিকভাবে হলে এবং তারপর কিছু করার না থাকলে স্বজনেরা মন কে সান্তনা দিতে পারেন। কিন্তু এটাও ঠিক যে ডাক্তারের অবহেলা, ভুল চিকিৎসা, তার বাণিজ্যিক আচরণ রোগীদের রোগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। বর্তমানে চিকিৎসকদের মধ্যে বাণিজ্যের যে বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে, তাতে আতংকিত হতে হয়। দেখলাম আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি ফেস্টুনে লেখা রয়েছে, ‘ডাক্তার চাই, কসাই চাই না” । ডাক্তারের সাথে কসাই নাম জুড়ে যাওয়ার মতো দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। অথচ এই কথা এখন খুব শোনা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবা বেসরকারি মুনাফা খাতের সাথে জুড়ে যাবার পর মানুষের রোগ ডাক্তারের উপার্জনের মাধ্যম হয়ে গেছে। তারা এই রোগ জর্জরিত মানুষের কাছ থেকে যেমন করে পারো আদায় করো, এই নীতিতে নেমেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিতে সেবাখাত যখন থেকে ঢুকেছে তখন থেকেই হাসপাতালগুলো আধুনিক কসাইখানায় রূপান্তরিত হয়েছে।

মেডিকেলে ভর্তি্র প্রশ্নের সাথে ‘কসাই’ ডাক্তারের কথাটি যুক্ত হয়েছে দেখে বুঝতে হয় যে শুরুতেই যদি অ-নিয়মের মাধ্যমে কেউ ডাক্তারি পড়তে আসে সে ডাক্তার হবে নাকি ‘কসাই’ হবে সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে একটি সার্টিফিকেট নিয়ে ডাক্তার হিশেবে সরকারি চাকুরী পাওয়া যায় আবা্র তারাই বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চ বেতনে এবং উচ্চহারে ‘ফি’ নিয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখা যায়। মেডিকেল শিক্ষা আসলে কতটুকু প্রয়োজন এবং কোন বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজন তা নিয়ে সরকারের খুব ভাল কোন চিন্তাভাবনা নেই। যে যা পড়তে চায় তাই পড়তে দেয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগে কম্যুনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি সভায় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বেসরকারী মেডিকেল কলেজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘কলেজ তো হবে কিন্তু শিক্ষক কই? এরা তো মানুষ বাঁচাবার ডাক্তার হবে না, মানুষ মারার ডাক্তার হবে।’ শুনেছি অনেক মেডিকেল কলেজে এনাটমী পড়াবার মতো শিক্ষক নেই। এনাটমী না পড়ে যে ডাক্তার হবে তার কাছে মানুষের শরীর একটি জড়পিণ্ড ছাড়া তো আর কিছু নয়! এর মধ্যে শুধু ওষুধ ঢোকাও, আর প্রয়োজন হলে শরীরের অংগ কেটে ফেলে দাও, আর বেশী অবস্থা খারাপ হলে আইসিইউ নামক রুমে ঢুকিয়ে রাখ! ভালই পয়সা আসবে। এসব বলছি, ইদানীং বেশ কিছু ঘটনা দেখে। নিজের মন গড়া চিন্তা থেকে নয়।

দিক নির্দেশনার অভাবে শিক্ষার্থীরা সেটাই পড়ছে যা তাদের দ্রুত আয় উপার্জনে সাহায্য করবে। অভিভাবকরা কষ্ট করে পড়াচ্ছেন তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। অথচ দেশের স্বাস্থ্য জনবলের মধ্যে কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা দেখা হচ্ছে না। যেমন অনেকেই সার্জন হতে চায়, কিন্তু এনেসথেশিয়ার ডাক্তারের অভাব রয়েছে। রোগীকে বেহুঁশ না করে (আংশিক কিংবা পুরো) কি করে অপারেশন হয়? ডাক্তাররা কথায় কথায় অপারেশন করার কথা বলেন কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারের কোন নজর নেই।

মেডিকেলে ভর্তির আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিতে হলে আমাদের শুধুমাত্র এটাকে মেডিকেলে পড়তে ইচ্ছিক শিক্ষার্থীর দাবী হিসেবে না দেখে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কি হয় নাই সেই বিবেচনায় পক্ষ-বিপক্ষে ভাগ না হয়ে দেখতে হবে আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্য জনবল সৃষ্টিতে ডাক্তারি পড়াটা কোন দিকে যাচ্ছে এবং তা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিশেবে হচ্ছে কিনা। কোন পরিকল্পনা ছাড়া মেডিকেলে ভর্তি করালেই দেশের সমস্যার সমাধান হয়, নাকি শুধু কিছু ‘ডাক্তার’ নামক পেশাজীবী তৈরি হয়। আমরা জানি স্বাস্থ্য সেবা মানে শুধু বড় বড় হাসপাতালের বিল্ডিং তৈরি করা নয়। একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ হচ্ছে স্বাস্থ্য জনবল, যার মধ্যে ডাক্তার গুরুত্বপুর্ণ কিন্তু একমাত্র জনবল নয়। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তারের পাশাপাশি নার্স এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ান যথেষ্ট নেই। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা হচ্ছে ৬০,৪১৩ জন; তার পাশাপাশি, নার্স ৩০,৬৮০ জন এবং মেডিকেল এসিস্টেন্টের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৯০৩৬ জন এবং ডেন্টাল টেকনিশিয়ান মাত্র ২১৭০ জন। অন্যদিকে ফার্মেসি ডিপ্লোমার সংখ্যা ৯২৬৫ জন আর ফার্মেসি টেকনিশয়ানের সংখ্যা ৫২,৫০৫ জন। ওষুধ দেয়ার লোকের অভাব নাই, অসুখ চেনার এবং অসুস্থ মানুষকে সেবা দেয়ার লোকের অভাব আছে। এলোপ্যাথিক ডাক্তারি পেশায় রোগ নির্ণয় করতে কথায় কথায় টেস্ট করার কথা বলা হয় কিন্তু ল্যবরেটরী টেকনিশিয়ান সরকারি হিশাবে আছে মাত্র ৬৬১৪ জন, রেডিওগ্রাফি ১৭৪৬ জন, রেডিওথেরাপিস্ট মাত্র ১৮৯ জন। এর বাইরেও কিছু থাকতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নাই বলা যায়। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য জনবলের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। এই তথ্যগুলো আমাদের জানা জরুরী এই কারণে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনবল বলতে শুধু চিকিৎসক নয় সবধরণের জনবল দরকার। কোন ডাক্তার একা কোন চিকিৎসা করতে পারে না, তা্র সাথে অন্য ধরণের দক্ষতা সম্পন্ন সহায়ক লাগে। সেটা তৈরির কোন পরিকল্পনা নাই। আর চিকিৎসকরা চিকিৎসা নয় ওষুধ বেচার কাজেই ব্যবহার করছেন নিজের অর্জিত জ্ঞান। ওষুধ কোম্পানির লোক তাদের চেম্বারে পাহারা দিয়ে রাখছে তাদের ওষুধ লিখলো কিনা।

এদিকে বেসরকারী ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় নামধারী হাসপাতাল যেখানে বড় লোকরাই যায় তারাও এখন আর নিরাপদ নয়। ভুল চিকিৎসায় তারাও মরছে, কিংবা ভুগছে। ছোট ছোট ক্লিনিকে রোগী বলতে প্রসুতি মা থেকে শুরু করে নবজাতক শিশুও বাঁচতে পারছে না।

আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, কিন্তু রোগ তো কমে নি। তার সুস্থ থাকা দরকার। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়গুলোও সামান্য হলেও সামনে নিয়ে আসতে পেরেছে। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই, এবং সমর্থন জানাই।

৬ অক্টোবর ২০১৫। ২১ আশ্বিন ১৪২২


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।