আমরা কাওরা সম্প্রদায়, নিচু জাত বলে ডাক্তাররা আমাদের দেখতে চায় না


আমরা নিচু জাত বলে ডাক্তাররা আমাদের দেখতে চায় না। বাজারে ওষুধের দোকানদারকে দেখাই

অবহেলা ও অনাদরে দিনের পর দিন না খেয়ে যাদের দিন কাটে তাদের আবার স্বাস্থ্য কিসের?” কাওরা সম্প্রদায়ের শিপ্রা মন্ডল। বয়স ৩৫ বছর। অসুস্থ হলে কোথায় চিকিৎসা সেবা নেন, জানতে চাইলে এভাবেই উত্তর দেন।

স্বাস্থ্য আন্দোলন কাওরা সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে একটি মত বিনিময় সভার আয়োজন করে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় আড়ংঘাটা, খুলনায়। এই আলোচনা সভার প্রধান বিষয় ছিল কাওরা সম্প্রদায়ের অসুস্থতার ধরণ এবং অসুস্থ হলে সেবা গ্রহণের জন্য তারা কোথায় যায়। এখানে উপস্থিত ছিলেন ২১ জন নারী ও ৬ জন কিশোরী। এই আলাচনা পর্বটি প্রাণবন্ত করে তুলেন নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সমন্বক সাইদা আখতার এবং গবেষণা সহযোগী মাহমুদা নার্গিস। নাইস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেন সমন্বক মির্জা তাহমিনা আক্তার।

কাওরা সম্প্রদায়

খুলনায় কাওরা সম্প্রদায়ের মূল পেশা হলো শুকরের পাল চরানো। শুকরের পাল চরাতে হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। মাঠে মাঠে শুকর চরানোই তাদের কাজ। আঞ্চলিকভাবে এদেরকে ‘শুকর রাখাল’ বলে।

শুকরের সাথেই এদের রাত্রি যাপন করতে হয়। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাদের থাকতে হয়। এ সব রাখালদের বেতন খুবই সামান্য। প্রতি মাসে ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। এক বছরের চুক্তিতে তাদেরকে কাজে যেতে হয়। মালিক তাদেরকে খাওয়া ছাড়া বছরে ৪টি মাত্র লুঙ্গি ও ৪টি গামছা দিয়ে থাকে। এদিকে মাস শেষে বেতনের সামান্য টাকার জন্য বাড়ীতে পরিবার পরিজনেরা অপেক্ষায় থাকে। মালিক বাড়িতে এসে টাকা দিয়ে যায়। এই সামান্য টাকায় ভাত, কাপড় কোনটাই হয় না। দিনের পর দিন তাদের অর্ধাহারে, অনাহারে থাকতে হয়। পেট ভরে বাচ্চাদের মুখে খাবার দিতেই পারে না তো লেখাপড়া শেখাবে কিভাবে? এ অভাবের সংসার থেকে আট দশ বছর বয়স হলে ছেলেদের চলে যেতে হয় শুকরের পাল চরাতে আর মেয়েদের জন্য করা হয় বিয়ের বন্দোবস্ত।

শুকর পালন ছাড়া তারা আর কোন কাজ করতে জানে না বলে বংশের ধারাবাহিকতায় পরিবারের সবাই শুকরের পাল চরায়। সমাজে তারা ঘৃণিত অস্পৃশ্য। আর নারীদের কাজ বাড়ীতে থেকে সংসারের কাজ করা। সম্প্রতি কিছু কিছু নারীরা কেউ রাজমিস্ত্রীর জোগালের কাজ করে, শামুক ভাঙ্গে, চিংড়ীর ডিপোতে মাছের মাথা আলাদা করে, রাস্তার কাজ করে। আবার কেউ কেউ ধানের ক্ষেত পরিস্কারের কাজ করে। এদের পারিশ্রমিক অতি সামান্য।

এই কাওরা সম্প্রদায়ের সন্তানরা অভাবের তাড়নায় শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্কুলে যেতে পারে না। অন্যত্র খোলামেলাভাবে মিশতে পারে না সামাজিক অবহেলার কারণে। তারা সব সময় নানাবিধ সামাজিক চাপের মুখে থাকে।

কাওরা সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার বিষয়টি খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। ১২ বছর বয়সের নীচে শিশুদের অসুখের মধ্যে জ্বর, সর্দি, কাশি, জিহ্বায় ঘা, মাথা যন্ত্রণা, গালে ঘা (মুখে ঘা) দেখা যায়। আর ১২ থেকে ১৮ বছরের মেয়েদের অসুখের মধ্যে বেশী দেখা যায় মাথা ব্যথা, দূর্বলতা, পেট ব্যথা, লিভারের সমস্যা, চোখ জ্বালা পোড়া, সাদা¯স্রাব ভাঙ্গা। এই সমস্যা হলে সাধারণত: কবিরাজি ওষুধ খাওয়ান হয়। নারীদের অসুস্থতায় দেখা যায় মাথাব্যথা, জরায়ুর সমস্যা, নাড়ী বাড়ানো, হাত-পা ফুলে যায়, জ্বর, সর্দি। বেশি হয় ঘা, পচড়া, মাথা যন্ত্রণা, গ্যাস, বুকে ব্যথা। এরা নিচু জাত বলে ডাক্তারা দেখতে চায় না। বাজারের ওষুধের দোকানে অসুখের ধরণ বলে ওষুধ কিনে আনে।


কাওরা সম্প্রদায়


ঝর্ণা বিশ্বাস বলেন, “আমাদের এখানে পাশ করা কোন ডাক্তার নাই। এই পাড়ায় নাইস ফাউন্ডেশন (স্থানীয় এনজিও) ডাক্তারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একজন নার্স সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পযর্ন্ত সেবা দিয়ে থাকে। কারো হাত-পা কেটে গেলে ব্যান্ডেজ করে দেয়া, কেউ ডাক্তার দেখিয়ে, যদি এখানে এসে ইঞ্জেকশন পুশ করতে চাইলে তাকে পুশ করে দেয়, স্যালাইন দেয়, চেক আপ করা, ওজন মাপা এরকম সাধারণ স্বাস্থ্য সেবাগুলো দিয়ে থাকে। এছাড়া সর্দার ডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক আছে সেখানে আমরা যাই।

বড় রোগ হলে ২৫০ বেডের হাসপাতালে, আবু নাসের হাসপাতাল (হার্ট ও কিডনীর সমস্যার জন্য), আকিজ মেডিক্যালে যাই। ২৫০ বেডের হাসপাতালে টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাই। সব ধরণের চিৎিসার ব্যবস্থা আছে। প্রেসক্রিপশন করে দেয় বাইরে থেকে ওষুধ কিনে খেতে হয়। টাকা থাকলে কিনে খাই না থাকলে খাই না।”

কাওরা সম্প্রদায় শুকুরের সাথে সম্পৃক্ত আছে বিধায় ডাক্তার ও নার্সরা তাদের চিকিৎসা দিতে অস্বস্তি বোধ করে।

সমাজে অবহেলিত, নিগৃহীত এরা পায় না কোনো স্বাস্থ্য সেবা। সমাজ থেকে আলাদা হয়ে থাকার কারণে এরা সাহস করে বাইরেও যায় না। কোথায় গেলে কি ধরণের সেবা পাওয়া যায় সেটা তারা জানে না। আবার জানার পর সেখানে গেলে সে সমাজের অন্য লোকের মত স্বাভাবিক সেবা পাবে কি না এই সংশয় তার থাকে। বর্তমানে সরকারী/বেসরকারী যেসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে যারা এলাকায় গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা অর্থাৎ মা ও শিশুর সেবা দেন তারা এখন কাওরাদের কাছে যান। তবে কাওরা সম্প্রদায় মানুষদের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা দিতে নয়। শুধুমাত্র বিবাহিতা কাওরা নারীদের সন্তান নিয়ন্ত্রণের জন্য কপার্টি, ইঞ্জেকশন ও লাইগেশন করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতেই তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকে। এ কাজের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা কিছু কমিশন পায়। এদিকে যাকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দেওয়া হচ্ছে সে কেমন আছে, সে মরবে না বাঁচবে তার হিসেব কারো কাছেই নেই। ভুক্তভোগীরা সর্বদা এ ধরণের স্বাস্থ্য কর্মীদের সেবার আতংকে থাকে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।