ডায়াবেটিস রোগীদের অভিজ্ঞতা


ডায়াবেটিস রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা পায় কিনা সেই বিষয়টি জানার জন্য ৩ এপ্রিল, ২০১৬ বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি রিংরোড, শ্যামলী সেন্টারে গিয়ে কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বলে যে তথ্য পেয়েছি তা তুলে ধরছি।

আছিয়া খাতুন (বয়স ৬৫) আমি এসেছি মাহানপুর, শ্যামলী এলাকা থেকে। ত্রিশ বছর থেকে আমি ডায়াবেটিসে ভুগছি। আমরা স্বামী স্ত্রী দু,জনেই ডায়াবেটিস রোগী। প্রথমে আমার পিঠে একটি ফোঁড়া হয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে সেই ফোঁড়ার যন্ত্রণায় কষ্ট পাই। যখন না ভাল হয় তখন ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার ফোঁড়া অপারেশন করে ওখান থেকে পুঁজ নিয়ে পরীক্ষা করতে বলেন। পরীক্ষা করার পর ধরা পরে আমার ডায়াবেটিস হয়েছে। আগে মাঝে মাঝে মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যেতাম। নিউরো সার্জন এর কাছে চিকিৎসা নিয়ে ওষুধ খাওয়ার পর এটা ভাল হয়েছে। প্রথমে শাহাবাগে ডায়াবেটিকস হাসপাতালে চিকিৎসা করতাম। চার বছর ধরে বাংলাদেশ ডায়াবেটিসক সমিতি শ্যামলী সেন্টার থেকে চিকিৎসা নেই। শাহবাগের ডাক্তারা বলেছেন আপনার কাছের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেবেন। ডায়াবেটিস এর কারণে আমার আরও শারীরিক সমস্যা হয়েছে যেমন: দুই চোখে ছানি পড়েছে অপারেশন করেছি। মাঝে মাঝে পায়ে পানি এসে পা ফুলে যায়। প্রেসারের সমস্যার জন্য প্রেসারের ওষুধ খেতে হয়।

এই হাসপাতালে ডাক্তারের ফি ১০০ টাকা। ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়। প্রতিমাসে দু,ইজনের ৬০০০ টাকার ওষুধ লাগে। এখান থেকে কোন ওষুধ দেয় না। ইনসুলিন ইনজেকশন ২ বেলা নিতে হয়। আমার স্বামী টেবলেট খায়। এখান থেকে যে টেষ্ট দেয় তার খরচ অনেক বেশি, ৪০০০ টাকা লেগেছে। ২/৩ মাস পর পর সব কিছু টেষ্ট করতে দেন। ডায়াবেটিস সুগার বাড়ল না কমলো সেটা বাড়িতে নিজেরাই করি। সব টেষ্ট এখানে হয় না অন্যান্য টেষ্ট বাহির থেকে করতে হয়। আমাদের চিকিৎসার খরচ আমার ছেলে বহন করে।

নূরুল আলম (বয়স ৭৪ বছর)। আমি এসেছি মাহানপুর, শ্যামলী এলাকা থেকে। পঁচিশ বছর থেকে আমি ডায়াবেটিসে ভুগছি। আগে থেকে আমি কোন সমস্যা বুঝিনি। আমার মায়ের ডায়াবেটিস ছিল আমার স্ত্রীর ও ডায়াবেটিস । যেহেতু বয়স বেশি হয়েছে তাই সব চেকআপ করি তখন ধরা পড়ে আমার ডায়াবেটিস। ২৫ বছর ধরে ডায়াবেটিসের ওষুধ খাই। বর্তমানে আমার শারীরিক সমস্যা হচ্ছে হার্ঠের সমস্যা, হাটু ব্যথা, কোমড় ব্যথা, ঘাড় ব্যথা। এই হাসপাতাল থেকে কোন ওষুধ দেয় না সব ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়। চিকিৎসার খরচ আমার ছেলে বহন করে।

নাজমুন্নাহার (বয়স ৫১ বছর)। আমি এসেছি পিছিকালচার শ্যামলী থেকে। আমরা স্বামী স্ত্রী দু,জনেই ডায়াবেটিস রোগী। ২০০৭ সালে আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। খুব বেশি পানি পিপাসা লাগতো, কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুধা লাগতো, ঘন ঘন প্রস্রাব হতো। তখন বারডেমে গিয়ে সব পরীক্ষা করার পর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এখন শ্যামলী সেন্টার থেকে চিকিৎসা নেই। আগে ডায়মেরল টেবলেট খেয়েছি। এখন এম আর -৩০ খাই।

ডায়াবেটিস হওয়ার পর আমার আরো অন্যান্য রোগ বেড়েছে যেমন প্রেসার, চোখের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, কলস্ট্রোল, অর্থরাইটিস, ইউরিন ইনফেকশন। কয়টার ওষুধ খাব। বাহির থেকে সব ওষুধ কিনতে হয়। টাকার সমস্যার জন্য মাঝে মাঝে ওষুধ খাইনা। আমার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল নয়। নিয়মিত ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনি বলে তারা কিছুটা ডিসকাউন্ট দেয়। তবও মাসে আমার ২০০০ টাকার ওষুধ লাগে। ডাক্তারা বিভিন্ন ধরণের টেষ্ট দেয়। এখানেও করাই যেগুলি এখানে না হয় সেইগুলি পপুলারে করাই। ৪০০০ টাকা লাগে টেষ্ট করাতে। আমার স্বামীর তারও ডায়বেটিস। সে ব্যবসা করে। দুই বছর হয় তার ডায়বেটিস ধরা পড়ছে। ৬.৫ থাকে সুগার। তার হার্টের সমস্যা আছে, কলস্ট্রোল আছে। কখনও ওষুধ খায় না। নিয়ম মেনে চলে শুধু হাটাহাটি করে।

জাহানারা বেগম (বয়স ৫৪ বছর)। আমি এসেছি মোহাম্মদপুর বাবররোড থেকে। আট বছর ধরে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। বাব, মার ডায়াবেটিস আছে ওনারা বাড়িতে টেষ্ট করে। আমার যেহেতু বয়স হয়েছে তাই একদিন প্রসাব টেষ্ট করি আমি এবং আমার বোন। দেখা গেল আমাদের দ,জনেরই ডায়াবেটিস আছে। অন্য কোন শারীরিক সমস্যা আমাদের ছিল না। আট বছর ধরে ডায়াবেটিসের ওষুধ খাই। এমআর ইল-৩ প্রতিদিন সকালে ১ টা। গ্যালভ্যাট দুপুরে ১ টা। এক মাসে ১২০০ টাকার ওষুধ লাগে। আমার ডায়াবেটিস তেমন জটিল না। সব ধরনের পরীক্ষা এখানেই করি। তিন মাস পর পর সব টেস্ট করতে বলে। সব ধরনের পরীক্ষা এখানেই করি। ডায়াবেটিস ফাষ্টিং, কলস্ট্রোল পরীক্ষা ১০০০ টাকা লাগে টেস্ট করাতে। সব ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়। ডাক্তারের ভিজিট প্রথম বার ১০০ টাকা দ্বিতীয় বার আসলে ৫০ টাকা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখালে ৩০০ টাকা ভিজিট নেয়।

আবুল কাশেম পেয়াদা (বয়স ৬০ বছর) । থাকি মাহানপুর এলাকায় । রাজমিস্ত্রী যোগালী হিসেবে কাজ করি। বর্তমানে অসুস্থ হওয়ায় কোন কাজ তেমন করতে পারি না। আমার তিন মেয়ে গারর্মেন্টে কাজ করে। এই দিয়ে কোন রকম সংসার চলে। ঘন ঘন প্রসাব হতো দিন দিন শরীর শুকিয়ে যাচ্ছিল । ২০১৫ সালের জুলাই মাসে শ্যামলী মাঠে একটি ছেলে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে তার কাছে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করি। আমার সাথে আরেক জন কাজ করে সেও ছিল। এসময় আমার পকেটে ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। আমার সহকর্মীর কাছে ছিল ১০০০ টাকা। আমার ডায়বেটিস ধরা পড়ে । সুগার ৩০ ছিল। এই পরীক্ষার রিপোর্ট আমার সন্দেহ হয়। তাই আবার শ্যামলী ডায়াবেটিস সমিতি হাসপাতালে গিয়ে পুনরায় পরীক্ষা করি। সেখানেও সুগার ৩০ ছিল। পরীক্ষার পর ডাক্তার ৪০০ টাকার ওষুধ দিয়েছে। ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়। ৪ দিন এই ইনজেকশন নেয়ার পর আমি আরো অসুস্থ হয়ে পরি। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হই। সেখানে ৯ দিন ছিলাম। ভর্তি হওয়ার পর সেখানেও ডাক্তারা সব কিছু পরীক্ষা করেন। সব পরীক্ষা বাহির থেকে করতে হয়েছে। সেখানেও ২৫০০ লেগেছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আবার ডায়াবেটিস হাসপাতালে যাই ডাক্তারকে প্রেসক্রিপশন দেখাতে। ডাক্তার আমার উপর অনেক রাগ হয়। বলে যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে যান। আমাকে আর তারা দেখলো না। গরিব বলে ডাক্তাররা আমাদের দাম দেয় না। সোহরাওয়ার্দী থেকে ডাক্তার যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল ঐটা দেখিয়ে ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনি । আমার আগে থেকে শ্বাসকষ্ট ছিল। শ্বাস কষ্টের জন্য মোহাম্মদপুর হারবাল সেন্টার থেকে ৪০০০ টাকার ওষুধ খেয়েছি। ঐ ওষুধ খাওয়ার পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলাম। তখন ঐ ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে শ্বাস কষ্টের জন্য টেব: থিওফাইলিন খাই। ডায়াবেটিস হওয়ার পর আমার আরো রোগ বেড়েছে। মাঝে মাঝে শরীরে পানি আসে মুখ, পা, ফুলে যায়, গিড়ায় গিড়ায় ব্যথা করে। পানি কমার জন্য ওষুধ খাই। শরীর চিপে দিতে হয়। মাসে ১৫০০ টাকার ওষুধ লাগে টাকার জন্য ঠিকমত ওষুধ কিনতে পারি না।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।