স্বাস্থ্য খাতে চরের মানুষদের কথা চিন্তায় রাখা দরকার: চিলমারীতে স্বাস্থ্য আন্দোলন-এর মতবিনিময় সভা


গরীব ও নিঃস্ব মানুষ নানাভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। চরে কোন ডাক্তার নাই। চর থেকে সদরে যেতে হলে পাড়ি দিতে হয় ব্রহ্মপুত্র নদ। বিশেষভাবে চর এলাকার মানুষেরা স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজন অনুসারে পাচ্ছেন না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত গরিব ও অবহেলিত মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কি ধরনে বাজেট হওয়া উচিত তা নিয়েই এই মতবিনিময় সভায় আলোচনা হয় ২১ এপ্রিল, ২০১৬ চিলমারীর মনতলা চরে।

নাজমুল হুদা পারভেজ: সাংবাদিক

সমস্ত চিলমারীটাই চর। এখানে এত নদী ভাঙ্গন যার কারণে চরের মানুষের বসবাসটাই এখন কাইম এলাকায়। চিলমারী হাসপাতালে ডাক্তার তেমন নাই। চরাঞ্চলের জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবাটা কোন পর্যায়ে আছে তা যদি একটু দেখি।

প্রথমত এই এলাকায় যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে সেখানে আমাদের যাওয়া আসা। চিলমারীর যে কাইম এলাকা মানে চর নয় সেই এলাকার লোকজন হাসপাতালে যায় সেবা নিতে। কিন্তু ডাক্তার যারা আছেন তারা সঠিক সময়ে যায় না হাসপাতালে। যারা ডিউটিতে আছে তারা মাঠ পর্যায়ের কাজে যাচ্ছে বলে খাতায় সাইন করে চলে যায়। সার দিনে আর হাসপাতালে নাই, তাতে মাঠ পর্যায়ে গেল কিনা সেটা দেখারও কেউ নেই। সেই ডাক্তার তার নিজের কাজ করে। এই ধরণের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো যে ধরণের সেবা দেবার কথা জনগণ সেই সঠিক সেবাটা পাচ্ছে না।

চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ ডাক্তারদের যে পোষ্ট আছে তার থেকে ডাক্তার অনেক কম। এখানে ইনডোর স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতাল। কিস্তি করে করে রাতের ডিউটি করে ডাক্তাররা। পুলিশ, আনসার যেমন কিস্তি করে ডিউটি করে এই হাসপাতলের ডাক্তারাও তেমনি কিস্তি করে জনগণের সেবা দেয়। একজন ডাক্তার ৬ ঘন্টা ডিউটি করে। এই ভাগটা প্রতি দিন হওয়ার কথা। কিন্তু এই হাসপাতালে তা হয় না। এটাকে যে সিস্টেম চালু আছে তা হলো একজন ডাক্তার পরপর দুই দিন মানে ৪৮ ঘন্টা ডিউটি করবে। সপ্তাহের বাকি ৬দিন আর সেই ডাক্তার হাসপাতালে আসবেন না। সে তার বাসাতে চলে গেছে। অন্য একজন ডাক্তার আসবে সেও পরপর দুই দিন ডিউটি করবে।

এই অবস্থায় জনগণ ঠিকমত চিকিৎসা সেবা পায় না। এমার্জিন্সে রুমে কেউ থাকে না। রেসিডেনসিয়াল মেডিকেল অফিসার নাই। মেয়েদের ওয়ার্ডের বাথরুমে কোন বাতি নাই। বাথরুম সব নষ্ট।

সরকারের ইউনিয়ন ভিত্তিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বাড়াতে হবে। এবং সেখানে চিকিৎসক হিসাবে যোগ্য ব্যক্তিকে পোষ্টিং দিতে হবে যেন চিলমারী ইউনিয়নবাসীকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে পারে।

ডাক্তাররা বলে চিলমারীতে থাকতে তাদের সমস্যা এই কথা বলে তারা যে কোন ভাবে চলে যায়। এমনও সময় হয় যখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনই ডাক্তার থাকে না। থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ হাসপাতালের ডাক্তার যারা আছেন তাদের থাকার জন্য হাসপাতালের জায়গায় তাদের আবাসিক ভবন আছে। সেই হাসপাতালের ভবনে তারা থাকেন না। তারা থাকেন কুড়িগ্রাম অথবা রংপুরে। এবং এর জন্য তারা বাড়ি ভাড়া পায়।

এই ঘটনাগুলো প্রশাসনের সামনেই ঘটছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান সবাই বিষয়টি জানেন। ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান জানেন।

পাশাপাশি চরের মহিলাদের নরমাল ডেলিভারী যাতে চরেই করা সম্ভব হয় তার জন্য অভিজ্ঞ দাইমাদের প্রশিক্ষিত করা দরকার। যেমন এই মনতলা দাইঘর, চরের মানুষের জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শের কাজে সহায়তা করে চলেছে। আসন্ন বাজেটে চরের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।


নূরুল আমিন


নূরুল আমিন: সাংবাদিক

আমি পরিবার পরিকল্পনা বলি না বলি মরিবার পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখানে নাই। আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই ফেন্ডশিপ এবং টিডিএইচ ফেডারেশনকে। এরা যদি চিলমারীতে না থাকতো তাহলে আমাদের চরাঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্য সেবা থেকে হতো বঞ্চিত।

পরিবার পরিকল্পনা কর্মী বা স্বাস্থ্য সহযোগী চরের মানুষ এদের চিনতো না। কেননা তাদের যাতায়াতের জন্য নৌকা দরকার সেটি কিন্তু নাই। ফেন্ডশিপ এবং টিডিএইচ ফেডারেশন তাদের নৌকা দিয়ে এই সাপোটটা দিচ্ছে। টিভিতে দেখি বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্য কর্মীরা যাচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনার কর্মীরা যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। মেইন ল্যান্ডে যতটা যাওয়া যায় চরাঞ্চলে তেমন যাতায়াতের ব্যবস্থা নাই।

চরের অবস্থা এমন কড়াই বরিশাল চরে যদি একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র হয় তবে মনতলা চরের রোগী যদি কড়াই বরিশাল স্বাস্থ্য কেন্দ্র যায় তো পথেই রোগী মারা যাবে বা গর্ভবতী নারীর প্রসব হয়ে যাবে। কেননা নদী পার হতে হবে এবং রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। নদীর ঘাটে সবসময় নৌকা পাওয়া যায় না। এমন কি রোগীর মৃত্যুও হয়েছে নৌকার অভাবে।

চরের মানুষদের জন্য রমনা নয়ার হাটে সরকারী স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে তৈরী হয়েছে। অষ্টমির চর ইউনিয়নেও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে। সরকারী ভাবে একজন করে মেডিকেল অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন দিনও সেই মেডিকেল অফিসার ওই চরের মুখ দেখে নাই। ডাক্তাররা চরে যায় না।

একজন ডাক্তার তৈরী করতে সরকারের ৩৬ লক্ষ টাকা লাগে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা সরকার খরচ করে। একজন ভিক্ষুকও ট্যাক্স দেয়। সেই টাকাতেই সরকার ডাক্তার তৈরী করে। কিন্তু ডাক্তারী পড়া শেষ করার পরে ডাক্তারের আর সে কথা মনে থাকে না। আসলে এই সব ডাক্তারদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আবাসস্থলগুলোতে ডাক্তার থাকে না। কিন্তু বাড়ি ভাড়া করে থাকার টাকাটা তারা ঠিকই সরকারের কাছ থেকে নিয়ে নেয়।

হাসপাতালে কোন ওষুধ নাই। অতি সামান্য পরিমাণে ওষুধ। একজন রোগীর জন্য ১৭ টাকা বরাদ্দ। এই টাকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। চর এলাকায় যারা স্বাস্থ্য সেবার কাজ করছে তাদের চর ভাতা দেওয়া উচিত।

হাসপাতালে ফ্রিজ আছে, নষ্ট। লেবার ওয়ার্ড চালু হচ্ছে না। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয় হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য। এবারেও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য ৩০ লক্ষ টাকা এসেছে সেটা জুন-জুলাই, ২০১৬ অর্থবছর শেষের আগে কাজ হবে। সারা বছর যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে থাকলো। জনগণ কোন সেবা পেলো না। তা হলে এতটাকা খরচ করে এ সব মেরামত করে লাভটা কি? এটা জনগণের প্রশ্ন।

চিলমারীতে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলো চরাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে চরাঞ্চলে শুধুমাত্র দুটি বেসরকারী সংগঠন ফেন্ডশিপ ও টেরি ডাস হোমস্ ফেডারেশন (টিডিএইচ, ফেডারেশন) কাজ করছে।

চরাঞ্চলবাসীর জন্য রিভার এ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন। এখানে তিনটি চর ইউনিয়ন আছে। অষ্টমির চর, নয়ারহাট এবং চিলমারী। এই চরগুলির জন্য রিভার এ্যাম্বুলেন্স খুবই জরুরী এবং চর ভেদে স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। করাইবরিশাল এবং মনতলা চর পাশাপাশি। কিন্তু পশ্চিম মনতলা চরের জনগণ যদি সেবার জন্য করাই বরিশালে যায় তাহলে তাকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ পাড়ি দিতে হবে। নৌকা ভাড়া লাগবে অনেক। তারপরেও রাস্তা এতটাই খারাপ যে রোগী এই রাস্তায় মারা যাতে পারে। কিংবা রোগীকে যদি উপজেলা সদরে নেয় তাহলে রাস্তার যে অবস্থা তাতেও রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হবে। তাই চর ভেদে কেন্দ্র স্থাপন করা খুবই জরুরী।

ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যে ডাক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেই ডাক্তাররা যেন তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন এটা নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজ করার জন্য ডাক্তারদের যে সংগঠন আছে বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন (BMA) তাদের নজর রাখতে হবে।

বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন যারা স্বাস্থ্য নিয়ে চরাঞ্চলে কাজ করছে তাদেরও সরকারীভাবে সহায়তা দিতে হবে। সরকার নদী পারা-পারের জন্য নৌকা দিয়ে তাদের সহায়তা করতে পারে। তাহলে চরাঞ্চলের জনগণ সেই স্বাস্থ্য সেবাটা পাবেন। পাশাপাশি আমাদের বিভিন্ন চরে লেখা পড়া জানা যেসব ছেলে মেয়েরা আছে তাদেরকে ক্ষুদে ডাক্তার আকারে তৈরী করতে হবে। তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। এর জন্য সরকারকে আসন্ন বাজেট, ২০১৬ তে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এতে চরাঞ্চলের জনগণের স্বাস্থ্য খাতে যে ভোগান্তি তা কিছুটা লাঘব হবে।

নজরুল ইসলাম সাবু: সভাপতি, চিলমারী প্রেসক্লাব, চিলমারী

চিলমারী উপজেলা একটি নদী বিধৌত উপজেলা। তিনটি নদী- ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকা চিলমারী উপজেলা। এখনকার ভৌগলিক অবস্থানের দিকে তাকালে দেখা যাবে তিনভাগ নদী এবং চরাঞ্চল আর একভাগ কাইম আঞ্চল। অর্থাৎ উঁচু এলাকা। সেখানেই চিলমারীর সকল কর্মকান্ড।

চিলমারী উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটা এমন জায়গায় অবস্থান করছে যেখানে চিলমারী উপজেলার মানুষের স্বাস্থ্য সেবাই শুধু নয় চিলমারীসহ সুন্দরগঞ্জের ব্যাপক এলাকা উলিপুর উপজেলা, তবকপুর উপজেলা সহ অন্যান্য কয়েকটি উপজেলার লোকজনও চিলমারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। চিলমারীতে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ। কিন্তু সেবা পাচ্ছে কতজন তা আমাদের দেখতে হবে। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যদি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অবস্থান করেন তা হলে জনগণের স্বাস্থ্য সেবার যে দূরাবস্থা তা অনেকটা কমে যাবে। হাসপাতালে জেনারেটর নাই। দরকারী যন্ত্রপাতি নাই। যেগুলো আছে তা ব্যবহার হয় না।

প্রত্যক্ষ দেখা একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। চরাঞ্চলের এক গর্ভবতী মহিলা, অষ্টমির চরে তার বাসা। যখন তার প্রসব ব্যথা উঠে সেই মহিলা ঝুঁকিতে ছিল। দাইরা বাসাতে ডিলিভারী করতে পারে নাই। তারা চিলমারী হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করে অনেক কষ্ট করে। ব্রহ্মপুত্র নদী পাড়ি দেবার জন্য নৌকা সব সময় পাওয়া যায় না। সেই পরিবারের লোকদের নৌকা ভাড়া করারও ক্ষমতা নাই। অনেক কষ্ট করে মানুষের কাছে ধার দেনা করে যখন তাকে আনা হলো চিলমারী হাসপাতালে, তখন দেখা গেল কোন ডাক্তার সেখানে নাই। এমন কি হাসপাতালে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা না থাকার কারণে চিলমারী ঘাট থেকে যে মহিলাকে এম্বুলেন্সে আনবে তারও ব্যবস্থা করা গেল না। সারা রাত মহিলাটা হাসপাতালে পড়ে থাকলো এবং সকালে মহিলাটা মারা যায়।

আর একজনের কথা বলি, রৌমারী থেকে একজন লোক খুব অসুস্থ। তার বুকে ব্যথা নিয়ে আনা হলো রমনা ঘাটে। বার বার চাওয়া হলে চিলমারী হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স। চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তখন উলিপুরে তার ভাড়া বাড়িতে। চিলমারী হাসপাতালে সেই সময় যে টেকনিশিয়ান ছিল সে বললো, স্যারের পারমিশন ছাড়া এ্যাম্বুলেন্স দিতে পারবো না’। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে। তিনি এ্যাম্বুলেন্স দিব, দিব না করতেছে। এইভাবে ৪ ঘন্টা সময় পার হয়ে যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ইচ্ছার বাইরে এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার জোর করে গাড়ী বেড় করে রমনা ঘাটে আসে। কিন্তু দুঃখের কথা রমনা ঘাট থেকে রোগীকে হাসপাতালে আনতে আনতে রোগী মারা যায়।

যদি ৪ ঘন্টা আগে এ্যাম্বুলেন্সটা পাওয়া যেতে তাহলে হয় তো রোগীটাকে বাঁচান যেতো। চিলমারী হাসপাতালে রাতে কোন ডাক্তার থাকে না। হাসপাতাল চলে টেকনেশিয়াম দিয়ে।

ইউনিয়ন পর্যায়ে হাসপাতালের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে তারা যে দায়িত্ব পালন করে তারা সকাল ৯টায় নৌকায় উঠে বেলা ১২টায় চরে পৌঁচ্ছায়। এক ঘন্টা, আধা ঘন্টা তারা সেই চরে থাকে, সেবা দেয়। তারপরে তাদের বাড়ী ফিরতে হয়। বাড়ী ফিরতে ফিরতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। সর্বোচ্চ তারা চরের মানুষের চিকিৎসা সেবা দেবার সময় পায় ১ থেকে ২ ঘন্টা।

তাহলো যেটা খুবই জরুরী স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তারদের চরে আবাসনে ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হবে না। ধার যাক একটা লোক ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বা একটা ডেলিভারি হবে বা কারও হার্ট স্ট্রোক করেছে - তাহলে সেবার জন্য পরিবারের লোকেরা কাথায় নিয়ে যাবে?

যদি হাসপাতালে ডাক্তার থাকে তো প্রাথমিক চিকিৎসাটা করা যেতে পারে তারপরে অন্য জায়গায় নিলে হয়তো রোগীকে বাচান সম্ভব। কমিউনিটি হাসপাতালে তো কোন ডাক্তার নাই, নার্স নাই। এই কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে যদি ডাক্তার, নার্স দেওয়া যায় এবং তাদের আবাসন ব্যবস্থা থাকে তাহলে হয়তো চরের মানুষ কিছুটা সেবা পাবে।

একটা ঘটনা বলি, আমার গালে, চোখের নিচে, একটা ফোট হয়ছিল। চিলমারী হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার দেখে বললো আপনার মুখে ‘এনর্থ্রাস’ হয়েছে। আমি ভয় পেলাম। কি করা যায়। আমি তখন কুড়িগ্রামে এক ডাক্তারকে দেখালাম। চোখের নিচের সেই ফোট আবার পাকছে। ডাক্তার বললেন এটা তো এনথ্রাস নয় এটা একটা এলার্জি সংক্রান্ত ফোট। ভয়ের কিছু নাই। তিনি ওষুধ লিখে দিলেন। সেই ওষুধ খেয়ে ২দিনে ভাল হয়ে গেলাম। কিন্তু যে ডাক্তার আমাকে বললো “আপনার মুখে ‘এনর্থ্রাস’’ হয়েছে সেই ডাক্তার এখনও চিলমারী হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছে।

একজন জ্বরের রোগী হাসপাতালে আসলে তাকে এন্টিবায়োটিক ওষুধ দিলো ৩টা। এটাও কি ঠিক ডোজ কি না? এই ডাক্তাররা পড়াশুনা করেই ডাক্তার হইছে কিন্তু এখনও প্রেসক্রিপশন করতে জানে না। এই ডাক্তারগুলোকে সরকারীভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ায় ব্যবস্থা রাখা উচিত।

রানীগঞ্জ থেকে এক মা তার দেড় বছরের বাচ্চাকে আনছে চিলমারী হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে। বাচ্চা অসুস্থ, একটু একটু জ্বর হচ্ছে। হাসপাতালে বাচ্চা হাসতেছে, খেলতেছে। ডাক্তার বাচ্চাকে দেখে প্রেসক্রিপশন করে দিলো। ডাক্তার বললেন, আমি রিখে দিচ্ছি একটা ইঞ্জেকশনটা কিনে আনতে হবে।, কি ইঞ্জেকশন ছিল নাম জানিনা। তবে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সাথে সাথে বাচ্চাটা এত অসুস্থ হয়ে পড়লো তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটা মারা গেল।

মা কাঁদছে, বাবা কাঁদছে। তারা বলছে, যে বাচ্চা হাসতেছে, খেলতেছে সেই বাচ্চা এই সময়ের মধ্যে এমন কি হলো যে মারা গেল।” এই রকম ভুল চিকিৎসা অহরহ চরের গ্রামগুলোতে হচ্ছে। সেই ডাক্তার যখন দেখছে বাচ্চার অবস্থা খারাপ তখন সে চলে গেছে কুড়িগ্রাম। ওখানে ঐ ডাক্তারের বাসা। কিছু ডাক্তার আছে তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই।

সরকার কখনই চরাঞ্চলের জন্য বাজেট দেয় না। সরকার সেনাবাহিনীরদের জন্য ভাতা প্রদান করে, পুলিশদের ভাতা প্রদান করে কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে চরাঞ্চলের স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য কোন বরাদ্দ নাই। যে স্বাস্থ্য কর্মীটা চরে যাবে তার যাতায়াত ভাড়া লাগে তা দেওয়া হয় না। স্বাস্থ্য কর্মীরা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে চরে যেতে চায় না। ডাক্তার চরাঞ্চলে যায় না। ইউনিয়ন বা উপজেলা হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না। সরকার চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য পৃথক কোন বাজেটও দেয় না। তাই চরাঞ্চলের অসহায় জনগণ হয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত।

সোহেল: সাংবাদিক

চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যে এক্সরে মেশিন আছে সেটা এই রংপুর বিভাগে আর একটাও নাই। সব চেয়ে ভাল। কিন্তু এই মেশিনটা একদিনের জন্যও চালু হয় নাই। এই মেশিন পরিচালনার জন্য একজন ছিল ইতোমধ্যে তাকেও তুলে নেওয়া হয়েছে। চরাঞ্চলের জন্য স্বাস্থ্য সেবার কোন বাজেট নাই।

শাহনাজ বেগম, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা (FWV), চিলমারী ৫ নং ইউনিয়ন।

আমাদের বিভিন্ন চরে যেতে হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি বিতরণের জন্য। আমি প্রতিমাসে চরে স্যাটালাইট ক্লিনিক করি। চরের মানুষ আমাকেই বড় ডাক্তার ভাবে। নানা ধরণের অসুখের চিকিৎসার জন্য তারা আমার কাছে আসে। সাধারণ অসুখ, যেমন, জ¦র, গ্যাস্ট্রিক, পেটে ব্যথা, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যা, দাঁতে সমস্যা, মুখে ঘা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের সমস্যাও অনেক। পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সবচেয়ে বেশী সমস্যা অতিরিক্ত ব্লিডিং। কিন্তু আমি তাদের চিকিৎসা দিতে পারি না। আমার কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ওষুধ থাকে না।

চরে স্যাটালাইট ক্লিনিক এর জন্য ওষুধের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এতই কম ওষুধ দেওয়া হয় ১০/১২ জনকে ওষুধ দেওয়া যায়। তাও সম্পূর্ণ ডোজ দেওয়া যায় না। চরে উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন গর্ভবতী নারীদের জন্য অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ থাকতে হবে। স্যাটালাইট ক্লিনিক পরিচালনার জন্য চরে বসার কোন স্থান পাওয়া যায় না। চরের মানুষ এতই গরিব তাদের বাড়িতে একটা চেয়ার বা টেবিল নাই। কাজ করতে অসুবিধা হয়। এই কাজ পরিচালনার জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকা দরকার।

২৭ এপ্রিল ২০১৬ স্বাস্থ্য আন্দোলনের মতবিনিময় সভা চিলমারী

২৭ এপ্রিল ২০১৬ স্বাস্থ্য আন্দোলনের মতবিনিময় সভা চিলমারী


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।