স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা কি গণমূখী ?


একটি দেশের অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সাংবিধানিকভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিকে মানুষের সার্বিক সক্ষমতার জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেয়া হয়েছে। মানব উন্নয়নের সূচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকার অগ্রাধিকারের কথা বলে থাকে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি দেখা যায় দরিদ্র, প্রান্তিক জনগণ এখনো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  স্বাস্থ্যসেবার ওপর পরিচালিত একটি সামাজিক নিরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাস্থ্যখাতে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে জনবল সংকট, চিকিৎসা সেবার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং উপকরণের অভাব, অবকাঠামোর অভাব, আঞ্চলিক বৈষম্য, বাজেটে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং সর্বোপরি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব :

উন্নয়নের উপায় ও লক্ষ্য হলো মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সে কারণে সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। কেননা স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ  সেবাখাতের উন্নয়ন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, এটি জীবনের শুণগত মান ও সামাজিক প্রগতির ভিত্তি স্বরুপ,এছাড়া স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নকে দারিদ্র নিরসনের কৌশল হিসাবেও গণ্য করা হয়। সমাজের সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতে শ্রেণী-লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অভিগম্যতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। স্বাস্থ্যসহ অনান্য মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্টের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যেমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নি¤œলিখিত বিষয়সমুহ অর্জন করা যায় : (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা........সাংবিধানিক ব্যবস্থাগত ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও ঘোষণার মাধ্যেমে জনগণের  স্বাস্থ্যের অধিকারের নিশ্চিয়তা প্রদান করতে সরকার অঙ্গিকারবদ্ধ।

কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দে সবার জন্য স্বাস্থ্যের বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসাবে বলা হলেও এই খাত প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়টি আমাদের জাতীয় বাজেটে খুব একটা প্রাধান্য পায় না। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দাতাদের নির্দেশিত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব থাকায় স্বাস্থ্যের মত সেবাখাতগুলোতে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর এ খাতগুলোতে বাজেট বরাদ্দ কমছে।

স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং মৌলিক মানবাধিকার। গুরুত্বপূর্ণ এ সেবাখাতে জনগণের অভিগম্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এর জন্য প্রয়োজন বাজেট বরাদ্দের পরিমান বাড়ানো ও নিয়ন্ত্রণবিহীন বেসরকারি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই  যে পরিমাণ বাজেট থাকা দরকার সে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় না। বিগত অর্থবছরের (২০১১-১২) জাতীয় বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ যথাক্রমে ৮৮৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যা মোট বাজেটের ৫.৪% এবং মোট জিডিপির মাত্র ০.৯৮% এবং ২০১০-১১ অর্থবছরের ৮,১৪৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৬.২% এবং মোট জিডিপির মাত্র ১%। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিরাজমান নানাবিধি সমস্যা দূরীকরণের জন্য দেশের মোট জনসংখ্যার বিবেচনায় এই বাজেট খুবই অপ্রতুল। আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে একটি দেশের উন্নয়নের জন্য জিডিপির কমপক্ষে ৫% স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ থাকা দরকার হলেও আমাদের জাতীয় বাজেটে বরাদ্দে কোনো বছরই ১% এর বেশি বরাদ্দ দেয়া হয় না।

অন্যদিকে, অপ্রতুল এই বাজেট কেন্দ্রীয়ভাবে প্রণীত হয় বলে, এখানে অঞ্চলভিত্তিক অগ্রাধিকারমূলক চাহিদাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়না বলে বাজেটের সুষম বণ্টন হয়না। এছাড়া বরাদ্দকৃত বাজেটের যথাযথ ও কার্যকর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব থাকায় জনগণ যে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে যে ধরনের সেবা পাওয়ার কথা তা পায় না। দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারিভাবে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে সকল মানুষের তথ্যে অভিগম্যতা না থাকার ফলেও সাধারণ জনগণ সেবা প্রাপ্তি থেকে নিয়মিত বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির চাহিদা শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের। সরকারি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগণ যাতে তাদের প্রাপ্য সেবা পায় সেজন্য রাষ্টকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবায় রাষ্টের দায়বদ্ধতা :

স্বাস্থ্যকে মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার  বৈষম্যহীনভাবে জনগণের স্বাস্থ্য অধিকারের নিশ্চিয়তা প্রদান করতে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং ১৮(১) নং অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২৫-এ বলা হয়েছে, “মানসম্মত জীবনযাত্রার জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য ও কল্যাণের অধিকার প্রত্যেকেরেই আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সেবা এবং সুবিধালাভের অধিকার প্রত্যেকের প্রাপ্য”। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (ICESCR)  অনুচ্ছেদ ১২ অনুয়ায়ী “প্রত্যেকের সর্বোত্তম শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভোগ করার অধিকার রয়েছে।” ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার “আলমাআতা” ঘোষণায় স্বাস্থ্যসেবা জনগণের অভিগম্যতাকে একটি অধিকার হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে এবং পৃথিবীর সকল দেশ তা গ্রহণ করেছে। এছাড়া ২০০০ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণায় এ অধিকারের বিষয়টি পুন্যর্ব্যক্ত করে উন্নয়নের কেন্দ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গিকার করে।

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকারকে মৌলিক মানবধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবা অবকাঠামোকে উপজেলা ও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্মৃত করা হয়েছে। বছর বছর এ খাতে সরকারি ব্যয় বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। বিগত ২০১০-১১ অর্থবছরে দেখা যায়, স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৮,১৪৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৬.২% এবং জিডিপির ১% যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাঝারি মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য জিডিপির ৫% বরাদ্দ প্রয়োজন। ২০০০ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে আমাদের জনপ্রতি ন্যূনতম খরচ বলা হয়েছিল ১২ মার্কিন ডলার যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনপ্রতি স্বাস্থ্য বাবদ আমাদের ন্যূনতম খরচ হওয়া উচিত কমপক্ষে ৩৪ মার্কিন ডলার। স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয় তার ৬০% ব্যয় জনগণ ব্যক্তিগতভাবে খরচ করে।

দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থার জন্য পর্যায়ক্রমে ১৮০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে চালু করা হয়েছে ১০,৭২৩টি, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রসূমহ মিলিয়ে আরো ৪৫০০টির অধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং উপজেলা পর্যায়ে ৪৩২টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্র চালু রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্যসূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ কোটি মানুষের জন্য সরকারি ডাক্তার রয়েছে ১২ হাজার যেখানে পদ রয়েছে প্রায় ১৯ হাজার। ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান সব মিলিয়ে শূন্য পদের  সংখ্যা ২৬ হাজার। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ে এক লাখ মানুষের জন্য ১০ জন প্রশিক্ষিত ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সেখানে  এক জনের বেশি ডাক্তার নেই। এখনো বাংলাদেশের ৪,৭১৯ জনের জন্য এক জন ডাক্তার ও ৮,২২৬ জনের  জন্য একজন করে নার্স রয়েছে।

এখানে প্রতি বছরে মোট স্বাস্থ্যসেবা চাহিদার মাত্র ২৫-৩০% সরকারি খাত থেকে এবং ৭৫-৮০% বেসরকারি খাত হতে পূরণ হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ২১১৬টি, ডেন্টাল ক্লিনিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬৩৯টি। তালিকাভূক্তির বাইরে অনুমোদনহীন স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এর চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি।  বেসরকারি চিকিৎসাখাতের এই দ্রুত বিকাশের ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

(ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান সব মিলিয়ে শূন্য পদের সংখ্যা ২৬ হাজার। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ে এক লাখ মানুষের জন্য ১০ জন প্রশিক্ষিত ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সেখানে এক জনের বেশি ডাক্তার নেই্ এখনো বাংলাদেশের ৪,৭১৯ জনের জন্য এক জন ডাক্তার ও ৮,২২৬ জনের জন্য এক জন করে নার্স রয়েছে। তথ্যসূত্র স¦াস্থ্য অধিদপ্তর।)

স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতুল জনবল :

স্বাস্থ্য পরিসেবার জন্য প্রথমেই দরকার পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল। সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোর মধ্যে হাসপাতাল ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অন্যতম। এ কর্মসূচিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালসূমহের অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের মাধ্যেমে এসব হাসপাতালে চিকিৎসা সুযোগ নিশ্চয়তার জন্য বলা হয়েছে। ২০১১-১২ সালের বাজেট বক্তৃতায় জনগণকে অধিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে জনবল নিয়োগ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের (আইএমসি) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ১৭ হাজার ৬০৯টি নার্সের পদ শূন্য আছে। বর্তমানে দেশে ছয় জন চিকিৎসকের বিপরীতে এক জন নার্স রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এক জন চিকিৎসকের কাজে সহায়তা করার জন্য দরকার তিন জন নার্স এবং পাঁচ জন স্বাস্থ্য সহকারী (অনুপাত ১:৩:৫)। স্বাস্থ্যসেবায় জনবল সংকটের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। পত্রিকার সংবাদ মতে, উপকূলীয়, পার্বত্য ও হাওর এলাকার হাসপাতালগুলোতে জনবল শূন্যতা বেশি। আবার জেলা শহরের তুলনায় উপজেলায় জনবল সংকট আরো বেশি। জনবলের তীব্র সংকট দেখা যায় ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থকমপ্লেক্র গুলোতে।

সামাজিক নিরীক্ষার প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, নিরীক্ষার আওতাভূক্ত জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে যে জনবল আছে তা যথেষ্ঠ নয়। ৮৮.৯০% জেলা সিভিল সার্জন মনে করে, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল নেই। একদিকে পদ সংখ্যা কম এবং অন্য দিকে ছুটিতে ও প্রেষণে থাকার জন্য জনবলের আরো ঘাটতি তৈরি হয়েছে।  সেবা দেয়ার জন্য নার্সদের পদসংখ্যা যথেষ্ঠ নয়। স্বাস্থ্যখাতে এখনো ১৯৮৬ সালের জনবল কাঠামো বিদ্যামন রয়েছে। উপজেলা এবং সদর হাসপাতালে শষ্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও বাড়ানো হয়নি জনবল। বাজেটে বরাবরেই স্বাস্থ্যখাত অবহেলিত থাকে। স্বাস্থ্যখাতে যেখানে বরাদ্দকৃত বাজেটের সিংহভাগই চলে যায় বেতন-ভাতা খাতে যেখানে জনবল কাঠামোর চিত্র স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের অবহেলাকেই নির্দেশ করে।

আবসান ব্যবস্থার বর্তমান চালচিত্র :

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা সদর হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের আবসনের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।

তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি সহজলভ্য এবং অল্প খরচের মাধ্যম হলো ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক। এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসান ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করে তৃণমূল মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।  ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেগুলোতে আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো বসবাসের উপযোগি নয় বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ সহকারীরা।

অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ :

দেশে চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিক্সদের চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যেমে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপযোগি একটি দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী গড়ে তোলা দরকার। সরকারের কর্মপরিকল্পনায় উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যেমে কমিউনিটিভিত্তিক প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ধাত্রীর সংখ্যা ২০১৪ সালের মধ্যে বর্তমানে ৬০২৯ জন থেকে ৯০২৯ জনে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় নিয়োজিত সরকারি/বেসরকারি সকল  স্তরের চিকিৎসক, নার্স,প্যারামেডিক্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিয়মিত পেশাগত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, কোর্স ও কনটিনিউয়িং মেডিকেল এডুকেশন প্রদানের কথা জাতীয় খসড়া স্বাস্থ্যনীতিতে উল্লেখ করা হলেও বাস্তব পরিস্থিতে দেখা যায় নার্সদের দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের তেমন কোনো সুযোগ নেই। অথচ গুণগত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা খুবই জরুরি।

অবকাঠামো উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অপ্রতুলতা :

জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকা জরুরি। সকল স্তরের হাসপাতালগুলোতে রয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণের সংকট। সরকার উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে ৩০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে ১৪২টি উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে ৫০ শয্যায় এবং ৯টি হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর শয্যা বাড়ানো হলেও বাড়ানো হয়নি পর্যাপ্ত উপকরণ, আধুনিক সরঞ্জাম ও জনবল।  উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত উপকরণ ও জনবল নেই। এর ফলে দেখা যায় সেবা নিতে আসা রোগীরা নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে তৃণমূল পর্যায়ের দারিদ্র জনগণকে জেলা হাসপাতালে বা বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়।

সরকারের উন্নয়ন বাজেটে হাসপাতালগুলোতে যথাযথ অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের জন্য অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ  থাকলেও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলোও ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাৎসরিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য দরকার সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। এর জন্য জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যাপ্ত ডায়াগনসিসের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।কিন্তু জেলা হাসপাতাল গুলোতে  ডায়াগনসিসের জন্য সামান্য উপকরণ থ্াকলেও ডায়াগনসিসের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ উপজেলা  হাসপাতালে নেই।

তৃণমূল পর্যায়ে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির সহজলভ্য স্থান হচ্ছে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এই  হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপযুক্ত সেবা প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক এ্যাম্বুলেন্স, জরুরি রোগী ও প্রতিবন্ধী রোগীদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এগুলো সঠিকভাবে থাকে না। হাসপাতালের অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ কেনার ক্ষেত্রে কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। যেমন : ডিজি অফিস থেকে অনেক যন্ত্রপাতির দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় যা বাজেটের সাথে সামঞ্জস্য নয়। যার ফলে অনেক যন্ত্রপাতি কেনা যায় না। আবার কিছু কিছু যন্ত্রপাতির চাহিদা না থকলেও হাসপাতালের জন্য পাঠানো হয়।

চিকিৎসা সেবার মান ও ফি :

সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০১০-২০২১) সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষ চায় সরকারি হাসপাতাল থেকে স্বল্প খরচে চিকিৎসা সেবা পেতে। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসার গুণগত মান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাসপাতালের আন্ত:বভাগের রোগীরা বলেছেন, তারা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা হাসপাতাল থেকে পান না , তার কারণ হলো  হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাব এবং সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষার ও নিরীক্ষর মান ভালো না। এতে করে সেবা গ্রহণকারীরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সেবা গ্রহণকারীরা তাদের যথাযথ সেবা পাবার ব্যাপারে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রত্যাশা করে থাকেন। বাস্তব ক্ষেত্রে রোগীরা ডাক্তারদের সেবা বিষয়ে সন্তুষ্ট নয়। বহি: বিভাগের রোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী,  রোগী বলেছেন চিকিৎসার সময় ডাক্তাররা ঠিকমতো কথা শুনেন না এবং রোগী হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পায় না। প্রতিটি জেলা সরকারি হাসপাতালে বহি:বিভাগ এবং আন্ত:বিভাগের রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি নির্দিষ্ট হারে ফি চার্জ করে থাকে। বহি:বিভাগ এবং আন্ত:বিভাগের সকল রোগী হাসপাতাল থেকে সেবা পাওয়ার জন্য নির্ধারিত ফি দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দালালদের চক্রে পড়ে রোগীরা নির্ধারিত ফি’র সাথে অতিরিক্ত অনেক ফি প্রদান করেছেন। সাধারণত জ্বর, পেটের পীড়া, শ্বাস তন্ত্রের রোগী, সার্জিকাল, গাইনী/প্রসূতি রোগীরা বহি:বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। বহি:বিভাগে ডাক্তার নিয়মিত দায়িত্ব পালন করলেও জরুরি বিভাগে ডাক্তার নিয়োগ অপ্রতুল থাকায় রোগীরা যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের আন্ত:বিভাগে ভর্তির পর ওয়ার্ডে থাকাকালীন সেবা প্রদানকারী ডাক্তার ও নার্সদের সেবা প্রদান ও হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু প্রকারের ঔষধ বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও নিরীক্ষার প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, তাদেরকে আলাদা টাকা বা ফি প্রদান করতে হয়েছে এবং বেশির ভাগ ঔষধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।

জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তির পর রোগীদের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা,ঔষধপত্র কেনা এবং অস্ত্রোপাচারের ক্ষেত্রে দালালদের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত ফি প্রদান করতে হয়। এছাড়া ওয়ার্ডবয়, আয়াদের সেবার জন্য অতিরিক্ত ফি বাধ্য হয়ে দিতে হয়। এতে করে রোগীদের ভোগান্তি অনেকাংশ বেড়ে যায়।  আন্ত:বিভাগের রোগীরা দালালদের খপ্পরে পড়ে টাকা দিতে হয়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ না থাকায় জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসাসেবা না পেয়ে উন্নততর চিকিৎসার জন্য সরকারি মেডিকেল কালেজ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর শরনাপন্ন হয়। সরকারি জেলা হাসপাতালে প্যাথলজি ও এক্সরে করার ক্ষেত্রে রোগী সাধারণকে ফি প্রদান করতে হয়। তবে উল্লেখিত বিভাগে ডাক্তার ও এক্সপার্ট না থাকায় গুণগত মান প্রশ্নসাপেক্ষ।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হলো, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের সর্বনি¤œ স্তর এবং তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজলভ্য স্থান। তাই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহের দক্ষতা বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত পরিমান সেবা প্রদানের জন্য যথাযথ পরিমাণ লোকবল এবং সারঞ্জামাদি থাকা দরকার। এজন্য সরকারের যথাযথ বাজেট বরাদ্দও থাকা প্রয়োজন।

ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক উপকরণ ও জনবলের অভাব আছে। এছাড়া ডাক্তারদের ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে।  মা ও শিশুর জন্য যে সেবা প্রদান করা হচ্ছে তা স্থানীয় রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী অপার্যাপ্ত থেকে যায়। তারপরো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকরা বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যর বিনামূল্যে সেবা প্রদান করা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, এক জন মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট, এক জন ফার্মাসিস্ট ও এক জন এমএলএসের পদ রয়েছে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পদ থাকলেও ডাক্তাররা গ্রামাঞ্চলে বাস করছেন না। মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট দিয়েই চলছে চিকিৎসা সেবা।

হাসপাতালে সরবরাহকৃত ঔষধ ও খাবার :

স্বাস্থ্যসেবার জন্য জরুরি ঔষধ সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ একটি উপদান। সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী এতিটি হাসপাতালে বহি:বিভাগ ও আন্ত:বিভাগে ঔষধের তালিকা থাকা বাধ্যতামূলক। সরকার থেকে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর জন্য বিভিন্ন রোগের অত্যাবশ্যকীয় ঔষধ সরবরাহ করে থাকে। সিটিজেন চার্টার অনুসারে প্রতিটি হাসপাতালে ঔষধের তালিকা রয়েছে এবং তা টানিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক। বাৎসরিক বরাদ্দ অনুসারে জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা সদর হাসপাতাল এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ঔষধ সরবারহ করা হয়।

তথ্যমতে,জেলা হাসপাতালের  বহি:বিভাগের রোগী বলেছেন, চিকিৎসার জন্য তারা সব ঔষধ হাসপাতাল থেকে পান না। এ জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাজেট ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। অনুসন্ধান দেখা যায়, আন্ত:বিভাগের রোগীরাও বলেছেন যে, তারা ওয়ার্ডে থাকাকালীন সময় বেশিরভাগ ঔষধ তারা বাহির থেকে কিনছেন। হাসপাতালগুলোতে ঔষয়ধের সঠিক ব্যবহার না হওয়া, যোগান কম থাকা, ঔষধ পাচার ও ডাক্তারদের সাথে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটিভদের দৌরাত্ব ইত্যাদিকে কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ করেন। রোগীরা আরো উল্লেখ করেন, অনেক সময় ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনে বা ব্যবস্থ্যাপত্রে হাসপাতালে যে ঔষধগুলো থাকে সেগুলো না লিখে অন্য কোম্পানীর ঔষধ লেখে। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটিভরা (এমআর ) ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর তাদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে দেখে তাদের কোম্পানীর ঔষধ ব্যবস্থাপত্রে লেখা হয়েছে কি না? রোগীরা বলেন, এ পরিস্থিতিতে তাদের বাধ্য হয়ে বাড়তি ঔষধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

থানা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও ঔষধের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নেই। থানা পর্যায়ে বছরে যে টাকা ঔষধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আবার দেখা যায়, হাসপাতালগুলোতে একদিকে যেমন ঔষধের সংকট অন্যদিকে কিছু ঔষধ কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যেগুলোর চাহিদা হাসপাতালে নেই। ফলে দেখা যায় ঔষধগুলো ফেরত দিতে হয়।  তথ্যানুযায়ী, থানা হাসপাতালগুলোতে ছোট খাটো অপারেশন করা হলেও রোগীদের গজ ব্যান্ডেজসহ সব ধরনের ঔষধ বাহিরে থেকে কিনতে হয়।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বেশি বঞ্চিত। অথচ তৃণমূল পর্যায়েই স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধাগুলো বেশি থাকা দরকার। কারণ তারা আর্থিক এভং অন্যান্য প্রতিকূলতার কারণে শহরে এসে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে না। তাই এ পর্যায়ের সকলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দে তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত।

ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ানদের দক্ষতা ও সেবা :

জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে গুণগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির জন্য দক্ষ ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান এর গুরুত্ব অপরিসীম। জেলা হাসপাতালগুলোতে হাসপাতালের নির্দিষ্ট সময় পর পর ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের পরিভ্রমন করার জন্য সঠিক নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা ঠিকমত ওয়ার্ডগুলো পরিদর্শন করে না।  আন্ত:বিভাগের রোগী বলেছেন হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডাক্তার ও নার্সরা নিয়মিত আসেন না এবং রাতে অবস্থান করেন না।

স্বাস্থ্য বাজেট হতে হবে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে:

স্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম একটি মানবাধিকার। মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের সাথে অতি গভীর ভাবে স¤পৃক্ত। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক স্বাক্ষরিত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তি, আলমাআতা ঘোষণা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ঘোষণা সহ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বাস্থ্য অধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংবিধানেও স্বাস্থ্যকে অতিগুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃতি এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে।

সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্র“তি স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকার প্রদান করলেও সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিকরণে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এখন পর্যন্ত অনুকূল নয়। এরপরেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যা ইতিবাচক । বিশেষ করে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ প্রণয়ন, ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২৮২৪ টি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ গ্রহণ, ইন্টার্নীর চিকিৎসককে কমপক্ষে এক বছর তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, চাহিদাভিত্তিক চিকিৎসক এবং নার্স নিয়োগে পদক্ষেপ, বিশেষ করে শিশু এবং মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নে পদক্ষেপ প্রভৃতি ইতিবাচক। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ ২০১০ সালে জাতিসংঘের এমডিজি-৪ পুরস্কার লাভ করে। এরপরেও জনবল সংকট, স্বাস্থ্যসেবার মান নিুমূখি, প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং যন্ত্রপাতির অভাব, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের শহরমূখিতা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যসেবার বেসরকারিকরণ প্রবনতা স্বাস্থ্যসেবাকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, তৃণমূল দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিকার থেকে।

সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  হচ্ছে তৃণমূল চাহিদাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ। অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়ণের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে চাহিদা এবং স্বাস্থ্যচিত্র তুলে আনা সম্ভব। অথচ বাংলাদেশের কেন্দ্রিভূত বাজেট প্রক্রিয়ায় সত্যিকার অর্থে জন চাহিদা তুলে আনা হয় না। অধিকন্তু প্রতিবছর বাজেটে  স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দের হ্রাসকরণ এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের জায়গায় স্বাস্থ্যকে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে পণ্যে পরিণত হরা হচ্ছে। বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০১০-১১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬.২% যেখানে ২০১১-১২ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয় ৮ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫.৪ % । চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা যা গতবারের তুলনায় ৪৬৪ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু শতাংশ হারে গতবারের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ০.৫ শতাংশ হ্রাস করে করা হয়েছে ৪.৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ি, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের জন্য যেখানে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন কমপক্ষে জিডিপির কমপক্ষে ৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। অধিকন্তু প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ হ্রাসকরণ সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিদ্যমান এই ঝুঁকি মোকাবিলার সাথে সাথে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে তৃণমূল অংশগ্রহণের মাধ্যমে চাহিদা ভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের কোন বিকল্প নেই।

সরকার যেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে তৃণমূলে পাঠানোর প্রতিশ্র“তি প্রদান করেছেন, ইতিমধ্যে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তারকে তৃণমূলে স্বাস্থ্য সেবা প্রদােেনর জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাগিদ দিয়েছেন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক অধিকতর আধুনিকীকরণের জন্য ঘোষণা দিচ্ছেন, সেই সময়ে স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ৪.৯% বরাদ্দ হতাশাজনক।

চিকিৎসা সুবিধা, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, জনবল নিয়োগসহ স্বাস্থ্য খাতে বেশ উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তবে পুষ্টির ক্ষেত্রে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তৃণমূলে গিয়ে চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দিতে আগ্রহী হচ্ছে না, নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল, চরাঞ্চল-হাওর-বাওর এলাকায় ডাক্তার-নার্সের দেখা না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে এবং দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই স্বাস্থ্যখাতে ন্যূনতম ১০% বরাদ্দ প্রয়োজন।

উপসংহার :

সকলের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন কর্মসূচির কথা ঊল্লেখ করা হয় বিভিন্ন  বাজেট বক্তৃতায়। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা যা ২০১১-১২ অর্থবছরের তুলনায় ৪৬৪ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু শতাংশ হারে ২০১১-১২ অর্থবছরের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ০.৫ শতাংশ হ্রাস করে করা হয়েছে ৪.৯ শতাংশ। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫.৪% ্এবং মোট জিডিপির মাত্র ০.৯৮% যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাঝারি মানের স্বাস্থ্য সেবার জন্য জিডিবির ৫% বরাদ্দ থাকা দরকার। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬.২% কিন্তু  এবার দেয়া হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪% বরাদ্দ যেখানে শুধুমাত্র প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্যই প্রতিবছর ৯% বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী ঘোষিত বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্যসেবায় ইতিবাচক কর্মসূচী হিসেবে চলতি বাজেটে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ৯৭ টি মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র, ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩ হাজার ৯০০ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্র এবং ৩০ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে মা, শিশু ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবার পরিধি সম্প্রসারন করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া টেলি মেডিসিন , ভিডিও কনফারেন্সিং এবং ই-মেইলের মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহন, দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এলাকা যেমন চরাঞ্চল অথবা দ্বীপ এলাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোবাইল মেডিকেল টিম সম্প্রসারন , বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি জোরদারকরণ ইউজার ফি আহরণ নীতিমালা জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি , জাতীয় জনসংখ্যানীতি আগামী অর্থবছরের মধ্যে চূড়ান্ত করার কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ঘোষনায় চিকিৎসক ,নার্স ও স্বাস্থসেবা কর্মীর অনুপাত ১:৩:৫এ উন্নীত করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন কিন্তু এ অনুপাতে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে এ বছর কতজন ডাক্তার , নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশনা বাজেট বক্তৃতায় নেই। বাজেট ঁবক্তৃতায় নার্স /প্যারামেডিক্সের সংখ্যা ও দক্ষতা,বুদ্ধি,নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করার কথা উল্লেখ করা হয় যা ইতিবাচক।

খাত

অর্থবছর

খাতওয়ারি বরাদ্দ

(অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন বাজেট)

ভর্তূকি.পেনসনওসুদসহ)

কোটিটাকায়

মোট বরাদ্দের শতকরাহার (ভর্তূকি,পেনসন ওসুদসহ)

 

স্বাস্থ্য

২০১১-১২

(প্রস্তাবিত)৮,৮৮৬

৫.৪%

 

২০১০-১১

(সংশোধিত)৭,৬৩৪

৫.৮%

 

২০১০-১১

(প্রস্তাবিত)৮১৪৭

৬.২%

স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি আশাব্যঞ্জক হলেও এ খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া অতিদরিদ্র রোগীদের জন্য হেল্থ কার্ড চালু করা গণমানুষের যে দাবি ছিল সেটি বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।

দরিদ্র ও অবহেলিত অঞ্চলের জনগণের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণে স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, ইউনিয়ন ,উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সকল হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয়  ব্যবস্থা গ্রহণের  এবং  কার্যকর তদারকির মাধ্যমে এ খাতের বরাদ্দকৃত  অর্থের সঠিক ও সুষ্ঠ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা রাষ্টকে করতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিকিৎসা সহ জীবন ধারণের মৌ লিক  উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিগত সরকারগুলোর কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্যখাতের বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

 উন্নয়স ও সখ্যমতার জন্যে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সহ সকল উপজেলায় ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ, রোগীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা, ঔষধও শয্যার অতিরিক্ত রোগীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা, ঔষধের মান নিয়ন্ত্রন ও মূল্য নির্ধারণে সরকারের কার্যকর ভূমিকা,কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সচল করা ,উপজেলাগুলোতে ডাক্তার ও নার্সের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং জলবায়ুগত পরিবর্তনে স্বাস্থের সুরক্ষার জন্য  প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। একইভাবে , তৃণমূল পর্যায় থেকেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সেবার মান ঊন্নয়নের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপেক্সগুলো অধিকতর কার্যকর করা, হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ঔষধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা, প্রাইভেট

ক্লিনিকগুলোর উপর উচ্চহারে কর ধার্য  

অর্থবছর

মোট বাজেট

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ

%  

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ

উন্নয়ন অনুন্নয়ন  মোট

 

২০০৮-০৯

৯৯৯৬২

৫৮৬২

৫.৯%

৩৪২৩

২৪৩৯

৫৮৬২

২০০৭-০৮(সংশোধিত)

৮৬০৮৫

৫২৬১

৬.১%

২৮৯৮

২৩৬৩

৫২৬১

২০০৭-০৮

৭৯৬১৪

৫৪৭০

৬.৮%

২৬০৬

২৮৬৪

৫৪৭০

২০০৬-০৭

৬৯৭৩৬

৪৭৮৪

৬.৮%

২৩৭৫

২৪০৯

৪৭৮৪

২০০৬-০৬(সংশোধিত

৬৬৮৩৬

৪৯৫৭

৭.৪%

২২৭৫

২৬৮২

৪৯৫৭

২০০৫-০৬

৬৪৩৮৩

৪২৪০

৬.৫%

২১৭৭

২০৬৩

৪২৪০

২০০৫-০৬(সংশোধিত

৬১০৫৮

৪১১২

৬.৭%

২০৪৭

২০৬৫

৪১১২

করা, প্রাথমিক ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি সহ জনগনের জীবন মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন

ব্যবস্থা গ্রহন করা । একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন অনুযায়ী সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব , অন্যদিকে দারিদ্য ও স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতার ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন- বিশুদ্ধ পানি ও পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা,নিরাপদ ও পর্যাপ্ত খাদ্য টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলো  কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবছর প্রস্তাবিত বাজেট ধারাবাহিক, গতানুগতিক এবং স্বাস্থ্যখাতে নতুন কোন বিষয় সংযোজিত হয়না। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমেছে। দাতাদের  প্রভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেসরকারি করণের ফলে জন্স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের ৩৪২ টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ১৩০ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দিলে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চিকিৎসা সেবা বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে ।

 মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবার জন্য দেশে ৬০ হাজার চিকিৎসক, ২লাখ ৮০ হাজার নার্স   এবং চার লাখ ৮৩ হাজার টেকনোলজিস্টের অভাব রয়েছে। সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে ৫৫০ টি মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর পদ খালি রয়েছে। এই ব্যাপারে আগামি বাজেটে সরকারের সঠিক দিক নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি।

আগামী ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ সহ অনেক দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংক্রামক ব্যাধি সহ অন্যান্য  রোগব্যাধির শিকার হবে বিশ্বের অগণিত মানুষ। তাছাড়া মরণব্যাধি এইডস সহ অন্যান্য মারাত্মক রোগ মোকাবেলায় সরকার বাজেটে এই সম্পর্কিত কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনে সম্ভাব্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত মোকাবেলার জন্য বরাদ্দকৃত ৩০০ কোটি টাকা কিভাবে ব্যয়িত হবে তার সঠিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।

জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এখানে উল্লেখ্য যে স্বাস্থ্যখাতে মোট বাজেটের ৫০% এর বেশি অর্থ ব্যয় হয় কর্মচারিদের বেতন, ভাতা ও প্রশাসনিক খাতে । পি আর এস পি ও এম ডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে  হলে সরকারের জাতীয় বাজেটের ১০-১২% বরাদ্দ স্বাস্থ্যখাতে দিতে হবে । এ সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে জনগনের অংশীদারিত্ব ও সরকারের সঠিক কর্ম পরিকল্পনা , বাস্তবায়ন , পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরী।

তথ্য সূত্র:

১.সামাজিক নিরীক্ষার প্রতিবেদন সূপ্র

২.জাতীয় বাজেট ২০১০-২০১১,২০১১-২০১২,২০১২-২০১৩

৩.দৈনিক প্রথম আলো,২ফেব্রুয়ারী-২০১২

৪.পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকার।

৫.বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ ।

৬. স্বাস্থ্য সেবায় সমাজিক সমীক্ষা রিপোর্ট ,সাতক্ষীরা অঞ্চল আগষ্ট-২০১৩

সদস্য সচিব- উন্নয়ন ধারা ট্রাস্ট


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।