শহর বাড়ছে, সেবার পরিধি হচ্ছে শঙ্কুচি (বিক্ষিপ্ত ভাবনা)


প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) ৯ মে, ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এর সাথে ৮টি করে মোট ১৬টি গ্রামীণ ইউনিয়ন যুক্ত হবে, যার ফলে এই দুটি মহানগরের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা মহানগরীর নিকটবর্তী ১৬টি ইউনিয়ন দুটি সিটি কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত হতে প্রায় ২৮ বছর সময় লেগেছে কারণ একটি মামলার কারণে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব ছিল না।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত হবে বেরাইদ, বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান এবং ডুমনি (খিলক্ষেত) ইউনিয়ন সমূহ। একইসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাথে যে সকল ইউনিয়ন যুক্ত হবে তারা হচ্ছে, শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুআইল, সারুলিয়া, ডেমরা, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও এবং নাসিরাবাদ ইউনিয়ন। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ৮২.৬৩৮ বর্গ কিলোমিটার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হবে প্রায় ১৬০.৭৬৮ বর্গ কিলোমিটার এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান আয়তন ৪৫ বর্গকিলোমিটার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১০৯ বর্গ কিলোমিটার। দুটি সিটি কর্পোরেশনে আগে ছিল মোট ৯৩টি ওয়ার্ড যা এখন হবে ১২১টি ওয়ার্ড। বিশাল এক শহর হতে চলেছে বৃহত্তর ঢাকা মহানগরী।

২০১১ সালে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ হয়ে দুটি সিটি কর্পারেশনে রূপ লাভ করে। মোট ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর এবং ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা করা হয়। তখন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ভাবনায় ঢাকা মহানগরকে দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়। পৃথিবীর কোন রাজধানী শহর এমনভাবে বিভাজিত হয়েছে কি না জানা নেই।

এবারও সম্প্রসারিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত হতে চলেছে ঢাকা-নারায়নগঞ্জ- ডেমরা (ডিএনডি) ৪০ ভাগ এলাকা। নিতান্ত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুআইলসহ আশে পাশের এলাকায় নাগরিক সুবিধা দিতে এবং জায়গা জমির ভেজাল মীমাংসা করে হোল্ডিং ট্যাক্স বসাতে হিমসীম খেতে হবে মেয়র মহোদয়কে। এ সকল এলাকায় বিশেষত ডেমরা-সারুলিয়া ডি এন ডি বাঁধ এলাকায় জলাধার-খাল বিল দখল করে যেভাবে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে এবং পানি নিষ্কাশন প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। একইভাবে উত্তরে সিটি কর্পোরেশনের অধীনে সংযুক্ত হওয়া ভাটারা, বেরাইদ, ডুমনি এলাকার সড়ক নেই বললেই চলে এবং পয়ঃনিষ্কাসন অত্যন্ত নাজুক। অনেকস্থানে আবাসন কোম্পানিসমুহ খাল বিল ভরাট করে ফেলেছে বাঁধহীনভাবে। ডিটেইড এরিয়া প্লানে কোন কোন স্থানে খাল দেখানো হয়েছে ১৩০ ফুট, অথচ আছে ১৫ ফুট। এছাড়া এ সকল এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র সঙ্কট পরিলক্ষিত হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে উদ্যোগী উত্তরের মেয়র মহোদয়কে শুলশান এলাকা ছেড়ে বাড্ডা, সাতাঁরকুল, ডুমনি, হরিরামপুরে মনোযোগ ও বিনিয়োগ করতে হবে অনেক বেশী।

যখন রংপুর এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা করা হয়, তখনও দেখা যায় বেশ কিছু গ্রামকে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আনা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ শহরে অভিবাসন করেনি, শহর গিয়ে হাজির হয়েছে তাদের দুয়ারে। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো ফরিদপুর সিটি কর্পোরেশন এবং ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন ঘোষিত হবে। এই দুটি শহরের আসে পাশে অবস্থিত বেশ কিছু গ্রাম আছে তারাও শহর বলে চিহ্নিত হতে পারে। শহরমুখী অভিবাসন নয়, এ হচ্ছে শহরের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে গ্রাম দখল। বিচিত্র এবং অভিনব এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা।

বর্তমানে বাংলাদেশে শহরের জনসংখ্যার সংখ্যা প্রায় ২৮ শতাংশ শহরে বসবাস করে, যা ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। ১৯৮১ সালেও এই ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা ছিলো ৩৫ লক্ষ মাত্র। জনমিতিবিশারদের হিসাব হচ্ছে ২০৩৯ সালের মধ্যে শহর এবং গ্রামের জনসংখ্যার অনুপাত হবে ৫০ঃ৫০ অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্ধেক লোকজন শহরে বসবাস করবে। এছাড়াও ২০৫০ সালে প্রায় ৭০ শতাংশ লোকজন শহরের বসবাস করবে। তারা শহরে হয়তো আসবে না, তাদের গ্রামটি শহর হয়ে যাবে। ১৯৮১ সালেও দেখেছি পৌরসভার সংখ্যা ছিলো মাত্র ৮০টি এখন হয়েছে ৩২৬ টি এবং সিটি করর্পোরেশনের সংখ্যা বর্তমানে ১১ টি হলেও হয়তো কিছুদিনের মধ্যে হবে ১৩ টি এবং ভবিষ্যতে হবে আরও অনেক। এছাড়া কর্ণফুলিকে উপজেলা ঘোষণার মধ্য দিয়ে উপজেলার সংখ্যা দাঁড়াল ৪৯০টি। প্রত্যেক উপজেলা কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে শহরে পরিণত হচ্ছে।

বড় প্রশ্ন হচ্ছে শহর ঘোষিত হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত আছে নাগরিক সুযোগ সুবিধা প্রদানের প্রশ্ন। পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ প্রদান সহ পরিকল্পিত একটি আবাসিক নিবাসের ভাবনা। প্রতিটি পৌরসভা এবং সিটি করর্পোরেশন হচ্ছে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান যারা তাদের বাজেট প্রণয়ন এবং ব্যয় নির্ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু তাদের আয়ের উৎস কি এবং কাজের পরিধি কি?

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিল অনুসারে ২৮টি শিরোনামে ১২৫টি কার্যাবলীর সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে সিটি কর্পোরেশনকে। এসবের মধ্যে আছে জনস্বাস্থ্য, আবর্জনা অপসারণ, কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, জন্মমৃত্যু এবং বিবাহ রেজিষ্ট্রিকরণ, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন, কসাইখানা ব্যবস্থাপনা, ইমারত নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা বিধান, প্রমোদ উদ্যান সংরক্ষণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধন ইত্যাদি। এক কথায় সবুজ ও পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ নগরী জনগণকে উপহার দেয়া।

এতোসব কাজ বা দায়িত্ব পালনে তাদের আয়ের উৎস কি? সিটি কর্পোরেশন আইনের চতুর্থ তফসিলে আয়ের উৎস সর্ম্পকে বলা আছে। তাতে উল্লেখ আছে ইমারত ও জমির বার্ষিক মূল্যের উপর কর সহ (হোল্ডিং ট্যাক্স) ২৬ প্রকারের কর আদায়ের ক্ষমতা। উপকর, রেইট, টোল ও ফিস ইত্যাদি কর্পোরেশনের আয়ের উৎস হতে পারে। কিন্তু জনগণ শহরে বাস করবে কিন্তু কর দিতে রাজি নয়। যাদের গ্রাম এখন শহর হয়েছে তারা কর দেয়ার কথা ভাবে না। কারণ গ্রামে চৌকিদারী ট্যাক্স ছাড়া অন্য কিছু কোন কর দেওয়ার কথা তাদের মনের মধ্যে নেই। এছাড়া শহরে আছে বস্তিবাসী, তারাও কর দেয় না কারণ তাদের হোল্ডিং নাম্বার নেই। নগর কর্তৃপক্ষ মনে করে তারা হচ্ছে অননুমোদিত আবাসস্থল, যে কোন সময় তাদেরকে উৎখাত করা যেতে পারে। অথচ ঢাকা শহরে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৩৩ শতাংশ, যারা ট্যাক্স দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না।

এমন সামাজিক ও আর্থিক পরিস্থিতি সামনে রেখে বাংলাদেশের ছোট বড় নগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৌরসভা সমূহ, এ বি সি যেই ক্যাটাগরীর হোক না কেন নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই কারোই। কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে থোক বরাদ্দের জন্যে স্থানীয় সরকার বিভাগে ধর্ণা দেয় মেয়র মহোদয়গণ বা তাদের নির্বাহী কর্মকর্তাগণ প্রতিনিয়ত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন তাদের বাজেটের ৬০ শতাংশ নিজেদের আয়ের উৎস থেকে ব্যয় বহন করতে পারে মাত্র, অবিশিষ্টের জন্যে হাত পাতে কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে। তাই দেখা যায় সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব স্বাস্থ্য সেবা নেই বললেই চলে, মশার ওষুধ ক্রয়ের ক্ষমতা থাকে না।

সবার উপর হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গিকার এবং সদিচ্ছা। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে ২০১৩ সালে যে সকল মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই এখন কারাগারে। অনেকক্ষেত্রে বিষয়টির সাথে সুশাসনের অভাব দৃশ্যমান হচ্ছে, আবার অনেক সময় রাজনীতি তাদেরকে বিপদগ্রস্থ করেছে। তবে সুশাসনের অভাব হচ্ছে ব্যাপক এবং প্রায় সর্বত্র। সুশাসনের পরিধি কতটা ব্যপক তার কিছুটা উদাহরণ আছে জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এর “শান্তির স্বপ্নে” গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন “ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুর্নীতির তালিকা এই বইয়ের ক্ষুদ্র পরিসরে শেষ করা সম্ভব নয়। সিটি কর্পোরেশনের দুই হাজার ক্লিনার আছে, যারা বেতন পায় কিন্তু কোন কাজ করে না।” “উৎকোচ নিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাকে প্রথম শ্রেণীর প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে আটাশিজন টাইপিষ্ট টাইপ করা না জেনেও সহকারী হিসেবে চাকরি পেয়েছেন।” এ হচ্ছে অপশাসনের সামান্য উদাহরণ।

আয়ের উৎস না থাকলে সেবার পরিধি বাড়বে কেমন করে? কেন্দ্রিয় সরকারের অনুদানের উপর নির্ভর একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা তার সীলমোহর দিয়ে আইনি অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করবে? এমন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে শহর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে।

এ সবের মাঝেও আমাদের ধারণা আরবান লোকাল বডি হিসাবে নগরের প্রসার কেউ বন্ধ করতে পারবে না। নগর হচ্ছে প্রগতির ইঞ্জিন এবং সভ্যতার সুতিকাগার। নগর হলো নিত্য নতুন চিন্তার মহাসড়কের সংযোগ, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মকান্ডের অধিক্ষেত্র। নগর প্রশাসনে উৎকর্ষ সাধিত হবে, নগরভিত্তিক জীবনযাত্রার সম্প্রসারণ ঘটবে, নগর পিতাদের সন্মান ও ক্ষমতার পরিধি বাড়বে, এ সবই হচ্ছে দেশবাসীর প্রত্যাশা। যাদের গ্রাম শহর হয়েছে, মেয়র মহোদয়গণকে ভাবতে হবে কিভাবে গ্রামের মানুষের ভাবনার সাথে নাগরিক আচরণকে সমন্বয় করা যায়।

ধীরাজ কুমার নাথ, সাবেক সচিব

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।