জাতীয় বাজেট - স্বাস্থ্য সেবাখাত: বাজেটের আকার বাড়ে তবে স্বাস্থ্য খাতে কমে


স্বাস্থ্য অন্যতম মানবাধিকার এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মানব উন্নয়ন সূচক। স্বাস্থ্যের উন্নয়ন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, মানুষের জীবনের গুণগত মান ও সামাজিক প্রগতির ভিত্তিস্বরূপ একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য সেবার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সাংবিধানিকভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টিকে মানুষের সার্বিক সক্ষমতার জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেয়া হয়েছে। মানব উন্নয়নের সূচক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ এখাতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকার অগ্রাধিকারের কথা বলে থাকে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে দেখা যায় দরিদ্র, প্রান্তিক জনগণ এখনো স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। ধনী গরিব সকলের জন্য মান সম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সেবায় রয়েছে জনবল সংকট ও এর বিন্যাসে আঞ্চলিক বৈষম্য, সেই সাথে রয়েছে অবকাঠামো আধুনিক যন্ত্রপাতি, জবাবদিহিতা ও ব্যবস্থাপনার সংকট। বাংলাদেশে যা স্বাস্থ্য সেবায় সরকারি বরাদ্দ ঘাটতি, স্বাস্থ্য সেবা প্রান্তিতে গ্রাম, শহর, ধনী দরিদ্র অসম-সুযোগ ও বঞ্চনা জনগণের জীবন মান উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। 

স্বাস্থ্য সেবায় রাষ্ট্রের, সাংবিধানিক দায়িত্ব: উন্নয়নের উপায় ও লক্ষ্য হলো মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সে কারণে সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। কেন না স্বাস্থ্য সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতের উন্নয়ন, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, এটি জীবনের গুণগতমান ও সামাজিক প্রগতির ভিক্তি স্বরূপ। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নকে দারিদ্র নিরসের কৌশল হিসাবেও গণ্য করা হয়। সমাজের সক্ষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতে শ্রেণী লিঙ্গ বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির নাম বৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবন যাত্রার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন যাহাতে নাগরিকদের জন্য নি¤œলিখিত বিষয় সমূহ অর্জন করা যায় (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা” সংবিধানিক ব্যবস্থাগত ছাড়াও বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক চুক্তি ও ঘোষণার মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যের অধিকারের নিশ্চিয়তা প্রদান করতে সরকার অঙ্গিকার বদ্ধ।

কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দে সবার জন্য স্বাস্থ্যের বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসাবে বলা হলেও এখাতে প্রধান, সমস্যাগুলো সমাধনের বিষয়টি আমাদের জাতীয় বাজেটে খুব একটা প্রধান্য পায় না। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দাতাদের নির্দেশিত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব থাকায় স্বাস্থ্যের মত সেবা খাতগুলোতে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ায় নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কমছে।

জাতীয় বাজেটে অবহেলিত স্বাস্থ্য খাত

স্বল্প বাজেট নিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অবদান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য উৎসাহ ব্যাঞ্জক। তবে সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যবস্থাকৃত বাজেটের পরিমাণ বাড়ানো এখন সময়ের দাবী। স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ টাকার অংকে বাড়লেও মোট বাজেটের জিডিপি’র অনুপাতে সেই পরিমাণ নিতান্তই হতাসাব্যাঞ্জক।

স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মোট বাজেটের ও জিডিপির শত করা হার।

বিগত কয়েক বছর ধরেই বাজেটের আকারের বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমশ কমে আসছে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় (মোট বাজেট ও জিডিপির শতকরা হার।

  ২০০-১০ ২০১০-১১ ২০১১-১২ ২০১২-১৩ ২০১৩-১৪ ২০১৪-১৫ ২০১৫-১৬
বাজেটের % হার ৬.২ ৫.৭ ৫.৪ ৫.৩ ৫.৪ ৪.৫ ৪.১৩
জিডিপির % হার ০.৯ ০.৯ ০.৯ ০.৯ ০.৯ ০.৮ ০.৭১

২০০৯ -১০ অর্থ বছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মোট বাজেটের ৬.২ শতাংশ কম এবং জিডিপি ৪.৩ শতাংশ কম জিডিপি থেকে বরাদ্দকৃত অংশের উপর নির্ভর করে বিবেচনা করা হয় সরকার খাতটিকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ প্রায় ১ বর্গ ফুট ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ মোট জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। বিশ্ব স্বাস্থ্যের মতে একটি মান সম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালাতে হলে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশ হওয়া উচিত।

তথ্যসূত্র - বাজেটের সংক্ষিপ্ত সার-অর্থমন্ত্রণালয় (২০০৯ হতে ২০১৫)।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দূরাবস্থা

বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতে এক দিকে যেমন দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে অন্য দিকে রয়েছে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৈষম্যর পাশাপাশি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন ক্ষেত্রেও অবকাঠামো উন্নয়নের উপরই বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে জাতীয় বাজেটের একটা বড় অংশ অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র অপর্যাপ্ত লোকবল ও অর্থ সংকটের কারণে। প্রাথমিক সেবার মান নিশ্চিত করতে ১২,৮১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে রয়েছে দক্ষ চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতির সংকট। সরকারী হাসপাতালগুলোতেও সাত থেকে আট হাজার চিকিৎসকের পদ খালী। কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসকে অভাবে ফার্মাসিস্টরাই রোগী দেখেন।

সরকার একদিকে যেমন সরকারী হাসপাতালের দক্ষতা বাড়াতে পারছে না অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়। স্বাস্থ্য খাতের মতো এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ খাতের এরকম চেহারার দশা দেখলে দেশের জনগণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয় সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রণীত বিধিমালা অনুসারে উপজেলা, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ও তার নিচের প্রতিষ্ঠান সমূহে স্বাস্থ্য বাজেট নির্ধারণ হয়। এখানে জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কোন ভূমিকা নেই। সুযোগ নেই স্থানীয় চাহিদার আলোকে নতুন কোন খাত অর্ন্তভূক্তির বা কোন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রণীত নিদেশিকা অনুযায়ী উপজেলার স্বাস্থ্য বাজেট নির্ধারণ হয়। কোন খাতে কত ব্যয় হবে, অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় তা নির্ধারণ করে।

সুপারিশ

১. স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষনে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

২. এলাকা ভিত্তিক চাহিদা নিরুপন করে বাজেট প্রণয়নের ব্যবস্থা করা।

৩. ধনীদের কাছ থেকে করের মাধ্যমে অধিক অর্থ আদায় এবং দরিদ্রদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা

৪. শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি তৈরীর মাধ্যমে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে নিয়মিত অবস্থান নিশ্চিতকরণ এবং সেবাদানকারীদের তদারকি করে স্বাস্থ্য খাতের সকল প্রকার আদায়ে অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতি দূর করতে হবে। সেই সাথে স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দকৃত অর্থের অসমতা দূর করতে হবে।

তথ্যসূত্র

১. বাজেটের সংরক্ষিতসার- ৩, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ অর্থমন্ত্রণালয়।

২. জাতীয় বাজেটের সাম্প্রতিক গতিধারা প্রাক বাজেট আলোচনা - গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন।

৩. স্বাস্থ্য অধিকার - বার্ষিক পত্রিকা - ২০১৪

email: rasul-sdp@yahoo.com

আমিনুর রসুল, সদস্য সচিব, উন্নয়ন ধারাট্রাষ্ট


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।