নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার: আমাদের করণীয়


নারীকে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে অধিকারসম্পন্ন নাগরিক ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৩ সাল থেকে নারীপক্ষ কাজ করে আসছে। নারীপক্ষ বর্তমানে ছয়টি ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে তার মধ্যে ‘নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৪ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত ‘জনসংখ্যা ও উন্নয়ন’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত কর্মসূচি এবং পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে গণচীনের রাজধানী বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত ৪র্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা মাধ্যমে নারীর স্বাস্থ্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে গণ্য হয়। পরবর্তীতে নারীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য আলোচনায় ‘যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার’ এবং সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা স্বীকৃতি লাভ করে। ২০ বছরে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়সূচীর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত আইন, নীতি ও কর্মসূচি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের সাথে পুরোপুরি সমকক্ষ নয়।

স্বাধীনতা উত্তর ৪ দশকে বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোর প্রশংসনীয় স্তরে উন্নীত হয়েছে। তবে সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ সেবাদানকারীর অভাব ও চিকিৎসকের অনুপস্থিতি; উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব; যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা ও প্রশাসনের জটিলতা; ঔষধ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা ও অপব্যবহার; সুসংগঠিত রেফারেল পদ্ধতি না থাকা যেমন: যথা সময়ে, প্রয়োজনীয় প্রাথমিক ব্যবস্থা না দিয়ে রেফার করা, অপ্রয়োজনীয় রেফার করা; দুর্নীতি এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পূর্ণ সদব্যবহার না হওয়া। এই সকল কারণে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তিতে বিরাট বাধা, যা নারীদের জন্য আরো প্রকট। যা গর্ভবর্তী ও প্রসূতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এছাড়া সমাজে নারীর অনগ্রসর অবস্থান, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী, সামাজিক কুসংস্কার প্রভৃতি কারণে এখনও বছরে ৭-৮ হাজার নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারায়।

নারীর অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের যে অঙ্গিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ, তাতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে ‘নারীর স্বাস্থ্য’ বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার ভিত্তিক বাজেট অনুশীলন শুরু হলেও, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ রাখার বিষয়টি এখনও গুরুত্ব পায় নাই। হাসপাতালের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে ‘হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠন করা হলেও সভাপতির অনীহা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে এই কমিটিগুলো সচল ও সক্রিয় হচ্ছে না। উল্লেখ্য এই সকল কমিটির সভাপতি জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্যবৃন্দ।

গর্ভকালীণ সেবা ও নিরাপদ প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী সেবা পাওয়া নারীর মৌলিক অধিকারের অংশ, কিন্তু বাংলাদেশের অনেক নারী নিজে ও তার পরিবারে এখনো স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়।

নারীর স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকার:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য বলতে সার্বিকভাবে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাল থাকা বোঝায়; কেবল রোগের অনুপস্থিতিকে বোঝায় না।

অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে রাষ্ট্রের করনীয় সম্পর্কে বলা আছে; ধারা ১২.২-ক এ শিশু মৃত্যু ও মৃত সন্তান প্রসবের সংখ্যা হ্রাসের লক্ষ্যে ও শিশুর সুস্থ্য বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দ এবং ধারা ১২.২- ঘ এ অসুস্থ্য অবস্থায় চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসকের মনোযোগ নিশ্চিত করার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ।

প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা অনুসারে- সাধারণভাবে নিরাপদ গর্ভধারণ ও জন্মদানের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রনের জন্য নিরাপদ, কার্যকর ও নির্ভরশীল, সুলভ, গ্রহনযোগ্য ও সহজপ্রাপ্য পদ্ধতিকে বোঝায়।

প্রজনন অধিকার বলতে প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাধারণত নিম্নোক্ত আইনি অধিকার ও স্বাধীনতাকে বোঝায়:

  • সন্তান ধারণের সক্ষমতা এবং কখন, কতজন সন্তান গ্রহণ করবে অথবা আদৌ সন্তান গ্রহণ করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ও স্বাধীনতা
  • নারীর নিরাপদ গর্ভধারণ, প্রসব এবং স্বাস্থ্যবান শিশু জন্মদান ও সঠিক স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির সুযোগ
  • নিরাপদ, কার্যকর, সহজলভ্য এবং গ্রহণযোগ্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পছন্দ করতে পারা
  • প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জন্মদান অথবা জন্ম নিরোধের জন্য নারী পুরুষ সকলের সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার
  • প্রজনন বিষয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন ও জবরদস্তিমুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার

২০০৯ সালে জাতিসংঘ এর মানবাধিকার কাউন্সিলে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় , যে প্রসূতি মৃত্যুর অধিক হার ও প্রসবজনিত রোগভোগ অগ্রহণযোগ্য এবং তা প্রতিরোধযোগ্য বলে ঘোষিত হয়। প্রসূতি মৃত্যুর বর্তমান হার জীবনে বেঁচে থাকার অধিকারকে লঙ্ঘন করে; যা নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট অধিকারসমূহ:

  • বেঁচে থাকার অধিকার
  • স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার
  • মত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার
  • মর্যাদার অধিকার
  • নিরাপত্তার অধিকার
  • গৈাপনীয়তার অধিকার
  • বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকার অধিকার
  • যৌন সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাবার অধিকার
  • শিক্ষার অধিকার
  • তথ্য পাওয়ার অধিকার

আন্তর্জাতিক সনদ এবং বাংলাদেশের অঙ্গিকার

মানবাধিকারের সর্বজনিন ঘোষণাপত্র এর অনুচ্ছেদ-২৫ এর (ক) নিজের ও নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য উপযুক্ত জীবন যাত্রার মানের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে এবং ২৫ এর (খ) মাতৃত্ব ও শৈশব অবস্থায় প্রত্যেকে বিশেষ যতœ ও সহায়তা লাভের অধিকারী ১৯৯৪ সালের “জনসংখ্যা ও উন্নয়ন” কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘গৃহীত কর্মসুচি’ এর ৮নং নীতিতে দৈহিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের যতদুর সম্ভব উন্নতমানের সুবিধাদি ভোগ করার অধিকার থাকবে। পরিবার পরিকল্পনা এবং যৌনস্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যাসহ সার্বিক স্বাস্থ্য সুবিধার সুযোগ যাতে সর্বজনীন হয় প্রতিটি রাষ্ট্রই তা নিশ্চিত করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) উল্লেখ্য অনুচ্ছেদ-১২ এর (১) সমতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত সেবা নিশ্চিত করা এবং (২) প্রয়োজনে গর্ভাবস্থায় ও সন্তান জন্মদান পরবর্তীকালীন সময়ে নারীর জন্য বিনামূল্যে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ ও উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করা

সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Millennium Development Goals)- ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ আয়োজিত মিলেনিয়াম সামিটে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ঘোষনায় স্বাক্ষর করে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার প্রসূতি মৃত্যু হ্রাস সংশ্লি¬ষ্ট পঞ্চম লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে বর্তমান প্রসূতি মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সরকারের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জাতীয় দলিল ও নীতিমালা সমূহ: বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির-

  • অনুচ্ছেদ ১৫ (ক) চিকিৎসাসহ জীবনধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।
  • অনুচ্ছেদ ১৮ (১) জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য।

বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাস্থ্য কেবল রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃত, জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়।

জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১: স্বাস্থ্যনীতির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে- (১) সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও জরুরী চিকিৎসা সেবা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করণ (২) কোন প্রকার বৈষম্য না করে সেবা গ্রহীতা কেন্দ্রিক মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্যতা ও বিস্তৃতি নিশ্চিত করণ (৩) রোগ প্রতিরোধ ও সীমিতকরণের জন্য অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে সেবা গ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এর পঞ্চম মূল লক্ষ্য ‘‘শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস করা, বিশেষ করে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে এ হারকে যুক্তিসংগত হারে হ্রাস করা”। ষষ্ঠ মূল লক্ষ্য, ‘‘আগামী ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিস্থাপনযোগ্য জন-উর্বরতা (Replacement level of Fertility) অর্জন করার লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন ও স্বাস্থ্য সেবাকে আরো জোরদার ও গতিশীল করা।” একই স্বাস্থ্যনীতির সপ্তম মূল লক্ষ্যটি হচ্ছে, ‘‘মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও যথাসম্ভব প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ প্রসবসেবা নিশ্চিত করা।” অর্থাৎ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১-এ মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা জোরদার ও গতিশীল করা, মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং নিরাপদ প্রসবসেবা নিশ্চিত করার বিষয়গুলি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ১২ এর ১ এ নারীর জীবনচক্রের সকল পর্যায়ে যথা-শৈশব, কৈশোর, যৌবন, গর্ভকালীন সময় এবং বৃদ্ধ বয়সে পুষ্টি, সর্বোচ্চ মানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করা।

সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন নীতিমালা:

১. জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০০১ (Maternal Health Strategy 2001)

২. কিশোর প্রজনন স্বাস্থ্য কৌশল ২০০৬ (Adolescent Reproductive Health Strategy 2006) ৩. জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০০৯ (Neonatal Health Strategy 2009)

৪. জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ (National Health Policy 2011)

৫. নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ (National Policy for Women’s Advancement, 2011)

৬. জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২ (National Population Policy 2012)

৭. জাতীয় পুষ্টি নীতি ২০১৪ (National Nutritional Policy 2014)

৮. মাসিক নিয়মিতকরণ ১৯৭৮ (Menstrual Regulation (MR) Policy 1979)

স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি ও উদ্যোগ:

১. ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১১-২০১৫ (Sixth Five Year Plan FY2011-FY2015)

২. মাতৃত্বকালীন ভাতা: সরকার ২০০৮ সাল হতে প্রান্তিক দরিদ্র গর্ভবতী নারীদেরকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান করে আসছে। বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে ৩০জন দরিদ্র গর্ভবতী নারীকে তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে প্রদান করছে।

৩. মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কীম: গরীব ও দুঃস্থ নারীদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবা গ্রহণের চাহিদা বাড়িয়ে প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানোর লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০৮ সাল থেকে ‘‘ডিমান্ড সাইড ফাইনান্সিং” শীর্ষক মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কীম চালু করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৮টি জেলার ৫৩টি উপজেলায় এ কার্যক্রম চালু রয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য স্কীমের আওতায় প্রতিজন গর্ভবতী নারীকে ৫০০ টাকা করে প্রদান করছে।

৪. স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি খাতের উন্নয়ন Health Population and Nutrition Sector Development Program (HPNSDP), 2011-2016: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের আওতায় মোট ৩২টি অপারেশনাল প্ল্যান- এর মাধ্যমে এই কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

৫. মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য (Maternal and Neonatal Health, MNH) কর্মসূচি: বাংলাদেশ সরকার মা ও নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাসের লক্ষ্যে ১১টি জেলায় বাস্তবায়ন করছে।

৬. মাতৃমৃত্যু, মৃতজন্ম ও নবজাতকের মৃত্যু পর্যালোচনা কার্যক্রম: ২০১০ সাল থেকে কার্যক্রমটি শুরু হয় এবং বর্তমানে ১২টি জেলায় এর বাস্তবায়ন হচ্ছে।

৭. কমিউনিটি ক্লিনিক: বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পেীঁছে দেয়ার লক্ষ্যে প্রতি ৬০০০ জনগণের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছে।

৮. জরুরী প্রসূতি সেবা কেন্দ্র: উপজেলা হাসপাতাল সমূহ পর্যায়ক্রমে জরুরী প্রসূতি সেবা কেন্দ্র চালু করার ঘোষনা দেয়। ১৯৯৭ সালে গ্রামের তৃণমূল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তিতে এই সকল সমস্যার কথা বিবেচনা করেই সরকার দেশের ১৭৯টি উপজেলায় জরুরী প্রসূতি সেবা চালু করেছে এবং পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় এই সেবা চালু করা হবে।

বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমঙ্গল নিশ্চিত করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন প্রভৃতি অঙ্গীকার করে। তথাপি বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার বর্তমান ১৯৪ থেকে ১৪৩ এ কমিয়ে আনার অঙ্গিকার ছিল এবং বর্তমানে এই হার ১৭০। বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে আসলেও অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত সেবার অভাবে অনেক নারী প্রসবজনিত জটিলতায় বিভিন্ন রোগ-ভোগে ভূগছে। যা তার পরবর্তী জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে।

প্রজনন স্বাস্থ্যনীতি ও কর্মসূচির দুর্বলতা:

  •  সরকারের নীতি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ অবগত নয়
  • নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য একীভূত তথ্য নাই এবং সংগৃহীত তথ্যের জেন্ডারভিত্তিক বিশ্লেষণ দুর্বল
  • চিকিৎসকদের মাঠ পর্যায়ের কর্মস্থলে নিয়মিত অবস্থান অনেকাংশেই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না
  • কৈশরকালীণ ‘প্রজনন স্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০০৬’ এর আংশিক বাস্তবায়ন
  • সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ভিত্তিক সরঞ্জাম ও ঔষধের সরবরাহের স্বল্পতা
  • উপজেলা পর্যায়ে ২৪ ঘন্টা জরুরী প্রসূতি সেবা চালু না থাকা
  • সেবাদানকারীদের জবাবদিহিতার অভাব
  • সেবা প্রতিষ্ঠান ও মাঠ কার্যক্রমের নিয়মিত পরিবীক্ষণের অভাব
  • সনাতন দাই, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাই ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সমন্বয়ের অভাব
  • হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা নিয়মিত না হওয়া

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত নারীপক্ষ’র কর্মসূচি:

  • নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ ও নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে দেন-দরবার
  •  নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ে দেশব্যাপী সচেতনতা মূলক সভা সমাবেশ
  • নারীর প্রতি স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা তৈরীতে গবেষণা
  • নারীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা সহজপ্রাপ্য এবং প্রাপ্তিতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি
  • প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ে নারীর সর্বজনীন অভিগম্যতা ও সেবা ব্যবস্থার রূপরেখা নিয়ে গবেষণা
  • নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ
  • সহিংসতার শিকার নারীর জন্য স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত ও ন্যায় বিচার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া তরান্বিত করা

নারীপক্ষ নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা অর্জনের জন্য বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট ও ভিন্নমূখী কর্মসূচীর একটি হচ্ছে- স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা তৈরী ও সেবার মান উন্নয়নে “নারীর স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত এ্যাডভোকেসী পার্টনারশীপ (WHRAP) প্রকল্প। যা ২০০৩ সাল থেকে বরিশাল বিভাগের ৪টি জেলার ৯টি উপজেলায় পরিচালনা করছে।

নারীর স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুপারিশ:

১. গর্ভাবস্থা, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সকল সময়ে জরুরী প্রসূতি সেবা, Emergency Obstetric Care (EmOC), জটিল স্বাস্থ্য সেবার একটি সমন্বিত কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার থাকবে; যা প্রসূতির জীবন বাঁচানোর জন্য দ্রুত ও দক্ষতার সাথে দেয়া

২. নারী নিজে বাড়িতে সন্তান প্রসব করাতে চাইলে সেখানে তার নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করা

৩. প্রশিক্ষিত দাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ওঈচউ এবং CEDAW এর প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার (SRHR) সংক্রান্ত বিষয়গুলো সংযুক্ত করা

৪. সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা

৫. স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুস্বাক্ষরকৃত আন্তর্জাতিক সনদের আলোকে আইন, নীতিমালা ও কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সংশোধন করা

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুপারিশ:

  • স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে সমন্বিত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা এবং শ্রেণীকক্ষে পাঠদান সহজিকরণ করা
  • সকল শ্রেনী-পেশার মানুষের জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা
  • গর্ভকালীণ সেবার তালিকায় রক্তের গ্রুপ নির্ণয় অর্ন্তভূক্ত করা
  • হাসপাতালে প্রসূতি নারীর ২৪ ঘন্টা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা
  • প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত দাই কর্মসূচির পাশাপাশি সনাতন দাইদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পুনরায় চালু করা
  • পুরুষের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচার বৃদ্ধি করা এবং অস্থায়ী পদ্ধতির প্রতি বিশেষগুরুত্ব দেয়া
  • প্রসূতি মৃত্যু সংক্রান্ত নির্ভূল তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য অত্যাবশকীয় তথ্য নিবন্ধন (ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন) চালু ও শক্তিশালী করা
  • ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, সচিব, চৌকিদার ও দফাদারদেরকে প্রসূতি মৃত্যু এবংপ্রসূতি মৃত্যুর তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধকরণ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া
  • সকল প্রসূতি মৃত্যুর অর্থ্যাৎ বাড়িতে, হাসপাতালে যাবার পথে ও মৃত
  • অবস্থায় যাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসে সেই সকল মৃত্যুর তথ্য অবশ্যই সংগ্রহ করা
  • প্রসূতি মৃত্যুর সঠিক সংখ্যার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সেবাদানকারীদের মধ্যে সমন্বয় করা
  • সাধারণ জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের কর্মস্থলে নিয়মিত অবস্থান নিশ্চিত করা
  • সেবাদানকারীদের তদারকি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে শক্তিশালী
  • পর্যবেক্ষন পদ্ধতি তৈরী করা
  • প্রসূতি নারীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার করা হলে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রেফার করা, হাসপাতাল থেকে যানবাহন, অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দেয়া
  • হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা সচল ও নিয়মিত করা
  • নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারের বিষয়টি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উপেক্ষিত তাই গনমাধ্যম ব্যবহার করে সচেতন বৃদ্ধি করা

সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা ক্রমশ কমে আসছে এবং বেসরকারী হাসপাতাল/ক্লিনিকের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এতে করে গরীব জনগণের চিকিৎসা খরচ অনেক গুন বেশি হচ্ছে।

তথ্য সংগ্রহ

  1. http://www.unfpa.org/sites/defult/files/event-pdf/PoA_en.pdf

  2. http://www..un.org/womenwatch/daw/beijing/pdf/BDPfA%20E.pdf

  3. http://www.gender budgets.org/index.php?option=com_joomdoc&view=documents&path=resources/by-region-country/asia-documents/bangladesh/gender-report&Itemid=543

  4. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গঠনতন্ত্র ১৯৪৬ http://www.who.int/about/definition/en/print.html

  5. http://www.choiceforyouth.org/information/sexual-and-reproductive-health-and-rights/official-definitions-of-sexual-and-reproductiv

  6. জাতিসংঘ এর মানবাধিকার কাউন্সিল এর ১৭ জুন ২০০৯ সালের ১১তম সভায়, ‘প্রসূতি মৃত্যুর অধিক হার ও প্রসবজনিত রোগভোগ অগ্রহণযোগ্য এবং তা প্রতিরোধযোগ্য’ প্রস্তাব গৃহীত হয়। http://ap.ohchr.org/Documents/E/HRC/resolutions/A_HRC_RES_11_8.pdf

  7. মানবাধিকারের সর্বজনিন ঘোষণাপত্র-http://www.un.org/en/documents/udhr/index.shtml#a25

  8. নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ CEDAW-1979

  9. বাংলাদেশের সংবিধান- bdlaws.minlaw.gov.bd/bangla_pdf.php?id=957

  10. জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ http://www.mohfw.gov.bd/index.php?option=com_content&view=article&id=74&Itemid=92&lang=en

  11. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ http://mowca.portal.gov.bd/sites/default/files/files/mowca.portal.gov.bd/policies/64238d39_0ecd_4a56_b00c_b834cc54f88d/National-Women-Policy-2011English.pdf

  12. বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার ক্রমশ সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নারীর অভিগম্যতা বৃদ্ধি, সেবাদানকারীদের জবাবদিহিতা তৈরী এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নে প্রভাবিত করতে ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ Women’s Health and Rights Advocacy Partnership (WHRAP) প্রকল্পের আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

সামিয়া আফরীন- নারীপক্ষ
১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩/২ জুন ২০১৬

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।