প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার


মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও অন্যান্যদের সাথে সমতার ভিত্তিতে সেবা পাবে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিবন্ধীতার কারণে তারা এ অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা সবসময় অবহেলিত, যাদের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছান দুরূহ তারাই পরিকল্পনার বাইরে থাকছে। কাজেই এ অবস্থা উত্তরণে সম্মিলিত উদ্যোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে যা বলা হয়েছে-

জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ, ধারা ২৫:

প্রতিবন্ধিতার কারনে কোনরূপ বৈষম্য না করে শরীক রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সর্বাধিক অর্জনযোগ্যমানের স্বাস্থ্য লাভের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। শরীক রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য-বিষয়ক পুনর্বাসনসহ লিঙ্গ-ভিত্তিক সামাজিক অসমতার প্রতি সংবেদনশীল স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সকল উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সুনির্দিষ্টভাবে শরীক রাষ্ট্র:

ক) অন্যান্যদের সাথে সমতার ভিত্তিতে একই ধরণ, একই গুণ ও মানসম্পন্ন বিনামূল্যের বা স্বল্পব্যয়ী স্বাস্থ্য কর্মসূচি গ্রহণ ও সেবা প্রদান করবে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য এই কর্মসূচি ও সেবায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে;

খ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গকে প্রতিবন্ধীতার কারণে প্রয়োজনীয় বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে। ত্বরিৎ সনাক্তকরণ, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিশু ও প্রবীণসহ সকলের অধিকতর প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি হ্রাস ও প্রতিরোধ এই সেবায় অন্তর্ভূক্ত থাকবে;

গ) গ্রামীণ এলাকাসহ সর্বত্র যতদূর সম্ভব গ্রহীতার নিজ-এলাকাতেই এই স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে;

ঘ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে অন্যান্যদের মত সম-মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের জন্য পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করবে। সরকারী বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নৈতিক মান নির্ধারণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের মানবাধিকার, আত্মমর্যাদা, স্বাধিকার এবং বিশেষ চাহিদা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের অবাধ ও সচেতন-সম্মতির ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে;

ঙ) স্থানীয় আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমার ব্যবস্থা করে এবং তা ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে প্রদান করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য দূর করবে;

চ) প্রতিবন্ধীতার কারণে খাদ্য ও পানীয় অথবা স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সেবা প্রদানে বৈষম্য বিলোপ করবে।

বাংলাদেশে “প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩” যা বলা হয়েছে (তফসিল ৩):

ক) প্রতিবন্ধী শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকল্পে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

খ) শিশু, নারী, প্রবীণ ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকতর প্রতিবন্ধীতার ঝুঁকি হ্রাস ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

গ) মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন রহিয়াছে, এইরূপ প্রতিবন্ধী দুঃস্থ ব্যক্তির জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থাসহ, ক্ষেত্রমত, চিকিৎসা খরচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে কর রেয়াতের সুবিধা প্রদান।

ঘ) বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকসমূহে দুঃস্থ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় হ্রাসকল্পে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ঙ) সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা উপকরণের ব্যবস্থাসহ চিকিৎসক, সমাজকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে আরো উল্লেখ আছে যে,

  • প্রতিবন্ধী মানুষের সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির অধিকারে কথা বলা হয়েছে; (ধারা ১৬, ট,ঠ)
  • হাসপাতালে ইশারা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনে স্পীচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এর ব্যবস্থা করা; (তফ ৪, গ)
  • হাসপাতাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতা যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা; (তফ ৫, ক)
  • মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পুনর্বাসন নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য উপযোগীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা; (তফ ৮, গ)
  • প্রতিবন্ধিতার ধরণ অনুযায়ী ন্যূনতম সেবামান নির্ধারণ করা এবং পেশাদার সেবাদাতা তৈরীর লক্ষ্যে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; (তফ ৮, ঘ)

স্বাস্থ্য সেবায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বর্তমান অবস্থা:

  • স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ থাকে না ফলে তাদের প্রকৃত প্রয়োজনের প্রতিফলন হয় না।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্বাস্থ্্য সেবা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাব।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষায়িত সেবা প্রদানকারী সংস্থার অভাব।
  • শুধুমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের দায়িত্বে থাকে না অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে কাজ করেন। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা।
  • বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সরকারী, বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র সমূহ যেমন: কমিউনিটি ক্লিনিক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালগুলো প্রবেশগম্যতার অভাব। যেমন র্যা ম্প না থাকা, প্রতিবন্ধী বান্ধব টয়লেট ইত্যাদি না থাকা।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রদানের ক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকা।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার ইস্যু এখনও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সচেতনতার অভাব রয়েছে।
  • মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সেবা কেন্দ্র না থাকার কারণে তাদের স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া।
  • বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ইশারা ভাষার দোভাষী না থাকায় সঠিক চিকিৎসা সেবাপ্রাপ্তীতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
  • ফিজিও থেরাপী ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ৬৪টি জেলায় ৬৮টি স্থানে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র শীর্ষক কর্মসূচী চালু থাকলেও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক বৈষম্য।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সমাজের সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।

স্বাস্থ্য সেবায় সমস্যাসমূহ নিরসনে করণীয়:

  • হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রতিবন্ধিতা নিরোধমূলক বা নিরোধে সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করা।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতায়াত ও যোগাযোগের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণকল্পে সরকারী ও বেসরকারীভাবে গড়ে উঠা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসমূহ প্রতিবন্ধিতা বান্ধব করা। যেমন: র্যা ম্প স্থাপন, লিফ্ট সুবিধা, টয়লেট ইত্যাদি।
  • সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা উপকরণের ব্যবস্থাসহ চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ।
  • প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র যেমন: কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভিন্ন কিøনিক, হাসপাতাল সমূহে মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা বোঝানোর ইশারা ভাষার দোভাষী ব্যবস্থা।
  • প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র প্রতি উপজেলায় সম্প্রসারণ করা এবং প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করা।

পরিশেষে বলতে চাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তীর অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সরকারী-বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করে বিদ্যমান সমস্যার আলোকে সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ সঠিক বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে এবং এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।

মহুয়া পাল
পরিচালক
রিসোর্স মবিলাইজেশন অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।