গ্রাম পর্যায়ে মাতৃ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা


সরকার যখন অব্যাহতভাবে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে চলেছে তখন চিকিৎসক সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালসমূহে জনগণের চিকিৎসা কার্যক্রম। সরকারী হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নাই। চিকিৎসকেরা উপজেলা পর্যায়ে থাকতে চায় না। এই সংকটের প্রভাব জনস্বাস্থ্যের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। এর বিরূপ দিক পরিলক্ষিত হয় গ্রামগঞ্জের মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে।

গ্রামের দাইয়েরা একমাত্র ব্যক্তি যারা গর্ভ থেকে শুরু করে প্রসব হওয়া পর্যন্ত মায়েদের দেখাশোনা করেন। গ্রামে গরীব, অসহায় গর্ভবতী নারীদের পাশে দাঁড়ায় এই দাইমারা। কোন কিছুর বিনিময়ে তারা এই কাজ করেন না।

গর্ভবতী না হলেও মায়েদের ঘরে ঘরে যান দাইমায়েরা। তারা ট্রাডিশনাল বার্থ এটেন্ডেন্ট (ঞইঅ) নয়। তারা হাসপাতালের সাথেও জড়িত নয় কিন্তু তারা গর্ভবতী নারীদের খোঁজ-খবর করেন। অনেক এলাকায় সপ্তাহে একদিন তারা উঠান বৈঠকও করেন। সেখানে তারা মা এবং গর্ভবতী নারীদের ডাকেন, তাদের সাথে কথা বলেন। স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ে আলোচনা করেন।

দাইমারা শুধু গর্ভবতী নারীদেরকেই পরামর্শ দেন তা নয়। স্বাভাবিক জন্মদান, প্রসব পরবর্তী সেবা ও নবজাতক শিশুরও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। জন্মদানে কোন জটিলতা বা ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যা দেখলেই দাইমারা রোগীকে জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পরিবারকে পরামর্শ দেন, নিজে সাথে থেকে রোগীকে হাসপাতালেও নেন। গ্রামের গরীব মায়েদের বেসরকারী ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়া ব্যয়বহুল এবং তাদের পক্ষে এত টাকা করচ করা সম্ভব হয় না। গর্ভকালিন জটিলতা বা ঝুঁকিপূর্ণ নারীকে দাইমারা সাধারণত সরকারী সদর হাসপাতালে (সরকারী স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র) নেয়। তবে সেখানেও সব সময় ডাক্তার পাওয়া যায় না।

সাধারণত ইউনিয়ন পর্যায়ে হাসপাতাল খোলে সকাল ৯টায়। বেলা সার ১২টার পরে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ তাই ইউনিয়ন হাসপাতালকে বলে সারে ১২টার হাসপাতাল। এখানে সাধারণ জ্বর, ঠান্ডার ইত্যাদি ওষুধ পাওয়া যায়। গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা গর্ভবতী নারীদের জটিল কোন সমস্যার সেবা এখানে নাই। গর্ভবতী নারী, প্রসবোত্তর মা বা নবজাতক শিশুর জটির কোন অসুবিধা হলে দাইমায়েরা উপজেলা বা জেলা সদর হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।

সব উপজেলা হাসপাতালে আবার গর্ভবতী নারীদের প্রসবকালীন জটিলতা মোকাবেলা করার ব্যবস্থা নাই। অপ্রতুল চিকিৎসক, এনেসথেশিয়া জন্য চিকিৎসক নাই ফলে দূরদুরান্ত থেকে রোগীরা এসে চিকিৎসা পায় না। বাধ্য হয়ে যেতে হয় বেসরকারী ক্লিনিকগুলোতে। আর এখানে সেবা নিতে যাওয়া মানেই প্রচুর টাকার যোগান দেওয়া। গরীব অসহায় পরিবারগুলোকে তখন বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হয় বাড়ির আসবাসপত্র অথবা গরু, ছাগর, হাঁস-মুরগি। অনেকক্ষেত্রে চড়া সুদে টাকা তুলে চিকিৎসা করতে হয়। আর সুদের টাকা পরিশোধ করতে হয় সর্বস্বান্ত।

জেলা পর্যায়ে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সাধারণ সন্তান প্রসব এবং গর্ভবতী নারীদের জটিল কোন সমস্যা দেখা দিলে তারও সেবা পাওয়া যায়। কিন্তু মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এই সময়ের পরে অসহায় নারী বা শিশুদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পরে।

গ্রামে কিছু কিছু পরিবারের লোকজন প্রাইভেট ক্লিনিকের দালাল হিসাবে কাজ করে এবং ক্লিনিকেই যাতে সন্তান জন্মগ্রহণ করে সেই জন্য গর্ভবতী মাকে উদ্বুদ্ধ করে। তারাই আবার প্রাথমিক অবস্থায় গর্ভবতী মায়ের পরামর্শের জন্য দাইমাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। এসব ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও পরিবারের কাছে তখন দাইমার কথার কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না বা দাম থাকে না।

গর্ভবতী মায়ের প্রসবকালীন কোন অসুবিধা থাকলে কোথায় নিতে হবে তা আগে থেকে দাইয়েরা জানেন। প্রসবপূর্ব সেবার যে নিয়ম আছে সেখানে কি কি দেখতে হয় তা দাইয়েরা জানেন। ফলে দাইমা বিপদজনক গর্ভবতী মাকে চিহ্নিত করতে পারেন। গর্ভবতী মায়ের একলামশিয়া হতে পারে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। বিপদজনক চিহ্নগুলি চিনতে পারে বলেই দাইয়েরা সরকারী হাসপাতালে রেফার করতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের বিপদজনক চিহ্নগুলি সহজেই দাইয়েরা শিখতে পারে।

দাইমায়ের কথা তুলে ধরা হলো-

রাবেয়া বেগম, দাইমা, নাল্লা পাড়া, টাংগাইল।

দাই এর কাজ করতে করতে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে একজন গর্ভবতী মায়ের কবে সন্তান প্রসব হবে তা বুঝতে পারি। গর্ভাকালে মায়েদের বেশী বেশী শাক-সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেই। সব সময় আমরা গর্ভবতী মাকে দেখাশুনা করি কিন্তু আমাদের কাজের দাম নাই। আমরা আমাদের কাজের দাম চাই। সরকারী স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে গর্ভবতী মাকে নিয়ে গেলে যেন আমাদের একটু দাম দেয়।

সফুরা বেগম, পারাসিধাই, ঈশ্বরদী, পাবনা।

গর্ভবতী মায়ের প্রসবকালীন কোন সমস্যা দেখলে প্রথমেই সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সদর হাসপাতাল ভাল কিন্তু আমাদের (দাইমাদের) মূল্য দেয় না। নার্সরা আমাদের মুখ (বকাবকি) করে। যে গর্ভবতী মাকে নিয়ে যাই তার কাছে থাকতে দিতে চায় না।

সীমা দাস সীমু, উবিনীগ


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।