মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১


মানসিক স্বাস্থ্য, সার্বীক স্বাস্থ্যের এবং মানব বিকাশের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বিশ্বজুড়েই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং বিশৃংঙ্খলা বৈকল্যের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। এর মধ্যে অনেক বিশৃংঙ্খলা বৈকল্যই অপ্রতুল সেবা এবং সুযোগ সুবিধার কারণে চিকিৎসার বাইরেই থেকে যায়। এই সমস্যা উন্নয়নশীল দেশে সর্বাধিক প্রকট এবং তা বৈশ্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার বোঝা বাড়ায়। এখানে উল্লেখ্য যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সেবা এজেন্ডাতেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি তেমন ভাবে স্বীকৃত বা অগ্রগণ্য নয়। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হলো কিছু সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টির ক্রমানুক্রম অগ্রসরতাকে প্রভাবিত করেছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পলিসির উত্তরণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বিভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে মানসিক স্বাস্থ্যের স্বরূপ ও  ধারণা কাঠামো তৈরি হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশে মানসিক রোগ পরিকাঠামো একটি সার্বিক শারীরবৃত্তিয়-মনোসামাজিক রূপরেখা হতে উৎসরিত। তবে সামাজিক কৃষ্টিগতভাবে শারীরবৃত্তিয় স্বাস্থ্যের উপর অতিমাত্রায় জোর দেয়ার ফলে এর সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন পলিসিগতভাবে অবহেলিত থেকে গেছে। তবে আশার কথা হলো বিংশ শতাব্দির শুরু থেকে শারীরবৃত্তিয়, সামাজিক ও মানসিক কল্যাণ/সমৃদ্ধির সংযোগে একটি ত্রিমুখী সার্বীক স্বাস্থ্য ধারণার বিকশ ঘটেছে যা মানসিক স্বাস্থ্যে উত্তরোত্তর গুরুত্ব বাড়িয়েছে।

ফলশ্রুতিতে,  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা এই ত্রিমুখী মডেল অনুযায়ী স্বাস্থ্যকে “একটি সম্পূর্ণ শারীরবৃত্তিয়, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ এবং সমৃদ্ধির অবস্থান যা শুধুমাত্র কোন রোগ এর অনুপস্থিতি বা অসুস্থতা নয়” এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

সমগ্র বিশ্বে  প্রায় ৪০ কোটি মানুষ বিভিন্ন স্নায়বিক-মানসিক বিশৃংঙ্খলা বৈকল্যে আক্রান্ত আছেন (Firoz AHM)। বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ অনুযায়ী ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পরিসরে প্রায় ১৪ কোটি ৬০ লক্ষ লোক বসবাস করে যা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম এবং জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ৭ম বৃহৎ। আগামী ৪০ বছরে এই জনসংখ্যা ২৫ কোটিতে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ জনগণের বয়স ১৫ বছরের নীচে এবং ৬ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের উর্ধ্বে। WHO ২০০৭ রিপোর্ট অনুযায়ী সারা দেশে প্রতি এক লক্ষ লোকের জন্য ৩৭টি হাসপাতাল শয্যা এবং ২৫০ জনসাধারণ স্বাস্থ্য পেশায় নিয়োজিত আছেন। উপরোন্নত সকল হাসপাতাল শয্যার ৩২ শতাংশ বেসরকারি সেক্টর দ্বারা পরিচালিত। আর প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বলতে যা বোঝায় তা হলো সারাদেশে সর্বমোট ২১২২টি চিকিৎসক প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিকে (যার মধ্যে ১৮২২ টি সরকারি খাতে এবং ৩০০টি বেসরকারি খাতে) নিয়োজিত। এই বিশাল জনসংখ্যার চিকিৎসায় সারাদেশে সর্বমোট মাত্র ১৩৪ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন (IRIN) অর্থাৎ  প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার জন্য একজনেরও কম বিশেষজ্ঞ (০.৫%) নিয়োজিত।

বিরাজমান মানসিক স্বাস্থ্য সেবার চালচিত্র:

বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৫০ লক্ষ  প্রাপ্ত বয়স্ক (যা সার্বিক জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ) এবং শতকরা ২০ জন ১২ থেকে ১৭ বছরের শিশু/কিশোর কোন না কোন মানসিক বিশৃংঙ্খলা বৈকল্যে আক্রান্ত। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে,  গ্রামে শতকরা ১৭.৩ জন শিশু এবং শহরে শতকরা ১৪.৩ জন শিশু মানসিক বিশৃংঙ্খলা বৈকল্যে আক্রান্ত (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট, ২০১১)। এদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা এবং সুযোগ সুবিধা  খুবই অপ্রতুল।

বিশ্বের প্রায় অনেক দেশেই বিশেষ করে বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে সার্বীক স্বাস্থ্য সেবাখাতের বাজেটের খুব নগণ্য একটি অংশই (০.৪৪%) মানসিক স্বাস্থ্য সেবাখাতে ব্যয় করা হয় (WHO report 2005)  এবং এই ব্যয়ের ৬৭ শতাংশই বিনিয়োগ করা হয় মানসিক হাসপাতাল খাতে। আর মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সহজলভ্যতার ক্ষেত্রে ০.১১ শতাংশেরও কম সেবা গ্রহণকারি প্রয়োজনীয় সাইকোট্রপিক ঔষধ বিনামূল্যে পেতে পারেন। আরও উল্লেখ্য যে, কোন সামাজিক ইনস্যুরেন্স স্কীমই  মানসিক বিশৃংঙ্খলা বৈকল্যেকে অন্তর্ভুক্ত করে না। বর্তমানে দেশে বিরাজমান মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে নিয়মিত পরিবীক্ষণ/নিরীক্ষণের জন্য কোন মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে বলে জানা যায়নি।

দেশে বর্তমানে ৫০টি বহির্বিভাগ (out-patient) যার মাত্র চার শতাংশ হলো শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য। এই সেবা প্রতি এক লক্ষ জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৬ জন সেবা গ্রহণকারির চাহীদা পুরণে সক্ষম। বহির্বিভাগের মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারিদের ৪৪ শতাংশ নারী এবং সাত শতাংশ শিশু অথবা কিশোর-কিশোরী। এই সেবা গ্রহণকারিদের ৩০ শতাংশ সিজফ্রেনিয়া, ২০ শতাংশ মুড ডিসঅর্ডার এবং ২০ শতাংশ স্নায়বিক বৈকল্যে আক্রান্ত।

দেশে বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে দৈনিক ভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা  প্রদানের কোন ব্যবস্থা নাই। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে প্রতি এক লক্ষ জনের জন্য ০.৫৪ টি শয্যা ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট ৩১টি কমিউনিটি পর্যায়ে আবাসিক (in-patient)  সাইকায়াট্রিক ইউনিট আছে। এই শয্যার মাত্র দুই শতাংশ শিশু অথবা কিশোর-কিশোরীর জন্য বরাদ্দ। যেখানে গড়ে ৪২ শতাংশ নারী ও ১২ শতাংশ শিশু  ও কিশোর-কিশোরীরা এই সেবা গ্রহণ করে থাকে। এদের ৪২ শতাংশ সিজফ্রেনিয়া ও ৩৭ শতাংশ মুড ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। সারাদেশে মাত্র একটি মানসিক হাসপাতাল রয়েছে যা প্রতি এক লক্ষ জনের জন্য ০.৪টি শয্যা ক্ষমতা বিশিষ্ট এবং শতভাগ বহির্বিভাগ সেবাপ্রদানের নিমিত্তে নিয়োজিত। যদিও গত ১০ বছরে শয্যা সংখ্যা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে কিন্তু শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য কোন শয্যা বরাদ্দ নাই। এছাড়া আদালত সংক্রান্ত (forensic)  ইন-পেসেন্ট ইউনিটে ১৫টি শয্যা ও ৩৯০০ টি শয্যা রয়েছে অন্যান্য আবাসিক সেবা কেন্দ্রে।

মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার নিবিড় অংশ হিসেবে সেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, মাত্র চার শতাংশ প্রশিক্ষণ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে এবং এর দুই শতাংশ প্রশিক্ষণে নার্স এবং ০ শতাংশ প্রশিক্ষণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

প্রতি এক লক্ষ জনের জন্য ০.৪৯ মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী (সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে) নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে ০.৭২৮৫৭১৪৩ মনোরোগবিশেষজ্ঞ, ০.১৮২১৪২৮৫৭ অন্যান্য মেডিকেল ডাক্তার (মনোরোগবিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন), ০.১৯৬৪২৮৫৭১ নার্স, .০০৭১৪২৮৫৭ মনোবিজ্ঞানী, ০.০০২১৪২৮৫৭ সমাজকর্মী, ০.০০২১৪২৮৫৭ কর্মক্ষেত্র থেরাপিষ্ট (occupational therapist) এবং ০.০০২৮৫৭১৪২৯ জন বিবিধ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত আছেন।

বেশীর ভাগ মনোরোগবিশেষজ্ঞ প্রায় ৫৪ শতাংশ সরকারী ও বেসরকারী (মুনাফা) উভয় পর্যায়ে সেবা প্রদান করে এবং ৪৬ শতাংশ কাজ করেন এনজিও বা বেসরকারী (মুনাফা) সংস্থায়। অন্যদিকে, ৬২ শতাংশ মনোসামাজিক কর্মী যেমন, মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, নার্স বা কর্মক্ষেত্র থেরাপিষ্ট (occupational therapist) সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে, ২৬ শতাংশ এনজিও বা বেসরকারী (মুনাফা) সংস্থায় আর ১২ শতাংশ উভয় পর্যায়ে কাজ করেন।

বাংলাদেশে কমিউনিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য কোন ভোক্তা বা পারিবারিক ফোরাম বা সংগঠন নাই। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট, ঢাকা; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়; বিভিন্ন এনজিও; পেশাজীবি সংগঠন; বেসরকারী ট্রাষ্ট ও ফাউন্ডেশন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।

মানসিক বৈকল্য বা বিশৃংঙ্খলা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সেবা বরাদ্দে বৈষম্যরোধে যেমন, সরকারী আর্থিক সাহায্যে আবাসন সুবিধা; কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যরোধে চাকুরীচ্যুতি বা নিম্ন মজুরী প্রদান; শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান ইত্যাদির জন্য এখন পর্যন্ত কোন আইনগত বা আর্থিক ব্যবস্থা বা চুক্তি নেই।

যদিও সরকারী পরিচালিত মানসিক স্বাস্থ্য সেবা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, কমিউনিটি ¯¦াস্থ্য, মাদক আসক্তি, অপরাধ বিচার ও কল্যাণ ইত্যাদির মধ্যে এক ধরণের সমন্বয় রয়েছে, তথাপি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের এ ধরণের সেবা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে কোন খন্ডকালীন বা স্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী বা বিশেষজ্ঞ নাই। মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক বৈকল্য বা বিশৃংঙ্খলা প্রতিরোধ বিষয়ে প্রাচরণার জন্য কোন প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল ভিত্তিক কার্যক্রম নাই।

সারাদেশের জেলখানাগুলোতে অবস্থানরত কয়েদিদের কত শতাংশ সাইকসিস বা মানসিক  প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত তা এখনও অজানা।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন  প্রশিক্ষণে আইন  প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃ›˜ যেমন পুলিশ অফিসার, উকিল, বিচারক প্রখের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য।

পলিসি পরামর্শ:

বাংলদেশ মানসিক স্বাস্থ্য নীতি সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৬ এ যা নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (NCD) এর নিরীক্ষণ ও প্রতিরোধের স্ট্যাটেজি ও কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পলিসি অনুযায়ী মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনাগুলো হলো;

  • কমিউনিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বিকাশ
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার একটি  নিবিড় অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অন্তর্ভুক্তিকরণ
  • মানব সম্পদ, পরিবার এবং স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকারিদের অন্তর্ভুক্তকরণ।
  • স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকারিদের মানবাধিকার সংরক্ষণ।
  • অ্যাডভোকেসী ও প্রচারণা
  • বিভিন্ন  ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বাস্থ্য  চাহিদা পুরনে সমতাভিত্তিক সম্পদের বিতরণ ও পুনর্বিন্যাস করে এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করন।

স্বাস্থ্য সেবার গুণগত মান উন্নয়ন ও মনিটরিং সিষ্টেম এর বিকাশ।

এই পলিসিতে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ঔষধও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেমন- antipsychotics, anxiolytics, antidepressants, mood stabilizers and antiepileptic drugs ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একটি প্রধান যন্ত্রনা/সমস্য হলো অবসাদ এবং এর চিকিৎসায় প্রধান অন্তরায় হলো সামাজিক কুসংস্কার ও অপবাদ (stigma)। মানসিক রোগ, বৈকল্য বা বিশৃংঙ্খলাকে সামাজিকভাবে মনে করা হয় লজ্জাজনক এবং ঘৃণ্য। ফলে, সামাজিক ভাবে একধরণের অস্বীকৃতি ও ঔদাসীন্য বিরাজমান এবং গোপনীয়তা অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক রোগের চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার আধুনিক ধারণা দীর্ঘস্থায়ী আবাসিক বা হাসপাতালে (যেমন, পাবনা মানসিক হাসপাতাল) অবস্থান করাকে উৎসাহিত করেনা। বরং, স্বল্পস্থায়ী হাসপাতাল যেমন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট, ঢাকা; সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য সাধারণ হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজসমূহ কর্তৃক প্রদেয় সেবা গ্রহণ করাকে উৎসাহিত কর। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বিকাশে “কমিউনিটি সাইকায়াট্রি” একটি উল্লেখযোগ্য পথপ্রদর্শক।

এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আধুনিক পদ্ধতিতে সার্বিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীর শতকরা ৬২%ই হলো গ্রামীণ ডাক্তার যাদের কোন প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নাই এবং মাত্র চার শতাংশ স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত (Health Polilcy of Bangladesh, Sopner Shopan, 2011)। গ্রামীণ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের ধরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শতকরা ৭০% জনই রোগ মুক্তির লক্ষ্যে কোন না কোন গ্রামীণ ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। অর্থাৎ গ্রামীণ ডাক্তাররা সার্বিক স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এই বিশাল অপ্রশিক্ষিত গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীদের প্রতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ পেশাদার করে তৈরী করা অপরিহার্য। ইতিমধ্যে গত দুই দশক ধরে সীমিত আকারে হলেও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট, ঢাকা ডাক্তার, স্বাস্থ্য কর্মী, মসজিদের ইমাম ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে তৃণমূল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে  প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে (Firoz AHM)। এ পর্যন্ত  ইনষ্টিটিউটের মাধ্যমে প্রায় ৫০০০ স্বাস্থ্য কর্মী, ৪০০০ ডাক্তার, ৫০ সিভিল সার্জন ও ২০০ ইমাম মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির প্রসার ফলে সাইকোট্রপিক ড্রাগের বাজারে সহজলভ্যতা মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায়, বিশেষ করে আক্রমনাত্বক মানসিক রোগীর চিকিৎসায় উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখছে।

বাংলাদেশ সরকারের “ভিশন ২০২১” এর লক্ষ্য হলো - বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশের মানুষকে সুস্থ, সুখী এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী দেখা। এর প্রতিফলন দেখা যায় সরকারের ৪২০ কোটি ডলারের পঞ্চবার্ষিকী  ষ্ট্যাট্রেজিক প্রোগ্রামের ৭০ শতাংশই  জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে অর্থায়নের মধ্যে। এই লক্ষ্যে ২০১১-১৬ অর্থবছরের সেক্টর প্রোগ্রামে দেশের সকল নাগরিকের কাছে গুণগত, সমতা ভিত্তিক ও ন্যায্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

তবে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিকে মানসিক স্বাস্থ্য বান্ধব করার লক্ষ্যে নিম্নবর্নীত সুপারিশসমূহ প্রনিধানযোগ্য;

১)         জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালায় প্রণীত কর্মকৌশলের ২২ নং এ উল্লেখিত অন্যান্য পেশাজীবি সংগঠনের সাথে “জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট, ঢাকা; বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ক্লিনিকাল মনোবিজ্ঞান অ্যাসোসিয়েশন”কেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

২)         জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিলে এবং নির্বাহী

৩)         কমিটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মনোরোগবিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৪)         জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালায় প্রণীত:

৩.ক) ৩য় মূল লক্ষ্যের বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কর্মী নিয়োগ দিতে হবে।

৩.খ) ৪র্থ মূল লক্ষ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি জরুরী চিকিৎসা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৩.গ) ৯ম মূল লক্ষ্যে লিঙ্গ সমতা বিষয়ে নারী ও কিশোর-কিশোরীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৩.ঘ) ১০ম থেকে ১৮শ মূল লক্ষ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৩.ঙ) ১৯ম মূল লক্ষ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি ও শিক্ষার মানোন্নয়ন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত

      করতে হবে।

৫)         জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালায় উল্লিখিত চ্যালেঞ্জসমূহের (ঘ) হইতে (দ) পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি সুস্পষ্ট ও জোড়ালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে একটি “জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ১৯৮৭” রয়েছে এবং সে দেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের নির্যাতনের কেসসমুহ এনজিওদের সহায়তায় অনুসন্ধান করে থাকে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ভারতের “উন্মাদ/পাগলামী বা ক্ষিপ্ততা আইন ১৯১২ (The Lunacy Act 1912)” যা মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্যকে সমর্থন করে তা বাংলাদেশেও সমানভাবে কার্যকর।

অন্যদিকে, পার্শবর্তী আরেকটি দেশ ভুটানে “জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মপরিকল্পনা ও পলিসি ১৯৯৭” রয়েছে এবং মানসিক স্বাস্থ্য  প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার একটি নিবিড় অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।

সবশেষ বলতে চাই, বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নীতির অনুপস্থিতি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের অন্তরায় হতেত পারে না। মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও চিকিৎসা ব্যয় রোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অতীতের থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি জাতীয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ক্ষতিকে শুধুমাত্র জন্ম ও মৃত্যু হার হ্রাসের পরিমাণগত মাপকাঠিতে না রেখে  মানসিক রোগ, বৈকল্য বা বিশৃংঙ্খলা কি পরিমাণ অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায়, অপরাধের হার বৃদ্ধি, পারিবারিক কলহ, দ›দ্ধও সম্পর্কের টানাপোড়েনে, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে, রাজনৈতিক পদস্তলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা পরিমাপ করতে পারি। তবে এর সুফল জাতি হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই ভোগ করতে পারবো।

বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাধিক এনজিও অধিকৃত একটি দেশ, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে মানুষ এখানে আসে উন্নয়ন শিক্ষা নিতে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে বিকেন্দ্রিয়করণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে এ ধরণের সেবা পৌঁছে দিতে আমাদের  প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে, শুধু দরকার একটু সদিচ্ছা আর সহমর্মীতা।

ধন্যবাদ।

ডা. আফরোজা আক্তার, প্রধান নির্বাহী ও প্রিন্সিপাল সাইকলজিষ্ট, উইমেন ফর উইমেন


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।