স্বাস্থ্য সেবা পেতে জনগণের ব্যয় কমানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব


স্বাস্থ্য আন্দোলন আয়োজিত এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ১০ জুলাই, ২০১৩। এই সভা দুপুর ২:০০টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকা শহরের অতিরিক্ত যানজটের কারণে বিকেল ৩:০০টায় শুরু হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ডাক্তার, স্বাস্থ্য কর্মী, উন্নয়ন কর্মী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং সাংবাদিকসহ মোট ৭৮ জন ।

সভায় সভাপত্বি করেন অধ্যাপক ডা. মেসবাহ্ উদ্দিন আহমেদ, বিভাগীয় প্রধান, গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক পরিষদ। সভা সঞ্চালনা করেন ফরিদা আখতার, নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ ও যুগ্ম আহ্বায়ক, স্বাস্থ্য আন্দোলন।

বক্তা ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ট্রাস্ট,অধ্যাপক মেজর (অবঃ) ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু, চিফ কনসালটেন্ট, অবস্ এন্ড গাইনী, ল্যাব এইড হাসপাতাল, ঢাকা। সামিয়া আফরীন, প্রজেক্ট ম্যানেজার, নারী স্বাস্থ্য প্রকল্প, নারীপক্ষ, ঢাকা। প্রফেসর ডা. মোঃ মোজাহেরুল হক, চেয়ারম্যান পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ।

নিম্নে বক্তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

ফরিদা আখতার, নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ ও যুগ্ম আহ্বায়ক, স্বাস্থ্য আন্দোলন।

আমাদের দেশে সরাকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রাথমিক অর্থাৎ একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল স্তরের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ আছে। কোথাও বলা নেই যে এই সেবা গরিবদের জন্যে নয়। সরকারী স্বাস্থ্য সেবা বিনা মূল্যে পাওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা Bangladesh National Health Accounts (BNHA, 2010) অনুযায়ী যে কোন পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের সময় ৬৪% খরচই ব্যবহারকারী নিজেকেই করতে হয়। দেশে স্বাস্থ্য সেবা যাদের প্রয়োজন তাঁরা সমানভাবে পান না।

ধনী গরিবের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল অসমতা ভীষণ অন্যায়ভাবে বিরাজ করছে। গরিব হলে এবং স্বাস্থ্য সেবা কেনার সামর্থ না থাকলে তাকে মরতে হয় আর না হলে আজীবন ভুগতে হয়। এদিকে স্বাস্থ্য খাতে বছরে বাজেট বরাদ্দ কমছে। মূল বাজেটের আকার যত বাড়ছে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ তত কমছে। আবার যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনের সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য নেই।

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ট্রাস্ট।

প্রতি বছর বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ নাগরিক কলকাতা, দিল্লী, চেন্নাই, ব্যাংকক, সিংগাপুর ও মালেয়শিয়া যান চিকিৎসা কেনার জন্য। বাংলাদেশের হাসপাতাল বিল্ডিং ও সরকারী ক্লিনিকের সংখ্যা দিয়ে যদি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান নিরুপন করা যেতো তা হলো এই দেশ স্বাস্থ্য সুবিধার পতিকৃত হতো। জনগণকে চিকিৎসা কেনার জন্য বিদেশে যেতে হতো না। কোর্ট বিল্ডিং যেমন বিচারের মানদণ্ড নয়, ঠিক তেমনি হাসপাতালের দালান-কোঠা স্বাস্থ্য সুবিধার নিয়ামক নয়।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা দেশে সুষ্ঠ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে না উঠার জন্য যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশী দায়ী কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বিভিন্ন অজুহাতে ও সরকারী মদদে অনুপস্থিতি এবং হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ থাকা সত্বেও ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অকারণে অতিরিক্ত মূল্যের ক্ষতিকর ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেবার চিকিৎসকদের ঐকান্তিক প্রয়াস বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।

দরিদ্রতা স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। অপরপক্ষে স্বাস্থ্যহানির কারনে দরিদ্রতা বাড়ে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক অসুস্থ হলে ভুল চিকিৎসা কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বহুল চিকিৎসার কারণে, যতটুকু শ্রমিক সঞ্চয় করেছে তা হারিয়ে দ্রুত সর্বস্বান্ত হয়। দরিদ্রতার কারণে পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়।

দেশে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় আদর্শ জেনারেল প্রাকটিশনার (General Practitioner-GP) বা পারিবারিক চিকিৎসক (Family Physician) পদ্ধতি চালু না থাকায় স্বাস্থ্য সুবিধাপ্রাপ্তি জটিল ও ব্যয়বহুল হয়েছে। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, ক্রমাগত শিক্ষার (Continuing Education) অনুপস্থিতির কারণে চিকিৎসকদের নিয়মিত আধুনিক জ্ঞানের অভাব, ঔষধ কোম্পানীর উপঢৌকন, ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যে প্রভাবিত হয়ে প্রকৃত ডিগ্রীধারী বিজ্ঞ চিকিৎসকের অপচিকিৎসায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ক্রমাগত বাড়ছে।

দেশের সর্বত্র ন্যূনতম সংখ্যক জেনারেল প্রাকটিশনার পারিবারিক চিকিৎসক সেবা সুবিধা না থাকায় সাধারণ মানুষ সরাসরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসা পান এবং আর্থিকভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হন। বর্তমানে এটা প্রমাণিত যে, দারিদ্রতার সাথে স্বাস্থ্যসেবার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা সরাসরি জড়িত। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরিক্ষা ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার কমালে স্বাস্থ্যের ব্যয়ভার কমানো সম্ভব হবে।

অধ্যাপক ডা. লায়লা আরজুমান্দ বানু, চিফ কনসালটেন্ট, অবস্ এন্ড গাইনী, ল্যাব এইড, ঢাকা।

বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে স্বাস্থ্য সেবা জনগণ পাচ্ছে তা গুণগত মানের দিক থেকে আরো উন্নীত করা প্রয়োজন, বেসরকারি স্বাস্থসেবার জন্য উচ্চ ফি এবং অধিক রোগ নির্ণয়ক পরীক্ষা ব্যয়বহুল চিকিৎসার একটি বড় কারণ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে দরিদ্র জনগণের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না।

সামিয়া আফরীন, প্রজেক্ট ম্যানেজার, নারী স্বাস্থ্য প্রকল্প, নারীপক্ষ।

বর্তমান সরকার বেশ কিছু ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যেমন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে জনগণের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া কিন্তু বেশীরভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকে তেমন সেবা পাওয়া যায় না এবয় অনেক জায়গায় ক্লিনিক বন্ধ থাকে। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক কিছু অঙ্গীকার করেছে তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সরকার মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর যে পরিসংখ্যান দেন নারীপক্ষ কাজ করতে গিয়ে দেখেছে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার সরকারের পরিসংখ্যানের থেকে বেশী।

এই সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ডা. মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক, চেয়ারম্যান, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন ।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।