জনগণের স্বাস্থ্য সেবার অবস্থাঃ প্রসংগ বাজেট ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা


জনগণের স্বাস্থ্য সেবা কি পর্যায়ে আছে? জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের তাই সরকার স্বাস্থ্য সেবা পরিচালনা করে, এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করে। এটা রাষ্ট্রের সেবা খাত কিন্তু সমাজ কল্যাণমুলক কাজ নয়। রাষ্ট্র তার নিজের প্রয়োজনেই স্বাস্থ্য সেবা দিতে হয় কারণ সূস্বাস্থ্য জনগণের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্যে একান্তভাবে জরুরী। অন্যদিকে স্বাস্থ্য সেবাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে সরকার কর আরোপের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ করে। অর্থাৎ জনগণ নিজেই কর প্রদানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবার জন্যে যে অর্থ খরচ হয় সে অর্থ সরবরাহ করে। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে কিছু প্রকল্প নেয়া হয়। আমাদের স্বাস্থ্য জনবল, বিশেষ করে চিকিৎসকরা, শিক্ষা লাভ করে জনগণের অর্থে, এবং তাদের বেতনও আসে জনগণেরই অর্থে। এগুলো সাধারণভাবে জানা তথ্য। তাই রাষ্ট্রের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার দাবী নেহায়েত আবদার নয়, এটা জনগণের অধিকার। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার দিক থেকেও স্বাস্থ্য সেবা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পেতে হবে। জনগণ আসলে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য সেবা নিচ্ছে না, সে এর জন্যে আগেই তার খরচ দিয়ে রেখেছে।

স্বাস্থ্য সেবা দেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য তাই বাৎসরিক বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হয়। কোন এক অজানা কারণে এই বরাদ্দ যা হওয়ার কথা তা হয় না। প্রয়োজন যা আছে মোট বরাদ্দ তার চেয়ে কম হচ্ছে প্রতি বছর, আবার সেই বরাদ্দ ঠিক জায়গায় দেয়া হচ্ছে না। সরকার নিজে যেখানে বরাদ্দ দিতে ইচ্ছা করছে সেখানে দিচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একটি দেশের মোট বাজেটের কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যয় করার তাগিদ দেয়। মাথাপিছু স্বাস্থ্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ডব্লিউএইচও নির্দেশিত পরিমাণের মাত্র অর্ধেক ব্যয় করছে। এই বরাদ্দ বিগত কয়েক বছরের বাজেটে ক্রমাগতভাবে কমতে দেখা যাচ্ছে। এর আগে ২০১০-১১ তে ৫.৯% ছিল তারপরের বছর একটু বেড়ে হয়েছিল ৬.৫%, কিন্তু ২০১২-১৩ তে এসে ৪.৮%, ২০১৩-১৪ সালে দেয়া হয়েছে ৪.৩%। আগামি অর্থ বছর ২০১৪-১৫ সকালে এই বরাদ্দ হয়েছে ৪.৪৫%। সাধারণভাবে মাথা পিছু স্বাস্থ্য ব্যায় ধরা হয় বছরে গড়ে মাত্র ১২ ডলার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিশেবে হওয়া উচিত ৩৪ ডলার। মাথা পিছু ব্যয় বরাদ্দ টাকার অংকে ২০০২ সাল থেকে ২০১২ -১৩ সাল পর্যন্ত গড়ে ছিল মাত্র ৪১০ টাকা। বলা বাহুল্য, এই টাকা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

বাজেট ২০১৪-২০১৫ – স্বাস্থ্য খাত

আগামী ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বিশাল অংকের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ১১,১৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যা মোট বাজেটের ৪.৪৫%। গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ০.১৯%। প্রস্তাব করা হয় ১১,১৪৬ কোটি টাকার, এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ৪,৩৪৯ কোটি টাকা এবং অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭৯৭ কোটি টাকা। গত বছর বাজেটের পরিমাণ ছিল ৯,৪৭০ কোটি টাকা। শতাংশ বিচারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতকে বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে ১০ম স্থানে রাখা হয়েছে। যেসব খাতে বরাদ্দ নির্দিষ্ট করা হয়েছে তার সারমর্ম হচ্ছে,

১। কমিউনিটি ক্লিনিকঃ মোট ১৩৫০০ টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ১২৫৫৭টি চালু হয়েছে, বাকী ৯৪৩টি করার জন্য বরাদ্দ। এর মাধ্যমে মাতৃ মৃত্যুর হার কমানোর চেষ্টার কথা বলা হয়েছে।

২। টেলিমেডিসিন সম্প্রসারণের ব্যবস্থা

৩। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত জনগোষ্টির জন্য সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

৪। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইন্সটিটিউট ও মেডিকেল ইন্সটিটিউট টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ও চিকিৎসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

৫। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি আধুনিকায়ন

এছাড়া শুল্ক ও করের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাত যে সব সুবিধা পাচ্ছে তা হচ্ছেঃ

ওষুধশিল্পের মৌলিক কাঁচামাল: ওষুধশিল্পের ব্যবহৃত ৪০টি মৌলিক কাঁচামালের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ১০ ও ২৫ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করে ৫ শতাংশ রেয়াতিহারে ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের ১৪টি কাঁচামালের বিদ্যমান শুল্ক হার এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য অত্যাবশ্যক ইনফিউশন পাম্পের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ মওকুফ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আয়ুর্বেদিক ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত এবং ৪১টি অত্যাবশ্যক কাঁচামালে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে উল্লেখযোগ্য ওষুধের দাম কমতে পারে।

কিডনি রোগীর চিকিৎসা খরচ কমানো: কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে কিডনি ডায়ালাইসিস সলিউশনের ওপর মূল্য সংযোজন কর(মূসক) পুরোপুরি মওকুফের প্রস্তাব করা হয়েছে।

হতাশাগ্রস্থ মানসিক ও শারীরিক ব্যাধিগ্রস্থ রোগীদের জন্য মেডিটেশন সেবা্র জন্য মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

বাজেটে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণকে ‘অপর্যাপ্ত’ আখ্যা দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইতিমধ্যে তার অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। জনমানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও এ খাতের সংকট দূর করতে হলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা স্বাস্থ্য খাতের বড় সংকট। রাষ্ট্রীয় বাজেটের যে অংশ স্বাস্থ্য খাতকে দেয়া হয়েছে তা দিয়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিজে যে সব সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন তার সারমর্ম হচ্ছেঃ

ক। গরিবদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা এ দেশে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এখানে অধিকাংশ মানুষ গরিব ও শ্রমজীবী। এদের জন্য রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়ানো দরকার। ব্যবস্থাপনার ক্রটির কারণেও সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অনেককে।

খ। ডাক্তার থাকলে নার্স থাকছে না, নার্স থাকলে কর্মচারীরা কাজে মনোযোগ না দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এসব ক্রটি বিচ্যুতি অবিলম্বে দূর করতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপকদের নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অবহেলা ধরা পড়লে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণে বেশ কিছু চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

গ। ধনীদের জন্য উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দেশে রয়েছে। টাকা খরচ করলেই বেসরকারি খাত থেকে সেবা মেলে। কিন্তু গরিবের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা হয়নি। গরিবের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবা একমাত্র ভরসা। গরিবদের জন্যই সরকারি সেবা সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন।

ঘ। হাসপাতালে অযত্নে অবহেলায় অসংখ্য চিকিৎসার যন্ত্রপাতি পড়ে থাকছে। একটি যন্ত্র বিকল হলে তা দিনের পর দিন না সারিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকল রাখার অভিযোগ আছে। যন্ত্র বিকল রাখতে পারলেই বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠিয়ে কমিশন খাওয়ার সুযোগ হয় সংশ্লিষ্টদের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্যোগী। একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারী বাইরে রোগী পাঠানোর কাজে জড়িত। মন্ত্রী বলেন, ‘এসব অপকর্ম থেকে বিরত থাকুন’। রাজধানীর একটি জেনারেল হাসপাতালে পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, বিনা দরকারে অনেক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কিনে ফেলা হয়েছে বলে আমি শুনেছি। কাদের সার্থে কেনা হয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। দোষী ব্যক্তিরা অবশ্যই শাস্তি পাবেন।

ঙ।আমরা সরকারি স্বাস্থ্য সেবা সমৃদ্ধ করতে চাই। বিপুল জনগোষ্ঠির জন্য সেবা নিশ্চিত করার কাজটি সরকার একা পারবে না। এজন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও বিনিয়োগে উৎসাহিত করছি। শুধু ব্যবসার জন্য স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ইতিবাচক নয়। আগে মানুষের সেবার বিষয়টি দেখতে হবে। তারপর ব্যবসা।

চ। বড় ও কর্পোরেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলো বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে। যেখানে পরীক্ষার ফি ২ টাকা সেখানে নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা পর্যন্ত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গরিবের জন্য সেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ছ। গরিবের জন্য চিকিৎসা ইন্স্যুরেন্স এবং হেলথ কার্ড চালু করা হচ্ছে। ডাক্তারদের গ্রামে থাকতে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ডাক্তারা যেন গ্রামে থাকে সে জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ডাক্তারদের গাড়ির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশেষ প্রণোদনাও দেয়া হবে। তাতেও যদি তারা গ্রামে থাকতে না চান তাহলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের লক্ষ্য স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া।

জ। মাঠ পর্যায়ে ডাক্তারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশ উন্নতি করলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্যান্য বিষয়গুলোকে অবহেলা করলে চলবে না। নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়ের বৃহত্তর অংশ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে।

এসব কথা দীর্ঘ দিন স্বাস্থ্য আন্দোলন, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বলে এসেছেন, এখন মন্ত্রীও বলছেন, কিন্তু এর প্রতিকার কি আদৌ হবে? তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর এই উপলবদ্ধিকে আমরা স্বাগত জানাই। এবার বাজেটের পর স্বাস্থ্য আন্দোলন কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, কারণ জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে যে ধরণের আলোচনা হচ্ছে তাতে কারো কোন সমালোচনা বা পর্যালোচনা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রী নিজে সংসদে উপস্থিত থেকে সমালোচনা শোনার চেষ্টা করছেন না। বাজেটের আগে জনগণের মতামত নেয়ার কোন প্রক্রিয়া দেখা যায় না। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার কারণে জনগণের মতামতের কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। বাজেটে মোট বরাদ্দ ও খাতওয়ারী বিতরণ কোন প্রয়োজনের ভিত্তিতে করা হয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। জনস্বার্থের জন্যে গুরুত্বপুর্ণ খাতে এই ধরণের একপক্ষীয় সিদ্ধান্তে বাজেট বরাদ্দ কখনোই জনসমর্থন পেতে পারে না। তবে জনস্বাস্থ্য সেবার উন্নতির জন্যে আমাদের নিজেদের মধ্যে এই আলোচনা অব্যাহত রেখে জন সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিকঃ

১। চিকিৎসকরা কর্মস্থলে থাকেন না

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ালেই জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হবে এমন কোন কথা নেই। কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতন প্রধান সমস্যা হচ্ছে চিকিৎসকরা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে উপস্থিত থাকছেন না। নয় থেকে ১৬ জন চিকিৎসকের নিয়োগ থাকলেও উপস্থিত থাকছেন মাত্র দু’তিন জন। এখানে প্রতিদিন ২০০-৩০০ রোগী আসে তাদের সামাল দিতে গিয়ে এই চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়। এবার বাজেটের পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবার মানসি্কতা নিয়ে চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বলেছেন নিজ কর্মস্থলে নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত না থাকলে তাদের চাকুরি স্থায়ী হবে না এবং পদোন্নতিও হবে না । কিন্তু এখনো এই পরিস্থতির কোন উন্নতি হয়েছে এমন খবর পাওয়া যায় নি।

২। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য জনবল পর্যাপ্ত নয়

দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্যে খুব বড় বড় ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে বেশি দরকার দক্ষ স্বাস্থ্য সেবা কর্মী গড়ে তোলা, যার মধ্যে রয়েছে উপজেলা, জেলা থেকে শুরু সকল পর্যায়ের হাসপাতালে নার্স, প্যারামেডিক, টেকনিশয়ান, দক্ষ ধাত্রী গড়ে তোলা। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য জনবলের দিক থেকে বিশ্বের ৫৮টি ঝুঁকিপুর্ণ দেশের মধ্যে একটি, এখানে প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য মাত্র ৫.৪ জন ডাক্তার এবং ২.১ জন নার্স রয়েছে। ডাক্তার নার্সের অনুপাত হচ্ছে ১ জন ডাক্তারের সাথে ০.৪ জন নার্স। নার্সের তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা ২.৫ গুন বেশী। কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য মাত্র ৩.২জন।

৩। স্বাস্থ্য সেবা গ্রহনে খরচ রোগীর নিজেকেই করতে হচ্ছে

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ একাউন্টস, ২০১০ এর গবেষণায় দেখা গেছে ২০০৬-৭ সালে মোট স্বাস্থ্য সেবায় খরচ হয়েছে ১৬০,৮৯৯ মিলিয়ন টাকা, জনগণ নিজের গাইট থেকে খরচ করেছে ১০৩,৪৫৯ মিলিয়ণ টাকা (৬৪%) আর সরকার দিয়েছে ৪১,৩১৮ মিলিয়ন টাকা (২৬%)। এখানেই সরকারের জনপ্রতি অপ্রতুল বরাদ্দের কথা এসে যায়। মাত্র ১২ থেকে ১৬ ডলার ( ১২৮০ টাকা) বরাদ্দে জনগণের খরচ কমবে না। এই খরচ মেটাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ ঋণগ্রস্থ হচ্ছে এবং দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে। ধনী-গরিব ব্যবধানও ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার আওতায় ২০৩২ সালের মধ্যে জনগনের খরচ কমিয়ে ৩২% করার এবং সরকারের বরাদ্দের পরিমাণ বড়িয়ে ৩০% করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারী স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় ধনীদের জন্যে সুবিধা বেশী দেয়া হয়েছে, ধনীদের জন্যে রয়েছে ২৭% (তারা জন সংখ্যার মাত্র ২০% হবে, যারা দেশের ৪৩% সম্পদের মালিক) আর গরিবদের জন্যে রয়েছে ২১% মাত্র, (এদের সংখ্যা কমপক্ষে ৭৫%, অথচ তাদের সম্পদ আছে মাত্র ৪%)। অথচ সরকারি স্বাস্থ্য সেবা হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের জন্যে যার অধিকাংশই হচ্ছে গরিব।

৪। সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় সুশাসনের অভাব

স্বাস্থ্য খাতে নানাভবে দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনা দেখা যায়, যার কারণে ওষূধ সরবরাহ থেকে শুরু করে মেশিনপত্র কেনা কাটায় বিরাট অনিয়ম ঘটে। টাকা খরচ হয় কিন্তু মানুষের কণ উপকার হয় না। এমনকি চিকিৎসকদের নিয়োগ ও বদলি নিয়ে বাণিজ্য হয়। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন আনতে না পারলে মান সম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যাবে না।

৫। ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার ঘটনা ঘটেই চলেছে

বিগত কয়েক মাসে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে বেশ কয়েকটি অনাকাংকিত ঘটনা ঘটেছে, যেখানে অভিযোগ উঠেছে ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। এর ফলে স্বজনরা ডাক্তারের ওপর চড়াও হয়েছে এবং হাসপাতালে ভাংচুর করেছে, অন্যদিকে প্রতিবাদে চিকিৎসকরা ধর্মঘট ডেকে শত শত রোগীকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিৎ করেছেন। অথচ এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের দিক থেকে কোন সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এই বিষয়টি এখনো অ-মীমাংসিত রয়ে গেছে।

৬। স্বাস্থ্য সেবা পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিদের ভুমিকা

উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ভুমিকা কার্যকর ভাবে দেখা যায় না। জনপ্রতিনিধিদের সাথে মাসিক বৈঠক নিয়মিতভাবে হয় না। এই দুর্বলতার কারণে জনগণের ইচ্ছার কোন প্রতি ফলন স্বাস্থ্য সেবা পরিচালনায় ঘটে না।

৭। ঢালাওভাবে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য বরাদ্দ কাম্য নয়

প্রয়োজন ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে ঢালাওভাবে সকল উপজেলা স্বাস্থ্য সেবার জন্য একই ধরণের স্বাস্থ্য বরাদ্দ কাম্য নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জন সংখ্যার দিক থেকে ছোট বড় উপজেলায় একইভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়। এটা পরিবর্তন করে প্রয়োজনের ভিত্তিতে দেয়া উচিত।

৮। হাওরবাসী ও আদিবাসিরা বঞ্চিত থাকবে কেন?

হাওরবাসীদের জন্যে বিশেষ কোন বরাদ্দ নেই। যেমন কিশোরগঞ্জের চারটি উপজেলা অষ্টগ্রাম, ইটনা, নিকলী,ও মিঠাইনের চিকিৎসক স্বল্পতা প্রকট। বর্ষা এবং শুষ্ক মৌসুমে যাতায়াত ব্যবস্থা খুব নাজুক। দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হয় রোগীদের। হাওর এবং চরাঞ্চলের জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া উচিত। আদিবাসীদের কথাও স্বাস্থ্য সেবার দেয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে না।

৯। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হচ্ছে

সরকারি স্বাস্থ্য সেবার দুর্বলতার কারণে বেসরকারী সেবা উৎসাহিত হচ্ছে এবং তারা জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করছে। এর সাথে সরকারি চিকিৎসকরা পরোক্ষভাবে যুক্ত হচ্ছে কারণ তাঁরাই আবার প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসক হিশেবে নিয়োজিত হচ্ছেন। সরকারি চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থলে ভাল করে সময় না দিয়ে বেসরকারি হাস্পাতালে সময় দিচ্ছেন বলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ‘সেবা’ না করে ব্যবসা করছে। বেসরকারি হাসপাতালের সাথে সরকারি চিকিৎসা খরচের একটি চিত্র দেয়া হোল।


cost


১০। আন্ত-মন্ত্রণালয়ের কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভুমিকা নেই

প্রতিরোধ্মুলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার, তামাক চাষ, খাদ্যে ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, জিএম ফসলের প্রবর্তন ইত্যাদী বিষয়ে মতামত দেয়া এবং কার্যকর নেয়ার কথা কিন্তু সেটা তারা করছে না। পরিবেশ দুষণের বিষয়টি স্বাস্থ্যহানী ঘটায়, অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে নীরব। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টী শ্রমমন্ত্রণালয়ের সাথে করতে হবে। এভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অথচ এই বিষয়টি দেখা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ

১। স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের ২০১২ সালের ১৮ জুন সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তব্য]

২। যুগান্তর ৬ জুন,২০১৪]

৩। যুগান্তর পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রীঃ যুগান্তর ৭ এপ্রিল, ২০১৪

৪। সমকাল ৭ জুন, ২০১৪

৫। সমকাল ২০ জুন, ২০১৪

৬। দেহ fb.com/deho

২৯ জুন, ২০১৪, ঢাকা


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।